গাজীপুরে ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে

আগের সংবাদ

রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সংশয়

পরের সংবাদ

খেজুরের দাম কি ন্যায্য থাকবে?

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আসন্ন রোজায় খাদ্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের নিয়ে যে বৈঠক করেছেন ২৯ জানুয়ারি। তাতে মনে হয় এবার মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারবেন না। কিন্তু পুঁজির ধর্মই হচ্ছে মুনাফা লুটে নেয়া। পুঁজিবাদী সমাজের উন্নত দেশগুলো সেটা ভালো জানে। আমরাও জানি, পুঁজির স্বভাব ও ধর্ম। সে অর্থনীতি যত ছোটই হোক না কেন, ধর্মানুযায়ী সে লাভ গুনবেই। কিন্তু সেই লাভের পরিমাণ কতটা, সেটাই আসল প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী সেটাই ধরেছেন। বলেছেন, ভোক্তা-জনগণের ওপর যাতে আর্থিক চাপ না পড়ে সেটা দেখতে হবে। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উপস্থিত মন্ত্রীরা নিজ নিজ তরফ থেকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে তারা এ ব্যাপারে সজাগ-সচেতন আছেন এবং থাকবেন। দক্ষতার সঙ্গে সব সমস্যার সমাধানও করবেন। খাদ্য, বিশেষ করে রোজার সময়ে বেশি কেনেন ভোক্তা-জনগণ চাল, চিনি, ভোজ্যতেল আর খেজুরসহ ফলজাতীয় পণ্য। ওই পণ্যগুলোর সরবরাহ যথেষ্ট ভালো এখন। খোলা বাজারে/কাঁচা বাজারে ওই তিন/চার পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। এবং স্টকেও আছে যথেষ্ট। এই পরিস্থিতি জানার পর আমরা বলতেই পারি, এ বছর কোনোরকম গোল বাধাবে না ব্যবসায়ীরা। আবার সবচেয়ে বড় খাদ্য ব্যবসায়ী সাধন চন্দ্র মজুমদার নিজেই তো খাদ্যমন্ত্রী। ফলে আমরা ধরেই নিতে পারি তিনি দাম কম রাখতেই তৎপর থাকবেন। যদিও আমরা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তার সম্পদ বাড়ার হিসাবে জেনেছি (তিনি যে সম্পদের হিসাব দিয়েছেন ইসিতে), তাতে তার আয় বেড়েছে ৩০০ গুণ। ফলে আমাদের মনের লেজে এই সত্যই ঘুরছে যে তিনি কি খাদ্যপণ্যের দাম ঠিক রাখতে পারবেন। যার ব্যবসায়িক ধর্ম হচ্ছে পুঁজিকেন্দ্রিক, আর পুঁজির ধর্ম হচ্ছে মুনাফা করা, সেই প্রগতি থেকে তিনিই বা ফিরবেন কেমন করে? ফলে আমাদের মনের লেজে ভয় লেগেই থাকছে। তবে আমরা সব সময় আশাবাদী। প্রধানমন্ত্রী নতুন এক সেট মন্ত্রী (কয়েকজন পুরনোসহ) দিয়েছেন, তাতে করে এটা বলা যায় যে- এবার তারা জয়ী হবেনই। কারণ আর কতবার তারা ব্যর্থ হবেন? না, আমরা মাথা নত করব না বলে গত নির্বাচনে যেভাবে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন, নতুন নির্বাচনী ফেনোমেনার জন্ম দিয়েছেন, যা নতুন ইতিহাসের দ্বার উন্মোচন করেছে। এই উন্মোচন আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নতুন বিষয় উপহার দেবে বলেই মনে হয়।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি দাম ইস্যুতে অভিযান প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, জেলা প্রশাসকরা জানাচ্ছেন, প্রয়োজনে সাজা, জরিমানা ও জেল দেয়া হচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে এলসির সমস্যা নেই। মন্ত্রীরা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করছেন। বেশকিছু পণ্যের ওপর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মজুতদারদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
সচিব জানান, গত বছরের এই সময়ে ৩৭ হাজার ১০৭ টন খেজুর আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল, এবার এখন পর্যন্ত ৪৪ হাজার ৭৩৪ টনের এলসি খোলা আছে। গত বছর এই সময় ৯৭ হাজার ২৮৭ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানির এলসি করা ছিল। এবার ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৭৪ টনের এলসি করা আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে ডলারের সংকট আছে এটা এই পরিসংখ্যান প্রমাণ দেয় না। গত বছর এই সময় ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭০ টন অপরিশোধিত চিনির এলসি খোলা হয়েছিল। এবার ৩ লাখ ৮৭ হাজার ১৩৮ টন চিনি আমদানির এলসি করা আছে। (সমকাল/৩০ জানুয়ারি, ২০২৪)
জেলা প্রশাসকরা যে অসৎ ও অতিমুনাফাখোর বাজার ব্যবসায়ীদের জেল, জরিমানা, সাজা দিচ্ছেন, সেখানে কি সত্যিই লোভ অতিমাত্রায় ভর করেছিল? খুচরা ওই সব ব্যবসায়ী যদি আড়ত থেকে বেশি দামে কিনে এনে থাকেন, তাহলে তাদের দোষ কোথায়? খাদ্যপণ্যের বড় ব্যবসায়ী, আড়তদার, মজুতদারদের ব্যাপারে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন জেলা প্রশাসকরা এবং তার ফলে কী প্রভাব খোলা বাজারে পড়েছে, তা যাচাই করে দেখতে হবে। সচিব মহোদয় মুখস্থ বলে দিলেন যে তারা কাজ করছেন এবং বাজারে তার ইতিবাচক ফল পড়ছে। এই রকম ফ্লাট তথ্যে মন ভরলেও প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে সহসাই।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, গত বছরের তুলনায় এবার নিত্যপণ্যের এলসি বেশি হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে ডলারের ঘাটতি নেই। তিনি যে সরলভাবে কথাটা বলছেন, তা আমরা বুঝতে পারছি। এলসি হচ্ছে আমদানি পণ্যের দাম পরিশোধে ব্যাংকের নিশ্চয়তাপত্র। ১৫ দিন থেকে দেড় মাস পর্যন্ত বিদেশ থেকে পণ্য আসার সময়কাল। এই সময়ের পর সেই পণ্যের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি আসে। দেড়-দুই মাস পর্যন্ত ঋণের বৈদেশিক মুদ্রার চাপ থাকবে না। আবার ওই সময়ের মধ্যে দেশে আসবে শত কোটিরও বেশি রেমিট্যান্স, রপ্তানি বাণিজ্যের ডলার এবং আরো যেসব খাত থেকে আমরা ডলার আয় করি, সেসব অর্থ। ফলে আগাম এলসিতে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ থাকবে না বলেই মন্ত্রিপরিষদ সচিব কথাটি বলেছেন। আমরাও সেটা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু মূল সমস্যা তো পণ্য আমদানির পর বিক্রির সময় ঘটে। পুঁজি যারা ঋণ নিয়ে করেছেন, তারা অতি মুনাফা করতে পারেন না। কারণ জনগণের টাকাই তো তারা ব্যবহার করছেন। তাদের ব্যক্তিগত পুঁজি তো তেমন একটা লাগে না। একেই বলে ব্যাংকের টাকায় ব্যবসা করা। কৈ-এর তেলে কৈ মাছ ভাজার গল্পটি আমরা জানি। এটা কেবল আমদানির ক্ষেত্রেই ঘটে না। শিল্প সেক্টরেও ঘটে। শিল্প ও ব্যবসায়ী সেক্টরে এর ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শিল্প সেক্টর ও ব্যবসায়ী সেক্টর মিলে গত ১৫ বছরে ঋণগ্রহিতারা ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপ করে বসে আছেন। ব্যবসা আর শিল্পের নামে নেয়া ওই বিপুল পরিমাণ টাকা তারা ফেরত দিচ্ছেন না। সরকার বাহাদুরও আনছে না। কিন্তু এ নিয়ে সরকারের তেমন মাথাব্যথা নেই। নামকাওয়াস্তে ঋণীদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। ঋণীদের দাপটে কম্পমান ব্যাংকিং সেক্টর আজ দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়। সরকার টাকা ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কাহিল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর লিকুইডিটি সংকট কাটাবার প্রয়াস নিয়েছে। এই বাড়তি টাকার চাপ পড়ছে গিয়ে কাঁচা বাজারে। পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার ধরন দেখেই তা বোঝা যায়। এই শীতেও একটি কদু, যাকে মহানগরবাসী লাউ নামে চেনেন, দাম মিনিমাম ১০০ টাকায় উঠেছে। তার মানে টাকার মূল্য কতটা কমেছে তা বোঝা ও জানা যায় এখানে এসে।
এবার আসা যাক আসন্ন রোজা ও ঈদের পণ্যবাজারে খুচরা ও মজুতদার, আড়তদারদের মুনাফার ব্যাপারে। খুচরা বাজারের ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলেন, খেজুর তো সারা বছরই বিক্রি হয়, কিন্তু চাপটা বাড়ে রোজার আগে। ফলে সারা বছর আমরা তাকিয়ে থাকি রোজার মাসের দিকে। পবিত্র ওই মাসটার প্রতি যে বাড়তি একটা মানবিক ও নৈতিক চাপ ব্যবসায়ী-দোকানিরা অনুভব করবেন, তা তাদের লাভের চাপ, দাম কমে যাওয়ার নয়। বরং তারা সেই চাপই অনুভব করেন কতটা দাম বাড়াবেন এবং কত লাভ করবেন, তার ওপর।
এ বছর খেজুর কত টাকা কেজি দরে আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা, তা জানি না আমরা। সংকট তৈরি হলেই কেবল সাংবদিকরা আমদানি মূল্য চেক করেন। কেন এক কেজি খেজুর ১৮/১৯শ টাকায় বিক্রি হবে? এই প্রশ্নই খুঁজে বের করে খেজুরের আমদানি মূল্য কত। গত বছর সব থেকে ভালো মানের যে খেজুর, তা আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। তার নিচের গ্রেডের বিভিন্ন নামের খেজুর আনা হয়েছিল ৬০ থেকে ৮০/৯০ টাকায়। অথচ সেই খেজুর আমরা কিনেছি ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৮/১৯শ টাকায়। আমদানিকারকদের পর যে কয়টি হাত বদলই হোক না কেন, ওই রকম দামের মানে উঠতে পারে না খেজুর। কিন্তু বাজারে বিভিন্ন বাহারি নামের খেজুর ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। বিত্তবানদের মনে একটি বোধ কাজ করে, তাহলো যে খেজুরের দাম বেশি সেই খেজুরই মানে, স্বাদে ভালো। ক্রেতা-গ্রাহকের স্বাদকে কেন্দ্র করে দোকানিরা দাম নির্ধারণ করেন। একেক বাজারের দোকানিদের মধ্যে সংঘবদ্ধতা আছে। ছোট আকারের সিন্ডিকেট গোটা মহানগরে ছড়িয়ে দিতে পারে না বলেই কোনো কোনো মার্কেটে দামে হেরফের হয়।
প্রশ্ন এখানেই, গত বছর যে পাহাড় সমান দামে খেজুর বিক্রি করেছেন দোকানিরা, এবারো কি সেই রকম দামেই তারা বিক্রি করবেন? নাকি সরকার আমদানি বিল অব এন্ট্রি দেখে খেজুরের মূল্য নির্ধারণ করে দেবে এবং সেই দামের বেশি কেউ খেজুর বিক্রি করতে পারবেন না।
না, আমি জানি সরকার ওই পথে যাবে না। কারণ দোকানি, আড়তদার, মজুতদার তাদেরই রাজনৈতিক সহোদর। তাদের তারা লালন-পালন করে। সরকারের এ রকম মনোভাবই আমরা লক্ষ করেছি- যখন দাম বেঁধে দেয়ার দুই/তিন পক্ষীয় মিটিং করে তারা। ব্যবসায়ী নেতারা দাম নির্ধারণ করে এসে পুনরায় বেশি দামেই পণ্য বিক্রি করেন। কারণ তাতে তারা দোষ দেখেন না। এটাই হচ্ছে পুঁজির রাজনৈতিক ধর্ম। রাজনৈতিক সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেয়ে তাদের মুনাফা করতে দিতে অভ্যস্ত। তারা মনে করে সাইকোলিক্যালি ওই সব ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা তাদেরই পক্ষের মানুষ। তাদেরই রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সন্তান।
এবং তারাই রাজনৈতিক সরকারের বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে কাজ করবেন। এবার যে সংসদটি চলছে, নবনির্বাচিত সরকারের নব-মনোনীত মন্ত্রীদের সেবা দানের ওয়াদা আমরা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তাদের ওয়াদা-সেবা যে ভোক্তারা পাবেন না, এটা সুনিশ্চিত করেই বলা যায। অতীতেও আমরা সেটা দেখেছি। এই সরকারও অতীতের মতোই ব্যবসায়ীবান্ধব হিসেবেই চিহ্নিত হবে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ীর পারসেন্টেজ ৬৯ শতাংশ। ১০০ জনের মধ্যে ৬৯ জনই পেশায় ব্যবসায়ী। বাকি ৩১ শতাংশ রাজনীতিক রাজনৈতিক পেশায় জড়িত। তারা তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মী। তারা পোড়-খাওয়া রাজনৈতিক কর্মী। এদের আয় হয় সামান্যই। যারা ব্যবসা করেন তাদের আয় ২/৩শ শতাংশ। ব্যবসা থেকেই তারা সেটা আয় করেন। আমরা বলতে চাই না যে তারা দুই নম্বরি করেও মাল কামান। যদিও সেটাই সত্য যে এত বিপুল আয় ঘুষ-বাণিজ্য ছাড়া সম্ভব নয় কিংবা উন্নয়ন কাজের টাকা মেরে দিয়ে আত্মসাৎ করার পরই তারা এত বিত্তের অধিকারী হয়ে থাকবেন।
আমরা তাদের ব্যবসার বিরোধী নই। তারা সেটা করতেই পারেন। কিন্তু জনগণের প্রতি সেবার মনোভাব ও দায়িত্ব নিয়ে সেই কাজেই মনোযোগী থাকা জরুরি।
আমরা এবার দেখতে চাই ১০০ টাকা দরে আমদানি করে সেই খেজুর যেন ২ হাজার টাকায় বিক্রি করতে না পারে খুচরা ব্যবসায়ীরা। এই নিশ্চয়তা দিতে হবে সরকারকে, নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের। কারণ প্রশাসনের লোকদের মনে রাখা জরুরি, তারা সেবা দেয়ার জন্যই নিয়োগ পেয়েছেন এবং জনগণের অর্থেই তাদের বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি এবং সম্পদ হয়েছে।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়