প্রধানমন্ত্রীর তিন বিশেষ সহকারী নিয়োগ

আগের সংবাদ

অনন্য সংসদের ঐতিহাসিক সূচনা

পরের সংবাদ

এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কি রাষ্ট্রের অপাঙ্ক্তেয়?

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) বিভাগ এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের চাকরি বিধির খসড়া প্রণয়ন করেছে। এতে তাদের আচরণ ও শৃঙ্খলাবিষয়ক ১০টি ধারা উল্লেখিত আছে। একটি কর্মশালার মাধ্যমে খসড়াটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে চূড়ান্ত করা হবে বলে তারা জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে বিষয়টি ঘিরে সচেতন মহলে বেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে ২৯ হাজার ১৬৪টি এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোতে ৫ লাখেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষক। বলাবাহুল্য, দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরের (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত) প্রায় ৯৭ শতাংশই বেসরকারি এমপিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত। এতে ৪ লক্ষাধিক বেসরকারি শিক্ষক শিক্ষাসেবায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাই দেশের সামগ্রিক শিক্ষা জনবলের এক বিশাল অংশকে এই প্রণীত বিধিমালার আওতায় নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবিক ও ফলপ্রসূ হবে তা বিশেষ চিন্তার দাবি রাখে। খসড়া বিধিতে বলা হয়েছে- ‘শিক্ষক-কর্মচারীরা কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপের অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংসদ সদস্য বা বেসরকারি কোনো ব্যক্তির কাছে যেতে পারবেন না।’ এটি সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকার পরিপন্থি এক নিদারুণ নীতি বৈকি। কেননা প্রতিটি পেশাগত মানুষের পেশাগত জীবনের পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত ও নাগরিক সুবিধা-অসুবিধা শেয়ারিংয়ের জন্য সামাজিক ক্ষেত্র থাকে। এমপিও শিক্ষকরা এমনিতেই অনেক সময় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের পরিকল্পিত রোষানলের শিকার হন (যা প্রায়ই দেখা যায়)। আমাদের দেশে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব হয়ে ওঠেনি, যা প্রায়ই নানা অপ্রিয়কর ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয়। তার ওপর এসব অবরুদ্ধ নীতি তাদের প্রবঞ্চনার মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিধিতে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত আইএলও ইউনেস্কো নীতির পরিপন্থি। তবে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জাতিসত্তা ও জাতি-সংস্কৃতি পরিপন্থি তথা দেশবিরোধী কোনো অপরাজনীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। খসড়ায় প্রাইভেট টিউশন, খণ্ডকালীন চাকরি ও ব্যবসা নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এমপিও শিক্ষকরা রুগ্ন বেতনে এমনিতেই নাজুক জীবনযাপন করেন। আমরা দেখেছি, একটু জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কোনো কোনো এমপিও শিক্ষক আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির জন্য নিরুপায় হয়ে কখনো কখনো ক্লাসে স্টুডেন্টদের কাছেও চাঁদা তোলেন, যা খুবই কষ্টদায়ক ও লজ্জাস্কর বটে! অনেকে লোক লজ্জার ভয়ে অভাবের যাতনে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিভৃতে দিনাতিপাত করে থাকেন। পরিমার্জিত সমাজ গঠনে শিক্ষকদের বিশেষ নৈতিক দায় রয়েছে। খসড়ায় বিতর্কিত ধর্মীয় বিষয়ে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িকতা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অবিচ্ছেদ্য ও মৌলিক চেতনা। যার ওপর ভিত্তি করেই আমরা আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এ বিষয়ে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষকদেরও সমাজে ও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাস্তরে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায় রয়ে গেছে। এ বিষয়ে উপরোক্ত বিধির যথার্থ ব্যাখ্যা থাকা উচিত বলে মনে করি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাপনাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত। এই ত্রি-বিভাজনের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য বেশ প্রকট। বিশেষ করে একই কারিকুলামের আওতায় একই সমাজে, একই একাডেমিক যোগ্যতায় সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক-সামাজিক মর্যাদার মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্য এ সমস্যাকে দিনে দিনে নীরবে ঘনীভূত করছে। তার ওপর আবার বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে এমন অবরুদ্ধকর বিধি-প্রবিধি সমস্যাকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারে।
প্রসঙ্গত, জাতির পিতাকে হত্যার পর দীর্ঘ প্রায় দুই যুগব্যাপী এ দেশের মৌলিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কুপরিকল্পিতভাবে বিকৃত করা হয়েছিল। পক্ষাঘাত করা হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তার মৌলিক চেতনাকে। এমন বিকৃত শিক্ষা-ভাবধারার মধ্য দিয়ে রীতিমতো একটা প্রজন্ম বেড়ে ও গড়ে উঠেছে। সময়ের আবর্তে বাঙালির মৌলিক চেতনাবিরোধী নষ্ট-ভ্রষ্ট এমন মতবাদ বর্তমানে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাও পেয়েছে, যা জাতীয় রাজনীতির জন্য মোটেও সুখকর নয়। বরং অশনি বটে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সংবেদনশীল ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ও সরকার ঘোষিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সংঘটনে শিক্ষকদের অপরিসীম ভূমিকা রাখার শতভাগ নৈতিক দায় বর্তায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে শিক্ষক হলো সেই মেরুদণ্ডের মজ্জা। তারা পরিশীলিত জাতি গঠনের প্রধান কারিগর। কোনো কঠোর শাসন- অনুশাসনের ফ্রেমে এই সুশীল পেশাজীবীদের বেঁধে রেখে আর যা-ই হোক অন্তত সৃষ্টিশীল শিক্ষাসমাজ সৃষ্টি করা যায় না। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেয়া হিতকর হবে বলে মনে করি।
কাজী মাসুদুর রহমান : লেখক ও শিক্ষক।
কাজী মাসুদুর রহমান

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়