গাবতলীতে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা

আগের সংবাদ

রাজপথে ফের শক্তির মহড়া

পরের সংবাদ

একজন কৃষক নেতার আত্মকাহিনি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাবা ছিলেন প্রকৌশলী, বড় ভাই আণবিক শক্তি কমিশনের বড় বিজ্ঞানী। কিন্তু তিনি দেশকে ভালোবেসে আজীবন কৃষকদের সঙ্গেই থেকে গেলেন। আজিজুর রহমান ফকুর নাম অনেকে শুনেছেন, অনেকে শোনেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের কৃষক নেতা। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, সেই সুবাদে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি। প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী ছিলেন ছাত্রলীগের নূরে আলম সিদ্দিকী। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন প্রথম ঢাকা কলেজ থেকেই শুরু হয়েছিল, আর সেটা ঘটেছিল আজিজুর রহমান ফকুর নেতৃত্বেই। ঢাকা কলেজ থেকেই বাষট্টির আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে শুরু।
তিনি বুঝেছিলেন দেশের মুক্তির জন্য কৃষকদের সংগঠিত করা দরকার, তাই শহর থেকে ফিরে গেলেন গ্রামে। গ্রামের স্কুলে চাকরি নিলেন বেতন ছাড়াই। এ সময় এলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। লিখেছেন তিনি, ‘আমার জীবনে দুটো স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। প্রথমটি কৈশোরকালের, দ্বিতীয়টি যৌবনকালের’। [আজিজুর রহমান ফকু : আমার জীবন আমার সংগ্রাম, র‌্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা ২০২১, পৃষ্ঠা ১৩]। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকাটি যুগপৎ সাংগঠনিক এবং সরাসরি লড়াইয়েরও। শত শত ছাত্র-তরুণ-যুবককে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ নিতে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দিয়েছেন, আবার দেশের ভেতরে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন।
যে গ্রামে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন তার নাম ‘চরমধুচরিয়া’। পরে ‘মধু’ শব্দটি বিলীন হয়ে যায়, এখন ‘চরচরিয়া’ বলেই সবাই চেনে। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় তার পাশের গ্রামেই আগলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহাকবি কায়কোবাদ। কিন্তু কমরেড ফকুকে গ্রামের কৃষকরাই আকর্ষণ করেছিলেন। ফলে কমিউনিস্ট পার্টিকেই তিনি মনে করেছিলেন মুক্তির ত্রাতা। আমরা ইতিহাসে খুব কম কমিউনিস্টের খোঁজ পাব, যিনি সমাজের সর্বজনীন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে স্কুল নেই, কলেজ নেই, একটা কলেজ বানিয়ে ফেল। গ্রামের মানুষ ভাবছে একটা মাদ্রাসারও প্রয়োজন, আজিজুর রহমান ফকু মাদ্রাসা বানানোর কাজে লেগে গেছেন। এখানেই শেষ নয়, কমরেড ফকু ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ মাহফিলেরও আয়োজন করে যাচ্ছেন। এভাবে তিনি ‘ফকু স্যার’ থেকে ‘ফকু ভাই’ হয়ে উঠলেন। একজন কমিউনিস্ট চরিত্রের যা যা থাকা দরকার ফকু ভাইয়ের ছিল তার সব ধরনের যোগ্যতা। মাছের চাষ করছেন, বন্ধুদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করছেন, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার বাধা দূর করছেন, কলেজ, মসজিদ নির্মাণ করছেন, শিক্ষক বই লিখেছেন প্রকাশ করতে পারছেন না, তো ফকুকে ডাক। ফকু একটা দোকান দিয়েছিলেন, দোকান বিক্রি করে স্যারের পাণ্ডুলিপি নিয়ে বই বানিয়ে প্রকাশ করে দিচ্ছেন। খেলার মাঠ নেই কিশোরদের, একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে হবে, গ্রামে ধার-কর্জ করে এসব ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন আজিজুর রহমান ফকু।
বাষট্টির আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অনেক ছাত্র কারাগারে, তাদের জামিন নিয়ে বের করতে হবে। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আজিজুর রহমান ফকুকে টাকার জন্য পাঠালেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। সেই প্রথম কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখা। বঙ্গবন্ধু টাকার পরিবর্তে কতকগুলো চিরকুট দিলেন। তো টাকার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। সেই ঘটনা এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে তার স্মৃতিতে :
পরদিন সকাল ৭টায় আমার সাইকেলের সামনের ঝুড়িতে ওইদিনের ৮/১০টি পত্রিকা নিয়ে জননেতার (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ধানমন্ডিস্থ ৩২ নং-এর বাসভবনে গেলাম। দেখলাম মহান নেতা একটা লুঙ্গি পরে বারান্দায় পায়চারি করছেন। সালাম দিলাম। সালাম নিয়ে দরাজ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাকে তো চিনলাম না?’ আমি বললাম, লিডার, আমাকে চেনার কোনো কারণ নেই। আমি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী, ঢাকা কলেজের ভিপি। এভাবে আমার পরিচয় দিলাম এবং বললাম যে, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সাহেব আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। বললেন, ‘তোমাকে পাঠাল কেন? রাজ্জাক এলো না কেন?’ বললাম, লিডার ওনারা সকলেই আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করছেন। লিডার প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাও নাই কেন?’ বললাম, আমিও তো আন্ডারগ্রাউন্ডে। জিজ্ঞাসা করলেন ‘কেমন?’ বললাম, লিডার আমি একজন পত্রিকা বিক্রেতা হিসেবে আপনার বাড়িতে এসেছি। তা ছাড়া ঢাকা কলেজের ভিপিকে আইনশৃঙ্খলার লোকদের তেমনভাবে চেনার কথা না। লিডার আমার কথা শুনে হেসে বললেন, ‘তোমাকে দিয়েই হবে’। [আমার জীবন আমার সংগ্রাম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮২]
যে কোনো রাজনীতিকের স্মৃতিকথাই সমসাময়িককালের দলিল। আজিজুর রহমান ফকুর স্মৃতি গ্রন্থটিও একটি রাজনৈতিক দলিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর ঘটনাবলি এখানে বাণীবদ্ধ হয়ে আছে অবিকল আকর খণ্ড হিসেবে :
থানার পুলিশ মাঝে মাঝে আমার খোঁজ নিত। একদিন সকালে পুলিশ আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আমার নানিকে জিজ্ঞাসা করল আমি বাড়িতে আছি কিনা। আমার নানি পুলিশদের বসতে না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, তার নাতি কোনো চুরি-ডাকাতি করেছে কিনা? কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে গেছে কিনা? পুলিশ বলল, ‘না-না এসব করবে কেন। সে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।’ নানি বললেন, ‘তোমরা কি বাঙালি না? আমার নাতিকে ধরতে এসেছ? [আমার জীবন আমার সংগ্রাম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৬]।
পাকিস্তান আমলে সরকার ও পুলিশের এসব জুলুম থেকে বাঁচার জন্য অনেক সময়ই নানা পেশায় নিয়োজিত হতে হয়েছে তাকে, কখনো স্কুলের শিক্ষক, কখনো নৌকার মাঝি। আবার নির্বাচনেও দাঁড়াচ্ছেন। এমন করে ১৯৬৫ সালে বিডির জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই বিডির মেম্বাররা ভোট দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতেন। তার স্মৃতিকথায় এ সম্পর্কে মজার কাহিনি উল্লিখিত হয়েছে :
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান এবং বিরোধী দল থেকে ফাতেমা জিন্নাহ। আমি বিরোধী দলের প্রার্থী ফামেতা জিন্নার পক্ষে সব দলবল নিয়ে নির্বাচনে কাজ করি। নির্বাচনের দিন আমার নেতৃত্বে শতাধিক কর্মী নবাবগঞ্জে যায়। আমি তাদের বিভিন্ন নির্বাচনী ক্যাম্পে কাজ করার জন্য ভাগ করে পাঠিয়ে দিই। নির্বাচনে নবাবগঞ্জ থানায় ফাতেমা জিন্নাহ বিপুল ভোটে জিতলেও পাকিস্তানের উভয়াংশে মোট ভোটে ফাতেমা জিন্নাহ পরাজিত হন। [আমার জীবন আমার সংগ্রাম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮]।
এর আগের ঘটনাটি আরো রোমাঞ্চকর। লিখেছেন তিনি :
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আইয়ুব খান রমনার রেসকোর্স ময়দানে চল্লিশ হাজার বিডি মেম্বারকে আমন্ত্রণ করেন। আমরা নবাবগঞ্জের বিডি মেম্বাররা মঞ্চের সম্মুখে বসেছিলাম। আমি উপস্থিত বিডি মেম্বারদের গোলাপ ফুলের ব্যাজ বাদ দিয়ে হ্যারিকেনের ব্যাজ পরাচ্ছিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে দেখলাম অধিকাংশ বিডি মেম্বার হ্যারিকেনের ব্যাজ খুলে ফেলে দিয়ে গোলাপ ফুলের ব্যাজ লাগাচ্ছে। এ সময় আইয়ুব খান মঞ্চে এলে আমি মঞ্চের সম্মুখে গিয়ে সেøাগান দিই- ‘আইয়ুব খান ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’। আইয়ুব খান তখন বলেন, ‘ঠিক হ্যায় ভাই, আইয়ুব খান ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক’। এরপর বক্তৃতা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় আমি পুনরায় সেøাগান দিই, ‘আইয়ুব খান মুর্দাবাদ, আইয়ুব খান মুর্দাবাদ’। আইয়ুব খান ঘুরে এসে বলেন, ‘আইয়ুব খান মুর্দাবাদ, আইয়ুব খান মুর্দাবাদ’। [আমার জীবন আমার সংগ্রাম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৭]।
এভাবে ষাটের দশকের ছাত্রনেতা হিসেবে তার সাহসিকতার পরিচয় আমাদের কাছে ফুটে ওঠে। রাজনীতি করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল কমরেড সত্যেন সেন, কমরেড জিতেন ঘোষ, কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী, কমরেড দাউদ হোসেন প্রমুখের সঙ্গে। ন্যাপ করতে গিয়ে অধ্যাপক মোজাফফরের সঙ্গও পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয় আওয়ামী লীগের সিঁড়িতেই। মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে একত্রে যোগদান করেন বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া সংগঠনে। ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদে নির্বাচনও করেছেন। তবে কৃষক রাজনীতি ছেড়ে দেননি। কমিউনিস্টদের পরিচালিত বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন, সেখান থেকে কাজের ক্ষেত্র সেই একই জায়গায়, কৃষক লীগে কাজ করেন। এমনি করে রাজনীতি থেকে রাজনীতিতে ঘুরপাক খেয়েছেন অনেকবার, কিন্তু বাংলার কৃষককে ছাড়েননি কোনোদিন।
কৃষক, ক্ষেতমজুর ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার জন্য বাংলার গ্রাম এবং বাংলার কৃষকেরই যেন আত্মকাহিনি হয়ে আছে তার স্মৃতিকথা খণ্ড আমার জীবন আমার সংগ্রাম।

ড. মোহাম্মদ হাননান : লেখক ও গবেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়