যাত্রী কল্যাণ সমিতি : লক্করঝক্কর বাস উচ্ছেদ করে ৫ হাজার উন্নত বাস নামান

আগের সংবাদ

সমন্বয়হীনতার খেসারত : দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভিন্ন অবস্থানে আটকে আছে তিন শ্রেণির পাঠ্যবই লেখার কাজ > নতুন শিক্ষাক্রম

পরের সংবাদ

রাজনীতির দাবার চাল

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাজনীতি অনেকটা দাবার চাল। এক চালেই বাজিমাত হয়ে যেতে পারে, আবার এক ভুল চালেই পুরো খেলার রাজা মরে যেতে পারে। একটি রাজনৈতিক গল্প দিয়েই শুরু করি। মদের ফোয়ারা, বিলাসের স্বর্গ, অর্থের বন্যা বইয়ে দেয়া এক পার্টিতেই বদলে গিয়েছিল ইরানের ভাগ্য একসময়। এক জমকালো ফূর্তির পার্টি বদলে দিয়েছিল সে দেশের ভাগ্য। ইরানের সেদিনের বদলের আঁচে আজো পুড়ছে সেখানকার মানুষ। পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম গোঁড়া মুসলমান দেশ হিসেবে পরিচিত বর্তমান এই ইরান। হিজাবে মাথা না ঢাকলে এখন কড়া শাস্তি দেয় ইরানের শরিয়াহ আইন। কিন্তু ১৯৭১ সালের পূর্বে শাহের এই ইরান ছিল ১৮০ ডিগ্রি ভিন্ন। তখন পশ্চিমা সংস্কৃতির রীতিমতো ভক্ত ছিল ইরান। ১৯৭১ সালে একটি জমকালো রাজকীয় পার্টি দিয়েছিলেন সে সময়ে ইরানের রাজা শাহ মহম্মদ রেজা পহলভি। তার আমলে ইরানের অভিজাত মেয়েরা হাঁটুছোঁয়া স্কার্ট পরে রাস্তায় নামত। সেই রাজার হঠাৎ খেয়াল হলো, দেশ-বিদেশের সরকারপ্রধান, রাজা, আমির-ওমরাদের আমন্ত্রণ করে মনোরঞ্জন করাবেন। ইরানে তখন পারস্য রাজতন্ত্রের ২৫০০ বছর পূর্তি। সেই বর্ষপূর্তিতেই আয়োজন করা হয় এ ফূর্তির। পার্টির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল এক বছর আগে থেকেই। ১১০ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত রাজার রাজপ্রাসাদও এ পার্টির জন্য পছন্দ হলো না। রাজার পার্টির ব্যবস্থা হলো মরুভূমিতে। মরুভূমির বুকে ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যজুড়ে গড়ে তোলা হলো এক কৃত্রিম শহর। অতিথিদের থাকার জায়গা থেকে শুরু করে পানভোজন এবং মনোরঞ্জনের জায়গা- সবই এক বছর ধরে তৈরি করা হলো এ কৃত্রিম শহরের ভেতরে। পার্টি উপলক্ষে শুধু শহর নয়, একটা অস্থায়ী রাজপ্রাসাদই বানিয়ে ফেলেছিলেন রাজা। এ কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল ৪০টি ট্রাক, ১০০টি বিমান। এসবই ফ্রান্স থেকে আমদানি করা হয়েছিল। ৬৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন আমন্ত্রিতদের তালিকায়। এর বাইরে ছিলেন আরো অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী। সে সময়ের রাজা-রানী কেউ বাদ পড়েননি। অতিথিরা যেন পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙতে পারেন, সে জন্য খাঁচায় ভরে আনা হয়েছিল ৫০ হাজার পাখি। তবে শেষ পর্যন্ত পাখিগুলোর কলকাকলিতে মুগ্ধ হতে পারেননি অতিথিরা। মরুভূমির আবহাওয়ায় অনভ্যস্ত ওই হাজার হাজার পাখি কয়েক দিনেই মারা গিয়েছিল। মরুভূমির বুকে যখন রাজার এ কর্মকাণ্ড চলছে, ইরানের সাধারণ মানুষের তখন দিন কাটছিল অতি কষ্টে। দিনে তিন বেলা খাওয়া হতো না অনেকেরই। কিন্তু রাজার মাথায় তখন একটাই চিন্তা- বিদেশি অতিথিদের চোখে মুগ্ধতা আনবেন কী করে! তিন দিনের এ রাজকীয় আপ্যায়নে আনা হলো ২৫ হাজার ওয়াইনের বোতল। তৈরি হলো ১৮ টন খাবার। অতিথিদের সেবা প্রদানে নিয়োগ করা হলো ১৮০ জন ওয়েটার। ইরানের কিছু মানুষ যখন খাবারের খোঁজে হন্য হয়ে ঘুরছে, তখন রাজকোষ থেকে ব্যয় হয়ে গেল ১০ কোটি ডলার। দেশে রাজা রেজা পহলভিকে নিয়ে এমনিতেই গোঁড়া মুসলমানদের মনে ক্ষোভ ছিল, এ পার্টি সেই রাগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। সে সময় রাজার কট্টর সমালোচক এক শিয়া ধর্মগুরু হঠাৎই জনসমর্থন পেতে শুরু করেন। সেই ধর্মগুরু আয়াতুল্লা রুহুল্লাহ মুসাবি খামেনি। তার নেতৃত্বে জনতার রোষ একটা সময় এতটাই বেড়ে যায় যে, প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে হয় রাজা-রানীকে। ইরানে এরপর খামেনির নেতৃত্বে তৈরি হয় নতুন ইসলামিক সরকার। প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসলামিক আইন। বদলে যায় ইরানের ভাগ্য। বাংলাদেশও কম যায়নি। পরম পরাক্রমশালী জেনারেল এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তার মন্ত্রিপরিষদসহ পালিয়ে গিয়েছিলেন রাতের অন্ধকারে। আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা এবং বিএনপির খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা এবং সক্রিয় বিরোধিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সংখ্যা কত, তা নিয়ে বিরোধীদের দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগের দুর্দান্ত প্রতাপের সময়ও বিরোধী আসনে থাকা ন্যাপের সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একাই সংসদে বিরোধী কণ্ঠ সোচ্চার করে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। ২০১৮ সালেও স্বল্পসংখ্যক বিএনপি সংসদ সদস্য প্রায় ৯০ শতাংশ সরকারি সংসদ সদস্যের পাশে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন বিরোধী শিবিরের অস্তিত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটাই বাস্তবতা, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং ভোটের রাজনীতি সচল থাকলে এখানে হয় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার সুযোগ পাবে। তাদের চ্যালেঞ্জ করার মতো তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তি এখনো বাংলাদেশে তৈরি হতে পারেনি। বাংলাদেশের জনগণেরও স্বার্থ এখানেই- এদের যে কোনো একদল ক্ষমতায় গেলে ভিন্ন দলটি বিরোধী ভূমিকা পালন করবে। একটি দল নিরঙ্কুশ হয়ে গেলে একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ার সুযোগ হতে পারে, যা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্যই ভীতির কারণ।
বিএনপি ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনী রাজনীতির বিরোধিতা করে আসছে। ২০১৪ সালে তারা নির্বাচন বর্জন করেছে, ২০১৮ সালে বর্জন করতে করতে শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনে এলেও উচ্চমহলে কিছু হটকারী সিদ্ধান্ত তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০২৪ সালে এসেও তারা নির্বাচন বর্জন করার রাজনীতিই করে বসেছে। তারা ২০২৪ সালে বিদেশি শক্তির ওপর বেশি নির্ভর না করে যদি নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর বেশি নির্ভর করতে পারত, তবে হয়তো তাদের বিরোধী রাজনীতির চিত্র অন্যভাবে আঁকা হতো। তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব লন্ডনে নির্বাসিত থেকে একের পর এক রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ফলশ্রæতিতে তাদের মাঠের কর্মী হারিয়েছে। নির্বাচন বর্জন, রাজনৈতিক পরিকল্পনার অভাব, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভাব ইত্যাদি কারণে বিপুল জনসমর্থিত একটি দল ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। সেই কারণে সংসদে ২০২৪ সালের পর আওয়ামী লীগই সরকারি দল এবং আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হিসেবেই থাকছে। বিএনপির এই নির্বাচন বিরোধিতার রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের জনগণেরই ক্ষতি ডেকে আনল। সংসদে সরকার কিংবা কোনো মন্ত্রীর কাজের সমালোচনা করার সুযোগ আর থাকল না। অন্যদিকে, কর্মতৎপরতা না থাকায় বিএনপির কর্মীদের মনে উৎসাহের কমতি হবে এবং তারা হয় নিষ্ক্রিয় হবে অথবা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আশ্রয় নেবে। বিএনপি সমর্থকদের একটি অংশ এখনো নীরবে বিএনপির আশায় পথ চেয়ে আছে। কেননা তারা মূলত বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বিএনপিকে ভালোবাসে না; তারা মূলত এন্টি-আওয়ামী লীগ সেন্টিমেন্ট পোষণ করে। তাই তাদের বিএনপি ছাড়া সমর্থনের অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
আওয়ামী লীগ শুধু দাবিই করে না, প্রমাণও দিয়েছে তারা নির্বাচনমুখী দল। আওয়ামী লীগ সব সময়ই তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে ‘এ’ প্ল্যান এবং ‘বি’ প্ল্যান বজায় রেখেছে। জিয়া এবং এরশাদের সময়ে নির্বাচনের বিরোধিতা করলেও খালি মাঠে তারা কাউকে গোল করতে দেয়নি। ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ১৯৮৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনেও তারা অংশ নিয়েছিল। সে নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। বিজয় নিশ্চিত করতে পারলে নির্বাচন বর্জন না হতে পারে- এটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু বিএনপির পরপর নির্বাচন বর্জন তাদের রাজনীতির খেলার মাঠ থেকে সাইড ট্র্যাক হতে হচ্ছে। এতে তারা তাদের কর্মীদের হারাচ্ছে। বিএনপি এবার চরম ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। সংসদে এবং সংসদের বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারনির্ভর থাকার সুযোগ পেয়ে গেছে। তাদের কোনো প্রতিপক্ষ নেই, দুশ্চিন্তা নেই। এক ঝড়ে দখল করার রাজনীতি করতে চাচ্ছে বিএনপির বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই তারা দেশের শক্তির চেয়েও বিদেশিদের শক্তির ওপর নির্ভর করতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। বিষয়টি তারা বিশ্লেষণ করতে পারছে না, আত্মসমালোচনা করতে পারছে না; তাই সঠিক সিদ্ধান্তও নিতে পারছে না। নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী আসনে বসে তাদের নিজেদের পক্ষে কথা বলার সুযোগও তারা পাচ্ছে না। শুধু তারা নির্বাচন বর্জন, নির্বাচন ঠেকানোর রাজনীতিই করে যাচ্ছে। কোনো ঝড় এসে তাদের ক্ষমতায় বসায়নি, কোনো বিদেশি শক্তি তাদের রাজনীতির পথ সুগম করে দিতে পারেনি। পক্ষান্তরে, তারা হারানো রাজনৈতিক মাঠটি ধীরে ধীরে দখল করারও কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেনি।
এক সময় এ দেশের রাজনীতিতে মুসলিম লীগের বড় ধরনের প্রভাব ছিল। আজ তা ইতিহাস মাত্র। ইরানে শাহের আমল এখন ইরানিদের কাছে ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা মাত্র। এরশাদের জাতীয় পার্টিও তাদের স্বর্ণযুগ ভেবে শুধু চোখ ঝাপসা করে। এসব কিছুই এখন বাস্তবতার অনেক দূরে। বিএনপি এখনো ইতিহাসের ছেঁড়া পাতায় স্থান পায়নি। তবে নির্বাচন বর্জনের পরপর সিদ্ধান্ত তাদের অনেক নেতাকর্মীকে হতাশ করেছে, দলছাড়া করেছে। বিএনপির এ ক্ষতির কারণে আওয়ামী লীগের আনন্দ হলেও বিএনপির অগণিত সমর্থকের জন্য তা অতীব কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে লাভ হচ্ছে না দেশেরও। রাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রকৃত অর্থেই একটি বিরোধী দলের অস্তিত্ব প্রয়োজন। বিএনপিকে এবার কঠিনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তারা ইতিহাসের অংশ হবে, না ধীরে ধীরে তাদের রাজনৈতিক মাঠ দখলের চেষ্টা করবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, সরকার, সবার ওপরে আমেরিকা, ইইউ, জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্বের একটা চাপ ছিল। এ নির্বাচনটি কোনোভাবে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো সরকারি দলের হাতে রাখার সুযোগ ছিল না। বিএনপি নির্বাচনে এলে এবার তারা ভালো একটি নির্বাচনী মাঠ পেতে পারত। কিন্তু তারা সেখানেও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল। নির্বাচন বর্জনের ভূত তাদের মাথা থেকে যেন সরছেই না। অন্যদিকে সরকারি দল তাদের দাবার চালে সবকিছুকে কুপোকাত করে দিতে পারল। রাজনৈতিক চালে তারা এগিয়ে গেল অনেকটা পথ। বিপরীতে রাজনৈতিক ভুল চালে বিএনপি পিছিয়ে গেল অনেকটা পথ।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়