শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ মহাসচিবের অভিনন্দন

আগের সংবাদ

সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা

পরের সংবাদ

ভয় এবং আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিচেতনা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চেতনা একটি স্পর্শকাতর শব্দ। একে বিশেষভাবে সম্পদে পরিণত করেছে সমাজে প্রচলিত শব্দ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার পক্ষের চেতনা ইত্যাদি। যখন এই চেতনাটিকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সমন্বিত করে ব্যবহার করবেন, তখন আমাদের ১৭ কোটি মানুষের মনে জেগে উঠে সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কল্পিত দৃশ্যকল্প। আমরা যে ৩০ লাখ মানুষের আত্মবলিদানের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছি, সেই অবদানকেই তুলে ধরা হয়। ঠিক এই চেতনার পাশে যখন স্বাধীনতার পক্ষের চেতনা উচ্চারিত হয় তখন বিপক্ষের একটি গোষ্ঠীর চেহারা ভেসে ওঠে চোখে। মনে হয় স্বাধীনতাবিরোধী ছিল, কিন্তু তারা তো সমাজে মিশে গেছে গত ৫০ বছরের রাজনৈতিক ও সামরিক কালচারের ভেতর দিয়ে। আমরা সেই স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করেছি, নির্মূল করিনি। ফলে এখন এই ৫৩ বছরে এসে দেখতে পাচ্ছি ক্ষমতাসীন সরকার তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই স্বাধীনতাবিরোধী বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন এবং রাজনৈতিক অনুসারীদের উসকে দিচ্ছেন নির্মূল কর বিএনপিকে। তারা সন্ত্রাসী দল। বিএনপি যদি সন্ত্রাসী দল হয় তাহলে সেই সন্ত্রাসীদের পক্ষে দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ কী করে থাকে? আর যারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তাদের পক্ষের লোকেরা (কথিত ৩৫/৩৭ শতাংশ) ভোটকেন্দ্রে যায়নি আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করতে? আবার বিএনপি নির্বাচনে আসেনি বলে কত রকম তদবির তথ্য ও খবর আমরা জানতে পারলাম। এই যে রাজনৈতিক কন্ট্রাডিকশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে, এর দায় কে নেবে আর কেন তারা ওই ধরনের কথা চাউর করবেন? একটি দেশের এত বিশালসংখ্যক মানুষ যদি তথাকথিত সন্ত্রাসী দলের অনুসারী হয়, তাহলে তাদের প্রবৃদ্ধি কেন থামাতে পারেনি আওয়ামী সরকার? এটা তো সরকারের ব্যর্থতাই নয়, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও রাজনৈতিক ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার হুংকারই কি আমরা শুনি মাঝে মাঝেই রাজনৈতিক জনসভায়? শুনি রাষ্ট্রীয় শাখার মুখে ও কাজে, কর্মোদ্যোগে। এমনকি রাষ্ট্রের তিন সাংবিধানিক শাখার একটি বিচার বিভাগের বিচারকদের মুখেও। অর্থাৎ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শাখার কথা ও অ্যাকশনের ভাষা ও তার সরাসরি প্রতিফলন শুনলাম/পড়লাম সংবাদপত্রে বিচারকদের অরাজনৈতিক/নিরপেক্ষ/নির্দলীয় বিচারকের মুখে, তখন কি মনে হয় যে তারা স্বাধীন সার্বভৌম একটি সাংবিধানিক শাখার বিবেকপূর্ণ মানুষ, যাদের ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারে? নিচে দেয়া হলো একটি রিপোর্টের খণ্ডাংশ, দেখা যাক সেখানে বিচারকদের ভাষা ও ভঙ্গি কেমন, তা খুব সহজেই উপলব্ধি করা যাবে।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার অভিযোগে করা মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন প্রশ্নে রুল খারিজ করে হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়েছে। গত সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
রুলের ওপর শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১০ জানুয়ারি ওই রায় দেন।
ঘটনা পর্যালোচনা করে পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ‘অভিযুক্ত আবেদনকারী (মির্জা ফখরুল) দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করছেন, যাকে তিনি জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন দাবি করে আসছেন। দুর্ভাগ্যবশত, গত কয়েক মাসে দেখা গেছে যে, কথিত ওই ভোটাধিকারের দাবি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে যুক্ত হয়েছে। যাতে প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনকারী সরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহন, পুলিশের গাড়িতে হামলার মতো ঘটনা রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, কথিত আন্দোলনকারীরাই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। আমরা এসব অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা বিবেচনায় নিয়েছি, যেগুলো দৃশ্যত দেশে আতঙ্ক তৈরি করেছে। বস্তুত দেশ ও দেশের জনগণকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
রায়ে আদালত বলেছেন, ‘আবেদনকারী বিপর্যয়কর ও উচ্ছৃঙ্খল এসব ঘটনার পরিকল্পনাকারী বা তার কোনো ভূমিকা ছিল কিনা, সে বিষয়ে কেবল সুষ্ঠু তদন্তের পর সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। তদন্তের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে এই পর্যায়ে তার মুক্তির জন্য জামিন দেয়া সহায়ক হবে না বলে আমরা মনে করছি। মামলায় কিছু ধারা আছে জামিন অযোগ্য। প্রজাতন্ত্র ও জনগণের নিরাপত্তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা রুলটি খারিজ করছি।’
রায়ে আদালত বলেছেন, প্রধান বিচারপতি প্রজাতন্ত্রের তিনটি অঙ্গের একটির প্রধান। সে কারণে এ ধরনের হামলার অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল হতে পারে। (প্র/আ ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪) এই রায়ের ভাষা ও উদ্বেগের শারীরিক ভঙ্গি কি কোনো ন্যায়পরায়ণ, নিরপেক্ষ আদালতের রায়ের ভাষা? নাকি কোনো রাজনৈতিক সরকারের অভিযোগ সংগঠনের ভাষা? রায়ে বিচারকদের দৃষ্টিতে যা সত্য ও ন্যায় বলে মনে হয়েছে, তারা সেই কথাই লিখেছেন। কিন্তু সাধারণের মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে যে, ওই কথিত দিন (২৮ তারিখ) যে সশস্ত্র পুলিশ রাজনৈতিক দল বিএনপির সমাবেশ মঞ্চ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে পণ্ড করল এবং বিএনপি অফিসে তালা মেরে দিয়ে উপস্থিত ও অনুপস্থিত নেতাকর্মীদের আটক করল, রক্তাক্ত করল আন্দোলনকারীদের, তাদের সাংবিধানিক অধিকারকে অন্যায়ভাবে নস্যাৎ করল, আদালতের বিচারকদের চোখে সেসব পড়েনি। বিএনপির সমাবেশ তো অহিংস পথে পরিচালিত হয়ে আসছিল গত প্রায় এক বছর ধরেই, সেসব অহিংস গণসমাবেশের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশনে/ গুলিতে ১৭ জন মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে, বিচারকদের চোখে তা পড়েনি। সরকারি বেসরকারি সম্পদ, প্রধান বিচারপতির বাসার গেটে আগুন দেনেওয়ালরা যে গাজীপুর থেকে আসা আওয়ামী লীগ কর্মী, সেটাও তাদের চোখে পড়েনি। সেসব ধ্বংসযজ্ঞ যদি বিএনপির কর্মীরা করে থাকে এবং তাদের নারকীয় যজ্ঞ যদি রাজনৈতিক অপরাধ হতে পারে আইনের চোখে, তাহলে আইনের চোখে কি পুলিশি অ্যাকশন ও ধ্বংসযজ্ঞ কোনো অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না? আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর অস্ত্রের অ্যাকশন, শারীরিক নির্যাতন, মেরে রক্তাক্ত করার ঘটনা কি তাদের অপরাধ নয়? আত্মরক্ষার নামে প্রতিবাদী মানুষ হত্যা যদি অপরাধ না হয় তাহলে সম্পদ ধ্বংসও অপরাধ হতে পারে না। সম্পদের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য শত-সহস্রগুণ বেশি, সেটা কি বিচারকদের অরাজনৈতিক বিবেকে একবারও জাগেনি? অপরাধকে সরকারি চোখ দিয়ে না দেখে দাবি আদায়ের সাংবিধানিক অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হতে হবে। যারা আইনগুলো সৃজন করেছেন, তারা মাথায় রেখেছিলেন যে এই আইনের সুবিধাভোগী হচ্ছে ক্ষমতাসীন পক্ষ। ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক রাজশক্তি, পাকিস্তানি আমলে তাদেরই মানসিকভাবে অনুগত শাসকগোষ্ঠী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকদের রাজনৈতিক চেহারার পরিবর্তন আমরা দেখিনি। তাদের মানবিক ও মানসিক বোধের সাংস্কৃতিক কোনো পরিবর্তন আমরা দেখিনি। এখানেই চেতনার কথাটি আসে। আসে কীভাবে আমাদের রাজনীতিকরা গণতান্ত্রিক দেশের শাসকদের স্বার্থরক্ষার আইনি প্যাঁচগুলো রচনা করেন। তাদের রাজনৈতিক ও আইন সংস্কৃতিতে মানুষের চেয়ে নিষ্প্রাণ স্থাপনার মূল্য অনেক বেশি। রাজনীতিকরা এতটাই খতরনাক চরিত্র যে, তাদের আটকে রাখার জন্য এমন সব আইনি গেরো রচনা করেছেন আইনপ্রণেতাগণ, যা কেবল সাংবিধানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে লঙ্ঘনই করেনি, তা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনারও পরিপন্থি।
এই মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক চেতনার পরিপন্থি/বিরোধী আইন চলতে পারে না। বিশেষ করে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের হাতে সৃজিত আইন প্রতিস্থাপন করতে হবে, যেখানে ‘জামিনযোগ্য নয়’ শব্দবন্ধ থাকবে না, থাকতে পারে না। যারা যুদ্ধ করে (রাজনীতিক ও জনগণ) দেশ স্বাধীন করে রাষ্ট্র কায়েম করেছে, তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াসটি যে স্বাধীনতার খেলাপ, সেটা বুঝতে হলে আইনজ্ঞ হতে হবে না। আইন হচ্ছে মানুষের অধিকারকে রক্ষার জন্য, তাকে/তাদের নিগৃহীত করার জন্য নয়। তাই আইন প্রয়োগকারী পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মানুষরা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী, তারা রাজনৈতিক সরকারের না হোক, অর্ডার বাস্তবায়নকারী হতে পারে না। ১৭টি প্রাণ হত্যাকারী আওয়ামী রাজনৈতিক সরকার তো এখন ক্ষমতায়, তাদের অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে তো কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? কেন হয়নি? মানুষ হত্যা করলেও যদি আইন কোনো বিচারের ব্যবস্থা না করে, যদি মহান বিচারকদের চোখেও তা না পড়ে, তাহলে বিবেকের কী মূল্য রইল? আমাদের সংবিধান তো প্রজাতন্ত্রের তিন অঙ্গের সাংবিধানিক স্বাধীনতা যেমন দিয়েছে তেমনি অরাজনৈতিক ও মানবিকতাও দিয়েছে, যাতে তারা পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় করতে পারে। ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকার কেবল নির্বাহী বিভাগের নয়, তার দুই অংশীদার হচ্ছে বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদ। এর বাইরে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমকে অপ্রত্যক্ষ চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। সাংবিধানিক সংস্থা মানবাধিকার সংস্থাও আছে, যারা ন্যায় কায়েমে ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের ঘোষণাপত্রে সিগনেটরি হিসেবে বাংলাদেশ সব রকম মানবাধিকার রক্ষার অধিকারী এবং সরব একটি সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এটাই যে, ওই কমিশনে যারা প্রধান হিসেবে যোগ দেন তাদের নিয়োগদাতা যেহেতু সরকার, তাই তারা পলিটিক্যালি সরকারের পক্ষেই কাজ করেন। ফলে আমরা সরকারের অনৈতিক কাজে বাধা দিই না। দিতে ভয় পাই, যদি সরকার আমাকে উৎখাত করে? কারণ যিনি রাষ্ট্রপতি তিনিও সরকারপ্রধানের পরামর্শ ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও অধিকারী নন। আমরা ক্ষমতার ব্যালান্সকে রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছার পুতুল বানিয়েছি। ভয় তাই কেন্দ্রীয় চরিত্র এখন। এই ভয় কেবল ওইসব সংস্থায়ই নয়, ক্ষমতাসীন দলে ও সরকারের সবার মধ্যে জেঁকে বসে আছে। তারাও সত্য বলতে ভয় পান, যদি মন্ত্রিত্বের চাকরি চলে যায়। যদি রাজনৈতিক দল থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়, যদি জেলে ঠেলে দেয়া হয় মাত্র একটি শব্দের জন্য, তাহলে কেন ক্ষমতার মধু থেকে নিজেদের বঞ্চিত করব?
এই রাজনৈতিক মানসিকতার অবসান করে হবে? তা না হলে, রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তা পরিপূর্ণতা লাভ করবে না। ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, পাইনি মানসিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি, যা সব কিছুর আগে পাওয়ার কথা। কারণ আমরা মানসিকভাবে পরাধীন রয়েছি বলেই বুঝতে পারি না যে সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবে স্বাধীনতার মানে কী? ন্যায় চিন্তা করার স্বাধীনতাই আমাদের পৌঁছে দেবে প্রকৃত স্বাধীনতায়।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়