আইনমন্ত্রী : জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ৬৪৮ এমপির কথা বলা হচ্ছে

আগের সংবাদ

উপজেলা নির্বাচনের আগেই বিবাদ মেটাতে চায় আ.লীগ : ভোটের কোন্দল

পরের সংবাদ

স্টেপ-ইন-এ মওলানা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ততদিনে অখণ্ড বাংলার তিন প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমউদ্দীন প্রয়াত। সোহরাওয়ার্দী এবং নাজিমউদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন আর ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। পূর্বাংশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে নাজিমউদ্দীন অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কখনই কোনো রাষ্ট্রীয় পদের অধিকারী না হয়েও ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বে অবিচ্ছেদ্য পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ক্ষমতাকেন্দ্রিকও নন, রাজধানীকেন্দ্রিকও নন। থাকতেন রংপুরের পাঁচবিবি কিংবা টাঙ্গাইলের সন্তোষে।
স্টেপ-ইন-এ গৃহকর্ত্রী জায়নাব আখতার ১৯৬৮ সালে ফরিদপুর বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বাড়িতে আসার সুযোগ কম। মওলানা পাঁচবিবি কিংবা সন্তোষ থেকে এলে উঠতেন ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের বাড়িতে। ব্যারিস্টার শওকত মেধাবী আইনজীবী, রণদাপ্রসাদ সাহার বড় জামাতা এবং আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর (১৯৬৭-এর নভেম্বরের কাউন্সিল অধিবেশনের পর ন্যাপের চীনপন্থি আর মস্কোপন্থি বিভাজন ঘটে। মওলানা রয়ে যান চীনপন্থি শিবিরের প্রধান আর পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান হন মস্কোপন্থি শিবিরের প্রধান, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ) তিনি উঠতেন তার দলের কোষাধ্যক্ষ সাইদুল হাসানের বাসায়। রিকশায় চড়ে একজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে মওলানা ১৯৬৮-এর শেষ দিকে একদিন স্টেপ-ইন-এ হাজির হলেন। গৃহকর্তা এম এ জলিল বাড়িতে নেই, গৃহকর্ত্রী ফরিদপুরে, তাদের একমাত্র সন্তান নিলুফার সুলতানা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বাদ দিয়ে তার খাওয়া ও থাকা নিশ্চিত করতে রয়ে যান।
গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী ভেবেছিলেন মওলানা হয়তো কোনো সাময়িক খেয়ালে তাদের বাড়ি এসেছেন, কিন্তু নিশ্চিত হওয়া গেল এটা খেয়াল নয়, এটা তার প্রয়োজনও। এরপর ঢাকায় এলে প্রতিবারই স্টেপ-ইন-এ নিজেই হাজির হয়েছেন। মওলানা যেখানে থাকেন তাকে ঘিরেই তখন রাজনীতির অন্যতম প্রধান ধারাটি প্রবাহিত। ‘গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পুরো সময়টা ন্যাপের রাজনীতি স্টেপ-ইনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।’
জায়নাব যথার্থই দাবি করেছেন- পরিবারের সদস্য ক’জন ছাড়া তিনি বাদে অন্য কেউ মওলানাকে এত নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ পাননি। তিনি তার যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেই সাদামাটা বিবরণ ভাসানীর একটি নিরাভরণ চিত্র তুলে ধরে।
‘মানুষটি ছিলেন চলনে-বলনে, চেহারায় গড়নে একজন অতি সাদামাটা গ্রামবাংলার কৃষকের মতো। উচ্চতায় তিনি আমার চেয়ে লম্বা ছিলেন না, তাই বলতে পারি পাঁচ ফুটের বেশি নন। রোদে-পোড়া শ্যামলা রং, চওড়া কাঁধ, গাট্টাগোট্টা দেহ, বেশ শক্ত এক প্রৌঢ় মনে হতো তাকে। আমি যখন দেখি তখন নাকি তার বয়স নব্বই বছর- কিন্তু বার্ধক্য স্পর্শ করেনি তাকে তখনো (জায়নাব আখতার তেমন বেশি লিখেননি, কাগজে-কলমে ১৯৬৮-তে তার বয়স ৮৮ বছর)। বিশাল মুখভর্তি বুক পর্যন্ত নেমে আসা চাপদাড়ি আর মাথায় শোলার বা বাঁশের টুপি। সারাদিন পান খেতেন, তাই তার গেঞ্জি বা পাঞ্জাবিতে পানের ছিটের দাগ স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল, ধুলেও লাল দাগ উঠত না। কখনো মালপত্র নিয়ে আসতেন না। একটি গামছায় দুটি লুঙ্গি আর দুটি পাঞ্জাবি দলা করে বগলে নিয়ে চলে আসতেন, সব সময় ঘরে পরতেন লুঙ্গি আর গেঞ্জি, বাইরে যাওয়ার সময় পাঞ্জাবি। শীতের দিনে পাঞ্জাবির ওপর পরতেন একটি হাফ-হাতা সোয়েটার। এর বেশি কোনো পরিধেয় তার গায়ে আমি দেখিনি।’
১৯৭০-এ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাওয়ালপিন্ডি যাচ্ছেন মওলানা। দুই সঙ্গীর একজন দলের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান অন্যজন দলের সহ-সভাপতি এবং গৃহকর্তা এম এ জলিল। মেয়ে নিলুফার বাবার জন্য ধোয়া পাঞ্জাবি স্যুটকেসে ভরে দিয়ে ভাবলেন, মওলানা তো উপেক্ষিত রয়ে গেলেন, দ্রুত তার দুটি পাঞ্জাবি যখন লন্ড্রিতে পাঠাতে যাচ্ছেন মওলানা তখন আটকে দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন- ‘কেন? আবার ধোপা কেন? আমার জামা তোমার পছন্দ হচ্ছে না?’
এখানে থাকা অবস্থায় নিজের কাপড় মওলানা নিজেই ধুচ্ছেন দেখে স্টেপ-ইন-এ আগত একজন আত্মীয় তাকে যখন বললেন, হুজুর আপনি কেন কাপড় ধুচ্ছেন? চোখ পাকিয়ে তিনি জবাব দিলেন, ‘কেন, তাতে কি তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে?’ স্টেপ-ইন-এর কোনো খাটে তাকে শোয়ানো যায়নি, আড়াই ফুট প্রশস্ত যে চকিটি তিনি দখল করেছিলেন এর বাইরে তার আর কোনো প্রত্যাশা ছিল না। জায়নাবের কাছে তার আবদার ছিল সর্ষের তেল আর শুকনো মরিচ দিয়ে বেগুন পোড়া ভর্তা। গরম সর্ষের তেল পায়ে মালিশের একটুখানি আয়েশ, মালিশ করে ধন্য হওয়ার মতো সেবকের অভাব ছিল না সে বাড়িতে।
ভাসানী যখন স্টেপ-ইন-এ অবস্থান করতেন দর্শনার্থীর স্রোত লেগেই থাকত। রাজনীতির আর সরকারি চাকরির হোমড়া-চোমড়া, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পুলিশের গোয়েন্দা, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না। একদিন এক গুরুত্বপূর্ণ জনসভায় মওলানার থাকার কথা, কিন্তু তিনি স্টেপ-ইন-এ বসে আছেন, বেরোতে দেরি করছেন- অমনি সভাস্থলে রটে গেল পুলিশ তাকে ঘিরে রেখেছে, আসতে দিচ্ছে না। জায়নাব যা লিখেছেন তার মানে দাঁড়ায় মওলানা নিজেই এ ধরনের গুজব রটনার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেন- এটা রাজনৈতিক ট্যাকটিস।
কোনো কোনো সময় তাকে নিরিবিলি পাওয়া যেত খাবার টেবিলে। ছোটরা তার সঙ্গে মজা করতে পছন্দ করত। একদিন টেবিলে ইলিশ দেখে তিনি উচ্ছ¡সিত হয়ে জায়নাবকে বললেন, ‘আহা মা, তোমাদের দেশের মতো ইলিশ মাছ আর কোথাও নেই, কত দেশের মাছ খ্যালাম, ফরিদপুরের ইলিশের মতো সোয়াদ আর প্যালাম না।’
পুলিশের তাড়া খেয়ে তিনি একবার গোপন আস্তানা থেকে ছুটে বেরিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলে নাছোড় পুলিশও নদীতে নামল। ডুব-সাঁতার দিয়ে নদী পেরিয়ে ভর-সন্ধ্যায় ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় নদী-তীরের এক কুটিরে আশ্রয় নেন। ‘…সে বাড়ির বৌ যে ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত দিয়েছ্যাল ত্যামন আর কোনো দিন খ্যালাম না। আজো সেই ইলিশের সোয়াদ মুখে লেগে আছে।’
জায়নাবের বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেয়ে তাকে বললেন, পুলিশের তাড়া খাওয়ার কারণেই ইলিশটা বেশি সুস্বাদু মনে হয়েছে। শুনেই ভাসানী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি জাইনলে ক্যামন কইরে, পুলিশের তাড়া খ্যায়েছো কোনো দিন?’
সমাজতন্ত্রীদের আপ্তবাক্য ‘ধর্ম হচ্ছে আফিম’- ভাসানী কি তা মানেন? সরাসরি হ্যাঁ বা না-তে না গিয়ে বললেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ‘ক্ষমতালোভীরা ধর্মের ভয় দেখিয়ে মানুষের প্রতিবাদী চেতনাকে দাবিয়ে রাখে। তবে মানুষেরই জয় হয় শেষ পর্যন্ত।’ পরকাল প্রশ্নে তিনি বললেন বিজ্ঞানে প্রমাণ নেই, ‘মানুষের মতো অতুলনীয় সৃষ্টি আর সব জীবের মতো মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, এটা মেনে নেয়া যায় না।’
এই বাড়িতে যে ‘ইতনা মশহুর রেহনুমা’ আসা-যাওয়া করেন তা গুজরাটি ভাড়াটের স্ত্রী ঠাহরই করতে পারেননি, কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন সন্তানদের নিয়ে মওলানার সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন। মওলানা কথ্য উর্দুতে স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের সঙ্গে কথা বললেন, আশ্বস্ত করলেন তার আন্দোলন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে, কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়। তিনি বলেন, যদি এ দেশকে আপন ভেবে সৎ ব্যবসা চালিয়ে যাও, তবে বাঙালিরাও তোমাদের আপন করে নেবে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে আওয়ামী লীগের দলনেতা আমেনা বেগম। সেই দিনগুলোতে কেবল কমিউনিস্ট পার্টিরই সার্বক্ষণিক নারী কর্মী ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আমেনা বেগম। মওলানা ভাসানী যখন এ বাড়িতে থাকতেন আমেনা বেগম আসতেন বেশ ভোরে, যাতে তার সঙ্গে নিরিবিলিতে আলাপ করতে পারেন- তিনি ‘খুব আস্তে আস্তে তার হতাশা, উদ্বেগ বা কোনো অপমানের কথা বলতেন।’
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্মমভাবে নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হকের জানাজা পড়াতে মওলানা ভাসানীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমেনা বেগম নিজেই স্টেপ-ইন-এ এসেছেন। জায়নাব আফসোস করেছেন, না দল না দেশ- মনে রেখেছে এই অনুগত নারীকে। কৃষক সমাজের স্বার্থ রক্ষা করতে মওলানা শুরু করেন ঘেরাও আন্দোলন। ১৯৬৮-এর ডিসেম্বরে পাবনার ডিসি অফিস ঘেরাও করে তিনি নিজেই তার ঘেরাও কর্মসূচির সূচনা করেন। জায়নাবের মন্তব্য, ‘তিনি যে আগুন জ¦ালিয়ে দিলেন বাংলার গ্রামে সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’- এখন অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে, কিন্তু ষাটের দশকের ঘটনা প্রবাহের যারা চাক্ষুষ সাক্ষী তারা জানেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তখন কারাবন্দি, একমাত্র মওলানাই ছিলেন আপামর জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য অভিভাবক, দিকনির্দেশনা প্রদানকারী। শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করার আন্দোলনেও তিনি ছিলেন শীর্ষ নেতা। মওলানা যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাহিওয়ালে আক্রান্ত হন- তার গ্রহণযোগ্যতা সেখানেও বেড়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে ক্ষমতা ছাড়তে হলো ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ। সামরিক আইন জারি করে গদিনসীন হয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেন। রাজনীতি মুখরিত স্টেপ-ইন হঠাৎ নীরব হয়ে যায়। মওলানা চলে যান সন্তোষ।
মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির তখন কোনো স্থায়ী কার্যালয় ছিল না। সমাগম হতো ব্যারিস্টার শওকত আলী, সাইদুল হাসান এবং এম এ জলিল- জায়নাবের বাড়িতে। ১৯৭০ থেকে স্টেপ-ইন-ই পার্টি অফিস হিসেবে গণ্য করা হতে লাগল। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও তাই লিখতে শুরু করলেন, কিন্তু তা জায়নাব চাচ্ছিলেন না। অবশ্য মেনে নিয়েছেন, ঠেকাবারও উপায় নেই। যেখানে মওলানা ভাসানী সেখানেই তার অফিস।
স্বামীর সূত্রে এবং নিজস্ব বিবেচনায় জায়নাব মওলানার একই সঙ্গে ভক্ত ও সমালোচকও। ১৯৭০-এর নির্বাচনপূর্ব সময়টাকে ভাসানীর দুর্জ্ঞেয় আচরণ নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব কী ভাবতেন জানি না, কিন্তু সাঙ্গোপাঙ্গরা মনে করত ভাসানী পাকিস্তানপন্থি আবার কেউ কেউ সরাসরি আর্মির দালাল বলতেও দ্বিধা করত না। মুজিবের চ্যালারা কেন, ন্যাপের দলত্যাগীরা নানা ধরনের অপবাদ দিতে কুণ্ঠিত হয়নি ওই সময়।’
ভাসানী প্রসঙ্গ লিখতে গিয়ে তার পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কিছু দুর্লভ অন্তরঙ্গ তথ্য তুলে এনেছেন- স্টেপ-ইন-এর বৈঠকখানায় বেতের সোফায় যাদু মিয়া এবং এম এ জলিল কাঁদছেন। যাদু মিয়া মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যেন সন্তান হারানোর বেদনায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন, আর তা আবেগাক্রান্ত করেছে জলিলকেও। আবার সত্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে ইয়াহিয়া কেমন করে যাদু মিয়ার গাল টিপে বলেছেন ‘হ্যালো যাদু’- সে বর্ণনাও এসেছে। আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ও ছয় দফা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার হুমকি কিনা জানতে চাইলে মওলানা চোস্ত উর্দুতে যা বললেন তার সারমর্ম : “আরে সদর সাব, অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্ন কিসের? আমরা হলাম এক দল, এক আত্মা, এক দেশ। আরে, প্রথমেই তো ষড়যন্ত্র করে লাহোর প্রস্তাবে ‘টু স্টেটস’ দুইটা রাষ্ট্র লিখে রেখেছিল। আমাদের আলাদা দুই দেশ বলেছিল, কিন্তু দেখো আমরা সেই উদ্দেশ্য ভণ্ডুল করে গত ২৪ বছর এক দেশ, এক ঘর, এক মোকামে আছি। আলাদা করার চেষ্টা তো সেই কবেই নস্যাৎ হয়ে গেছে। তদুপরি তোমার দেয়া ছক এলএফও (লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার)- তার মধ্যেই তো ইলেকশন করতে রাজি সবাই।’ তারপর কিছু নাটকীয় ডায়লগ- মুজিব প্রধানমন্ত্রী হবেন, ইয়াহিয়াকেইতো প্রেসিডেন্ট থাকতে অনুরোধ জানানো হবে। ‘যথেষ্ট পানের পিক ইয়াহিয়ার লেবাসে ছিটিয়ে গলা ফাটিয়ে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন মওলানা।’
এই দৃশ্য সরাসরি জায়নাবের দেখার কথা নয়, পিন্ডি সফরকারীদের মুখে যা শুনেছেন তার ওপর ভিত্তি করেই লিখেছেন। বিতর্কিত সেই সফরের পর সংবাদপত্র মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে সরাসরি দালালির অভিযোগ আনলেও তার আঁচ মওলানাকেও স্পর্শ না করে ছাড়ল না।
সত্তরের অক্টোবরের শুরুতেই স্টেপ-ইন-এ ন্যাপের নৈশভোজ, ঘরোয়া বৈঠক। ২ অক্টোবর বাড়িটি ঘেরাও হয়ে গেল। এবার পুলিশ নয়, ‘সংগ্রামী ছাত্র-জনতা’। তাদের সেøাগান ‘স্বাধীনতার বিকল্প মানি না, মানব না’, ‘প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বেরিয়ে আসুন, বেরিয়ে আসুন’, ‘আনোয়ার ছোটি, মশিউর- হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার’ এবং অশ্রাব্য আরো কটুকাটব্য। (আনোয়ার-আনোয়ার জাহিদ, ছোটি-নুরুল হুদা কাদের বকশ, মশিউর-মশিউর রহমান যাদু মিয়া) ‘রক্ত চাই’, ‘কল্লা চাই’, ‘রেহাই নাই’। তারা বাড়ির বিদ্যুৎ, টেলিফোন লাইন কেটে দিল। বাড়িতে সবাই ক্ষুধার্ত, বাজারে যাওয়ার পথ বন্ধ। এক সময় পাঠান নেত্রী কানিজ ফাতেমা, মশিউর রহমান, এম এ জলিল ও মওলানা নিজে বিপ্লবী ঘেরাওকারীদের মুখোমুখি হলেন। নব্বই বছর বয়সি মওলানার অবিশ্রান্ত বক্তব্য, যার সার-সংক্ষেপ করা মুশকিল, শুনে তারা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হলো- এই প্রথম স্টেপ-ইন থেকে না খেয়ে চলে গেলেন দেশি-বিদেশি মেহমান।
সত্তরের নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া নিজেদের মধ্যে বিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়াল। মওলানা নির্বাচনে যাবেন না। দলীয় সিদ্ধান্তে নয়, ব্যক্তিগত বিবেচনায় নির্বাচনে অংশ নিলেন বেশ ক’জন : গোলাম রহমান, নুরুল হুদা কাদের বকশ, ইয়াকুব আলী, মাহফুজ আলী, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুজিবুর রহমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার আবদুল হক, আসগর আলী, ড. আহাদ আলী খান, আবদুল জব্বার, শেখ আমজাদ আলী, শামসুল হক, আবদুল করিম, শরাফুদ্দিন হোসেন, অ্যাডভোকেট আবদুল হক, ডাক্তার ফরিদুল হুদা, আবদুর রহমান, আরিফুর রহমান, সুধারানী, জয়নুল আবেদীন পাটোয়ারী। নির্বাচনের মহাজোয়ার তখন আওয়ামী লীগের পক্ষে, অধিকাংশেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হলো।
১৬২ জাতীয় পরিষদ আসনের মধ্যে মাত্র দুটি হাতছাড়া হলো আওয়ামী লীগের- নান্দাইলের আসন পেলেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নুরুল আমীন আর পার্বত্য চট্টগ্রাম আসন পেলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায়।
একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের মোচড় এবং পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক বাস্তবিকই চীনপন্থি ন্যাপকে বেকায়দায় ফেলে দিল। ভাসানী চৌ এন লাইকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সায় দেয়ার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখলেন। লাভ হলো না।
কিন্তু একাত্তরে কলকাতায় মওলানা কেমন ছিলেন?
স্টেপ-ইন-এ আসা তার নিজের হাতে লেখা চিঠিই বলে দেয় সে কথা- ‘আমি মুক্ত নহি, কড়া পাহারায় থাকি’।
একাত্তরের কলকাতা যেমন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে ঠাঁই দিয়েছে, শরণার্থীদের লালন করেছে, জীবনবাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষিত করেছে, তেমনি লালন করেছে আয়েশী জীবনযাপন করা কিছু নেতাকেও, বন্দি রেখেছে মওলানার মতো একজন স্বাধীনতার প্রবক্তাকেও। ভারতের পক্ষে একটি তরতাজা যুক্তি তো ছিলই, ভারতের শত্রæদেশ চীনের বন্ধু তো আর ভারতের বন্ধু হতে পারে না।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়