আইনমন্ত্রী : জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ৬৪৮ এমপির কথা বলা হচ্ছে

আগের সংবাদ

উপজেলা নির্বাচনের আগেই বিবাদ মেটাতে চায় আ.লীগ : ভোটের কোন্দল

পরের সংবাদ

টার্গেট যখন স্মার্ট এডুকেশন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সদ্য গঠিত নতুন সরকারের নতুন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বঙ্গভবনে গত ১১ জানুয়ারি মিডিয়াতে প্রথমবারের মতো প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, তার প্রথম লক্ষ্য স্মার্ট এডুকেশন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এরপর রাতে বনানীর বাসায় মিডিয়াকে বলেছেন, ‘আগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করব।’ এজন্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পথ চলতে চান। তার এ অনুভূতির প্রতি বিশ্বাস আছে, শ্রদ্ধাও আছে। সে বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা থেকে স্মার্ট এডুকেশন নিয়ে নিজস্ব ভাবনাটুকু ব্যক্ত করছি। তিনি নতুন কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োজনে পরিবর্তন হতে পারে বলে জানিয়েছেন, এমন খবরও পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষা এ দেশে এখন পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত জানুয়ারির প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার মতো যুগান্তকারী ঘটনা ঘটালেও অভিভাবকরা গাইড সংস্কৃতি পরিহার করতে পারেননি। নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে বৃত্তির ব্যবস্থা করলেও কোচিং বাণিজ্যের ফাঁদ থেকে মুক্তি লাভ করেনি। ফলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। একমুখী শিক্ষার প্রবর্তন হয়নি। ইংলিশ মিডিয়ামের দৌরাত্ম্য থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করতে পারেনি। এর সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা। এতগুলো না’র ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ৫০ বছর অতিক্রম করে ফেলেছে। ফলে নতুন নতুন কারিকুলাম প্রণয়ণ করেও কোনো সুফল আনা যাচ্ছে না। যদিও কারিকুলাম কখনো অবিলম্বে সুফল দেখাতে পারে না। তবুও অদূর ভবিষ্যতে কোনো সুফল দেখাতে পারবে তারও কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কারিকুলাম কখনো এককভাবে কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না। এজন্য প্রথমে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে আমাদের শিক্ষক মহোদয়দের। প্রথমেই তাদের আত্মস্থ করতে পরিবর্তিত কারিকুলাম। তাদের বুঝতে হবে, জানতে কেন এ পরিবর্তন। একই সঙ্গে তাদের এ উদ্দেশ্যের সঙ্গে তাদের আন্তরিকভাবে ঐকমত্য পোষণ করতে হবে। কারণ কারিকুলাম এমনকি পাঠ্যবই অভিভাবকরা পড়েন না। পড়েন শিক্ষকরা। যেমন বর্তমান কারিকুলাম সম্পর্কে দুটি সমালোচনা আছে। একটি হলো নতুন কারিকুলামের আলোকে বইতে কোনো কিছু পড়ার মতো নেই। কোনো পরীক্ষা নেই। যেহেতু পড়া নেই, পরীক্ষা নেই। সুতরাং শিক্ষার্থীরা পড়বে কেন? তখন অভিভাবক-সমাজ উদ্বিগ্ন হয়ে হৈচৈ শুরু করে দিল। এটা যে সত্যি না, এটা যে গুজব- তা প্রতিষ্ঠিত করা গেল না। আর এ ধরনের গুজব ছড়ানোর জন্য ফেসবুক যেমন আছে, তেমনি একদল দুষ্ট লোকও আছে। গত ডিসেম্বরে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে গিয়ে শুনলাম, বিদ্যালয়ে কোনো এক পাঠের অংশ হিসেবে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সকালবেলার নাস্তা তৈরি করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে বলেছেন। বিষয়টা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় ওই এলাকায়। প্রচার করা হয় স্কুলে এখন ডিম ভাজা শেখানো হয়। তারপর এটা ট্রল হয়ে যায়। গুজব যখন ক্রমাগত ট্রল হতে থাকে, তখন তা একসময় সত্যে পরিণত হয়। বর্তমান সময়ে নতুন কারিকুলাম নিয়ে এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলেছে। এ হলো বর্তমানের পরিস্থিতি। এর ওপর ভিত্তি করে কারিকুলামে পরিবর্তন এনে পূর্বেও গতানুগতিক ধারায় ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। পরিবর্তন করতে হবে, যিনি শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করবেন, অর্থাৎ শিক্ষকদের মন-মানসিকতা। কারণ এসব শিক্ষকই তো গতানুগতিক ধারায় শিক্ষালাভ করেছেন ইতোপূর্বে। আবার এসব শিক্ষককে যারা প্রশিক্ষণ দেন নতুন কারিকুলাম বিষয়ে তাদের মন-মানসিকতারও আধুনিকায়ন ও হালনাগাদ করা দরকার। এর মানে দাঁড়ায় কারিকুলামের আলোকে পাঠ্য উপকরণ প্রণয়ন করলে হবে না। উপকরণ ব্যবহারের জন্য যারা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন প্রথমে তাদের পরিবর্তনের ধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারপর শিক্ষকদের। বিষয়টা খুব সহজ না। বয়স্ক সাক্ষরতা একটি কঠিন কাজ।
দিনের পর দিন কারিকুলাম বা মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে না। বহুল আলোচিত বর্তমান কারিকুলামকে বিশ্লেষণ করলে দেখব, কারিকুলাম যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সময়ের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এমন কারিকুলাম গ্রহণযোগ্য হতেই পারে। অনেক উন্নত দেশে এমন কারিকুলাম অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পাঠ্য উপকরণ উন্নয়নের সময়ে এই কারিকুলামকে লেখকরা কতটুকু বিবেচনায় নিয়েছিলেন বা আদৌ নিয়েছিলেন কিনা। কারণ এমন ধরনের অভিযোগ ইতিপূর্বে উঠেছিল। আবার শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার সময়ে শিক্ষক কতটুকু কারিকুলাম অনুসরণ করছেন। প্রশ্ন বা সন্দেহ থেকে যায়, শিক্ষক আদৌ কারিকুলাম দেখেছেন কিনা? অতীত এমনই সাক্ষ্য দেয়। তাহলে স্মার্ট এডুকেশন হবে কী করে?
স্মার্ট এডুকেশনের কথা ভাবতে গেলে এডুকেশনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিকে বিবেচনায় নিতে হবে। শিক্ষাবিষয়ক যত আলোচনা শুনেছি, পড়েছি, সব সময় খেয়াল করেছি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর বেতন-ভাতা সুবিধাদি নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। প্যাডাগোজিক্যাল আলোচনা থাকে অনেকাংশে কম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা যখন আসেন, তখন এসব নিয়ে মতামত প্রদান করেন বেশি মাত্রায়। তখনই মন বলে, ডালমে কুচ কালা হায়! শিক্ষাক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে স্মার্ট এডুকেশন প্রদান সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে যত স্মার্ট কারিকুলাম প্রণয়ন হোক না কেন, স্মার্ট এডুকেশন সম্ভবপর হবে না।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে স্মার্ট এডুকেশন ব্যবস্থার উপায় জানা যাবে। বঙ্গবন্ধু একমাত্র বাঙালি রাজনীতিবিদ, যিনি দর্শকের ওপর ভিত্তি করে রাজনীতিকে পরিচালনা করতে চেয়েছেন। তার দর্শনের আলোকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। তিনি যখনই কথা বলেছেন, তখনই সবার মধ্যে একটু ভাবনার, নতুন করে চিন্তার খোড়াক জুগিয়েছেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে প্রদত্ত বেতার-টেলিভিশন ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। … জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। … ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবতৈনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটা ‘ক্রাশ’ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সব শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।” বঙ্গবন্ধুর এসব কথার কথা হিসেবে থাকেনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রথম স্বাধীনতা দিবসের দিনে (১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ) জাতীয়করণ নীতি ঘোষণা উপলক্ষে বেতার-টেলিভিশনে ‘শিক্ষা কমিশন’ গঠনের কথা বলতে ভুল করেননি। এ কমিশনকে দিকনিদের্শনা প্রদানের সময়ে যেসব কথা বলেন, তা তার অতীতের বক্তব্যের ধারাবাহিকতার প্রতিফলন। এর মানে দাঁড়ায় তিনি হঠাৎ করে এসব কথা বলেননি। এসব কিছু তার দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক শিক্ষা চিন্তায় শুধু শিক্ষার ভবিষ্যৎ কাঠামো ও কারিকুলামই স্থান পায়নি, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে জীবনঘনিষ্ঠ, উৎপাদনমুখী ও পেশাসংশ্লিষ্ট মানব উন্নয়নমূলক বিষয়গুলোকেও বিবেচনার কথা বলেছেন। তাই কুদরাত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশনে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ছিল। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে শিক্ষাবিষয়ক পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর দর্শনে একটি বড় অংশজুড়ে আছে মোটিভেশন। যা আজকের দিনে নেই বললে চলে। বিবেককে জাগ্রত করার উদ্যোগ থাকতে হবে শিখন শেখানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে। জাতীয় সংসদের ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বিবেককে জাগ্রত করার অনেক মোটিভেশনাল কথা বলেছেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘… যারা লেখাপড়া শিখছেন, তাদের খরচের একটা অংশ দেয় কে? আমার বাপ-দাদা নয়, দেয় বাংলার দুঃখী জনগণ। কি আমি তাদের ফেরত দিয়েছি? তাদের আমি রিপে (জরঢ়ধু) করেছি কতটুকু। তাদের প্রতি কতটুকু কর্তব্য পালন করেছি, এটা আজকে আমাদের সমালোচনা প্রয়োজন আছে।’ এমন করে কি আমাদের পাঠ্য উপকরণে বিবেককে জাগ্রত করার মতো কোনো মোটিভেশনাল বক্তব্য আছে? কোনো উদহারণও নেই। তাহলে কি করে আমাদের নবীন প্রজন্ম স্বপ্ন দেখবে। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে।
স্মার্ট এডুকেশন প্রতিষ্ঠা হবে কী করে? স্মার্ট এডুকেশন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বঙ্গবন্ধুর দর্শন তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির আলোকে শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে জাতীয়করণ করে পণ্যে পরিণত করার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সে বিনিয়োগ হতে হবে প্যাডাগোজিক্যাল উন্নয়ন বা গবেষণার জন্য। জাতিগত দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে। গুজবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।

কুমার প্রীতীশ বল : কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়