ভোটের মাঠে ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের জয়জয়কার

আগের সংবাদ

কেমন হবে ‘স্মার্ট’ মন্ত্রিসভা

পরের সংবাদ

গাজায় প্রলম্বিত যুদ্ধ এবং ব্রিটেন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রাক্তন কনজারভেটিভ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেন ওয়ালেসের একটা লেখা প্রধান দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যকে কিছুটা দ্ব›েদ্ব ফেলে দিয়েছিল। তিনি গত মাসে ডেইলি টেলিগ্রাফের একটি নিবন্ধে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল বেআইনি এবং অনৈতিকভাবে কাজ করছে এবং ইজরায়েল-ফিলিস্তিন দ্ব›দ্ব-সংঘাতে আরো ৫০ বছর ইন্ধন জোগাতে সক্রিয় হয়েই থাকবে। কিন্তু ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ নিয়ে ওয়েস্টমিনস্টারে প্রধান দুটো দলের অর্থাৎ ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ ও লেবার দলের মাঝে দুটি বিষয়ের ঐকমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে- প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো বার্তাকে প্রাধান্য দিয়ে ইয়েমেনে হুথি গ্রুপের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা যোগ দিতে প্রস্তুত এবং ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের বিবৃতি অনুযায়ী গাজায় যুদ্ধ শেষ হতে কয়েক মাস বা এমনকি পুরো এক বছরও সময় লাগার সম্ভাবনা।
এ নিয়ে সরাসরি ব্রিটিশ সামরিক সম্পৃক্ততা একটি বিতর্কের জন্ম দিতে পারে যদিও এখন পর্যন্ত ওয়েস্টমিনস্টারে আলোচনায় আসেনি। লোহিত সাগরে নৌচলাচলের স্বাধীনতা রক্ষায় মার্কিন সামরিক জোটের একটা দেশ যুক্তরাজ্য। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থার একটা প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিষয়টি স্পষ্ট যে, বাণিজ্যিক শিপিং রক্ষার জন্য বহুজাতিক কনভয় মোতায়েন করলেও হুথিদের ছোড়া ড্রোনগুলোকে গুলি করে ধ্বংস করার কার্যকরিতা তাদের সীমিত। আর তাই ক্রমবর্ধমান জুজুর ভয় কিংবা হুমকির সমাধান এ দিয়ে প্রতিরোধ করাও যাচ্ছে না। এর বিপরীতে সত্যতা হলো যে, সৌদি বিমান হামলার মুখে হুথিরা সহনশীলতা দেখিয়েছে, তবে এই গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করা ইরান এতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা-ও বড় অজানা।
এমনকি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যামেরুনের হুঁশিয়ারিকেও ইরান খুব একটা গুরুত্বের চোখে দেখছে না, বরং যুক্তরাজ্যের হস্তক্ষেপকে নিন্দা করে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করার অধিকার তাদের আছে। ইতোমধ্যে হুথিরা নিজেরাই তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে যতক্ষণ না ‘গাজায় পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহের অনুমতি না দেয়া হয়’।
আর সেজন্যই প্রশ্ন জাগে যে, গাজার অভ্যন্তরে ইসরায়েলের আক্রমণ কতদিন চলতে পারে এবং জাতিসংঘের ভাষায় ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে অপর্যাপ্ত’ এই অঞ্চলে সহায়তা বাড়ানোর জন্য কিছু করা যায় কিনা। যদিও জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের দূত বারবারা উডওয়ার্ড গত ২৯ ডিসেম্বর বলেছেন, ‘এই মানবিক বিপর্যয় বন্ধ করার’ পদক্ষেপ না নিলে আক্রমণ, রোগ এবং দুর্ভিক্ষের কারণে আরো অনেক ফিলিস্তিনি মারা যাবে, তবে তিনি এই পদক্ষেপটি কী হবে তা উল্লেখ করেননি।
শুধু তাই নয়, দেখা যাচ্ছে ইসরায়েলের যুদ্ধ ইস্যুতে লেবার পার্টি এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য সরকারের নীতির সঙ্গে অনেকাংশে একমত হয়েছে, যার ফলে দলের লিডার কিয়ার স্টারমার হোয়াইট হাউসের গুডবুকে স্থান করে নিচ্ছেন, যে কথাটি ব্রিটিশ গণমাধ্যমও (দি গার্ডিয়ান) উল্লেখ করেছে একটা রিপোর্টে। অথচ যুক্তরাজ্যের নির্বাচন হয় সম্পূর্ণভাবে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। ভোটাররাই নির্ধারণ করে নির্বাচনে কাকে ভোট দেবে। বাসায় বাসায় লিফলেট বিতরণ আর গণমাধ্যমগুলোতে দলগুলোর কিংবা প্রার্থীর পারফরম্যান্সের ওপরই মানুষ নির্ধারণ করে তাদের জনপ্রতিনিধি। নির্বাচন হওয়ার পর সরকার নির্ধারণ করে তার পররাষ্ট্রনীতি কিংবা দেশীয় নীতি। প্রতিটি সরকারই জনগণের আবেগ-আকাক্সক্ষা উপলব্ধি করে তাদের বিশেষত জাতীয় পরিকল্পনাগুলো তৈরি করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা জনগণকে শতভাগ সন্তুষ্টি দিতে পারে না। তাই সরকার পরিবর্তনও হয়।
এ হিসেবে ২০২৪-এর নির্বাচনে লেবার পার্টির সরকার গঠনের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। গত কনজারভেটিভ সরকারের আমল বেশ কিছু জটিল সময় পাড়ি দিয়েছে। করোনা সারা বিশ্বের মতোই ব্রিটেনকেও অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা হলেও ধাক্কা দিয়েছে। ব্রেক্সিট ছিল আরেকটা বড় ধরনের ঝুলন্ত সময়। আর তাই বারবার তাদের লিডার পরিবর্তন হয়েছে, প্রধানমন্ত্রিত্বে পরিবর্তন এসেছে, এসেছে নতুন নতুন পরিকল্পনা। সে জন্যই এবারে এক ধরনের অপরিহার্যতা ছিল সরকার পরিবর্তন। আন্তর্জাতিকভাবে আমেরিকার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের জড়িয়ে নেয়াতে ব্রিটিশ জনগণের সহানুভূতি পেলেও পরবর্তীতে তা আর থাকেনি, কারণ জনগণ বুঝেই নিয়েছে এ এক নোংরা খেলা। সে জন্য মিডিয়ায়ও জেলোনস্কি এখন বলতে গেলে অনুচ্চারিত। এদিকে গাজায় ইসরায়েল আগ্রাসনকে শুধু মুসলিম কমিউনিটিই নয়, গোটা ব্রিটেনের জনগণই মানবিক হিসেবে বিবেচনায় নিচ্ছে না। যুদ্ধবিরোধী একটা অবস্থানেই আছে ব্রিটেন। স্বাভাবিকভাবেই সরকার এ নিয়েও আছে গ্যাঁড়াকলে- যুদ্ধের সঙ্গে কাঁধমেলানো অবস্থায়ই আছে সরকার। কিন্তু এই জায়গায় লেবার পার্টি এমনকি তাদের দলের ভোটব্যাংক (অভিবাসী) হিসেবে পরিচিত একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে এড়িয়ে গিয়ে সরকারের সঙ্গেই কণ্ঠ মিলাচ্ছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমেরিকাকে সন্তুষ্ট করতে চাচ্ছে। অথচ ব্রিটেনের নির্বাচনে কোনো দেশের প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ নেই। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে দলটির লিডার স্টারমার আসলেই কি লেবার দলের মাঠকর্মীদের স্পন্দন বুঝতে পারেন? কারণ ইতোমধ্যে তার দলেরই শতাধিক এমপি-কাউন্সিলর তথা জনিপ্রতিনিধি বিভিন্ন পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন স্টারমারের ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষ অবলম্বন করায়।
কিয়ার স্টারমার গত ৩১ অক্টোবর একটি বক্তৃতায় তার ভাবনা তুলে ধরেন যখন তিনি বলেছিলেন যে হামাসকে নির্মূল করার চেষ্টা করা ইসরায়েলের পক্ষে বৈধ এবং তিনি ‘আপাতত’ যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করেছিলেন কারণ হামাস এখনো ৭ অক্টোবরের মতো আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেন। ইসরায়েল নিয়ে দলের মাঝে একটি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ সত্ত্বেও, গাজায় মৃতের সংখ্যা এবং ধ্বংসের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও দলীয়ভাবে এ গ্রুপ (যুদ্ধবিরোধী) এখনো শক্তিশালী নয়। আর সে জন্যই লেবার দল সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এখনো পরিবর্তিত হতে পারেনি। লেবারের কৌশলগত অবস্থান হলো ওয়াশিংটনকে আশ্বস্ত করা যে, সরকারে থাকা লেবার পার্টিও ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের দায়িত্বশীল সহযোগী হবে, যা নির্বাচনের আগে প্রমাণ দেয়ার প্রয়োজন ছিল না জনসমক্ষে। সত্যি কথা হলো লেবার দলকে ভোট দিতে এবার অনেকেই দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব থাকবে এবং এভাবে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন পার্টিতে না এলে দলের সাধারণ মানুষ বিকল্প পার্টিকে তাদের দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবেই নিতে পারে। এতে করে কনজারভেটিভ পার্টিই রাজনৈতিকভাবে ভালো অবস্থানে থাকবে এবং লেবার দলীয় এমপির সংখ্যা হ্রাস পেয়ে অন্য দল ভারি হবে হয়তো; কিন্তু সরকার গঠনে এগিয়েই থাকবে কনজারভেটিভ পার্টি।
ইসরায়েলের আগ্রাসনে গাজায় ২২ হাজারেরও অধিক মানুষের নির্মম নিহত হওয়া কিংবা অগণন শিশুদের পিতা-মাতাহীন হওয়াকে এ বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ মেনে নিতে পারছে না, মেনে নিতে পারবে না হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের প্রলম্বিত করার অন্ধকার ধূমায়িত আকাশ। এই না মেনে নেয়ার মধ্য দিয়েই পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এগোচ্ছে ব্রিটেনও। স্বাভাবিকভাবেই তাই এ বছরের নির্বাচনে উঠে আসবে ব্রিটেনের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার চিত্র। হয়তো লেবার পার্টিও নতুনভাবে ভাবনায় নেবে, পার্টির সাবেক লিডার মানবতাবাদী জেরেমি করবিন কিংবা তার মতো কেউই কি হবেন লেবার পার্টির শেষ আশ্রয়স্থল।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়