আইজিপি : নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন

আগের সংবাদ

সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের বিজয় > সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য বিনিময় : ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলাই এখন লক্ষ্য

পরের সংবাদ

এবার অর্থনীতির সংস্কারে মনোযোগ দিন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ডলার-সংকটের পাশাপাশি দেশের ব্যাংকগুলো এখন টাকার সংকটেও ভুগছে। ফলে ব্যাংকগুলো যে হারে টাকা ধার করে, সেই হার দ্রুত বাড়ছে। অনেক ব্যাংককে উচ্চ সুদে আমানতও সংগ্রহ করতে হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার ও খাতবিশেষজ্ঞরা তারল্যের এই সংকটের জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করছেন। এগুলো হলো বারবার ছাড় ও সুবিধা দেয়ার কারণে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়া, সরকারের উচ্চ সুদে টাকা ধার নেয়া ও বেশি দামে ডলার সংগ্রহ। তারল্যসংকট মোকাবিলায় এখন ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করতে হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আদায় কম, তাই তারা ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে খরচ কমিয়ে আনতে হবে, নতুন প্রকল্প নেয়া বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর শেষে ঋণ পরিশোধে আবার ছাড় মিলবে- এমন প্রত্যাশায় অনেক ব্যবসায়ী গ্রাহক ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত না দিয়ে অপেক্ষা করেছেন। পাশাপাশি সরকার উচ্চ সুদে বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করায় ব্যাংকগুলো আমানত পেতে সমস্যায় পড়েছে। অন্যদিকে ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। দুই বছর আগে যে ডলার কিনতে ৮৫ টাকা খরচ হতো, তার আনুষ্ঠানিক দরই এখন ১১০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে ১২৩ টাকাও খরচ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের থেকে পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নানা আর্থিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে। এসব ধার ১, ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি। ভালো হিসেবে পরিচিত অনেক ব্যাংকও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা নগদ জমা হিসাবের (সিআরআর) ঘাটতি পূরণে টাকার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই দ্বারস্থ হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আদায় কম, তাই তারা ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে খরচ কমিয়ে আনতে হবে, নতুন প্রকল্প নেয়া বন্ধ করতে হবে। সরকারি প্রকল্পগুলো যেন টাকা বানানোর যন্ত্র। আছে বিপুল অপচয়ও। এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার আমানতের সুদহারের চেয়ে কম রাখতে হবে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোটা ভুল নীতি ছিল। খেলাপিদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়ার মতো ভুল নীতি আর নেয়া যাবে না। এসব করলেই তারল্য পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে। ঋণ ও আমানতের নিয়ন্ত্রিত সুদহারের ব্যবস্থা তুলে এ খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এরপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে সুদহার নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালু করে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদ ৬ শতাংশ- বহুল সমালোচিত এই ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে স্মার্ট সুদহার হিসেবে পরিচিত নতুন পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারল্য সংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলোর একটি বড় অংশই এখন আমানতের ওপর ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। সংকটে পড়ে কোনো কোনো ব্যাংক এমনকি ১২ শতাংশ সুদেও তহবিল সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে। আমানতের ওপর সুদের হার বাড়ার কারণে ঘরে রাখা টাকা ব্যাংকে ফেরানোর প্রবণতা বেড়েছে। তবে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। ফলে ব্যাংকে টাকার সংকট চলছেই।
দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করা প্রয়োজন। কষ্টদায়ক হলেও সংস্কার করতে হবে। তাতে অর্থনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্য আসবে। প্রথমত, ব্যাংক খাতে সুশাসন ও রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন ব্যাংক কোম্পানি ও আয়কর আইনের বাস্তবায়ন জরুরি। এই দুই আইনের যথাযথভাবে বাস্তবায়নে কিছু মানুষ হয়তো চাপে পড়বেন। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনীতিবিদের সদিচ্ছা লাগবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের দাম বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। হয়তো নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। ডলারের দামে বড় ধরনের সমন্বয় করলে পণ্য আমদানির ব্যয় বাড়বে। তখন আমদানি শুল্ক কমানোর মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও ডলারের দাম বাড়লে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিতে হবে না। ব্যাংক-মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসার হারও বাড়বে। তৃতীয়ত, ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, ডলার-সংকট, মূল্যস্ফীতি, ভূরাজনীতি, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন শ্রমনীতির অধীনে নিষেধাজ্ঞা আসার শঙ্কা আছে কিনা, বাণিজ্যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসবে কি আসবে না; এলে কোন পদ্ধতিতে আসবে- সেটি অনুমান করা কঠিন। তবে আমরা দেখেছি, শ্রম অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশকিছু প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বলতে চাই, আমাদের যেসব জায়গায় উন্নতি করার প্রয়োজন আছে, সেগুলো যেন আমরা করি। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সেগুলো আমরা করতে পারি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন তিনটি মূল চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে মূল্যস্ফীতি। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি আর্থিক খাতের দুর্বলতাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তবে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার, যেখানে কার্যকর মুদ্রানীতি ও বাজারভিত্তিক ডলারের মূল্য নির্ধারণ অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে। আর রাজস্ব বৃদ্ধিও সমস্যার উত্তরণে বড় ভূমিকা রাখবে। জ্বালানির উচ্চমূল্য, দুর্বল মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, পণ্যের সরবরাহ সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। একই সঙ্গে মজুরি না বাড়ায় মানুষের ভোগব্যয় কমছে- যা জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ অন্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। বরং ব্যাংকের ঋণখেলাপি, পুনঃতফসিল ও ঋণ অবলোপন বাড়ছে- যা ব্যালান্স অব পেমেন্টে চাপ তৈরি করছে। রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভও কমেছে। সরকারের আমদানি নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপে কর আহরণও দুর্বল হয়েছে। এমনিতেই রাজস্ব আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে আসায় সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা বেড়েছে। এতে আয় না বাড়লেও সরকারের ঋণ বেড়েই চলেছে। আবার দারিদ্র্য কমলেও বাড়ছে বৈষম্য। এমতাবস্থায় কাঠামোগত সংস্কারে কিছু পদক্ষেপের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংস্কার এখন মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশে বিদ্যমান সমস্যার কারণে, নাকি বৈশ্বিক কারণে এমন প্রশ্নও রয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব সব দেশেই বিদ্যমান থাকে। কিন্তু সে পরিস্থিতির সঙ্গে দেশীয় পলিসি অ্যাডজাস্ট করে সমস্যার সমাধান করতে হয়।
বাংলাদেশে কিছু সংস্কার কাজ হয়েছে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার হচ্ছে, কিন্তু আরো করতে হবে। আগামীর পরিবেশ অর্থাৎ নির্বাচনের পরের পরিবেশ যদি ভালো থাকে, তাহলে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার টানা চতুর্থবারের মতো মোট পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হতে যাচ্ছে। আগামী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলে নিশ্চয়ই নতুনত্ব আনতে সচেষ্ট হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট এবং অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে তিনি অবশ্যই ওয়াকিবহাল। বেশকিছু ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি হয়ে উঠেছে, এটা তিনি উপলব্ধি করেছেন আরো আগেই। হয়তো এতদিনে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়ে যেত। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন এসে যাওয়ায় সেটা শুরু করা সম্ভব হয়নি। এবার তিনি আগের ত্রæটি-বিচ্যুতিগুলো যথাসম্ভব দূর করে একটি সুস্থ সুন্দর সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আমরা অতীতে দেখেছি, তিনি দেশের স্বার্থে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হননি কখনো। এবারো নিশ্চয়ই তিনি আমাদের অর্থনীতির সংস্কারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়