ভরা মৌসুমেও চড়া সবজির বাজার

আগের সংবাদ

ভোটের কৌশলে সফল শেখ হাসিনা : জাতীয় সংসদ নির্বাচন

পরের সংবাদ

বাংলাদেশসহ আধাবিশ্বে ভোট ২৭ দেশে যুদ্ধ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কখনো কখনো ক্রান্তিলগ্নে নির্বাচনী যুদ্ধ আর সামরিক যুদ্ধে তেমন তফাৎ থাকে না। দুটোর যে কোনোটিতেই দেশের ক্ষমতার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে জার্মানি ও ইতালিতে ফ্যাসিস্ট সরকার এবং জাপানি সাম্রাজ্যবাদী সরকারের পতন হয়েছিল। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন-সোভিয়েত দুই পরাশক্তির মাধ্যমে অনেক দেশে কেবল সরকার বদলই হয়নি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আদর্শের বিলুপ্তিও ঘটে। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থানে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যখন ময়দানে যুদ্ধ চলছে বিশ্বের অন্তত ২৭টি দেশে। আর এ বছর নির্বাচন হচ্ছে বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশে।
সংঘাত অনিবার্য জেনেও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো এখন সমরাস্ত্র বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় রয়েছে। রুশ-ইউক্রেন, ফিলিস্তিনে ইসরাইল-হামাসের মতো গোলাবারুদে মুখোমুখি না হলেও স্নায়ুযুদ্ধ চলছে দেশে-দেশে, মহাদেশে-মহাদেশে। তা এশিয়াজুড়েও। ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় বিশ্বকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। এর ছিটেফোঁটা এশিয়ায় উদারনীতি ও স্বৈরতন্ত্র নিয়েও। এখানেও হাতছানি পশ্চিমাদের। সরাসরি লড়াই যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে। এর শিকড় কয়েক দশক পেছনে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে। ১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয় যুক্তরাষ্ট্রকে একটি এশীয় পরাশক্তিতে পরিণত করে। যা পরাজিত প্রতিপক্ষের এলাকায় সামরিক শক্তি বিস্তার এবং এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয় মার্কিনিদের। এ ঘটনা অবশ্য জাপানে পশ্চিমাদের একটি গণতান্ত্রিক ঘাঁটিও তৈরি করেছিল। এখন নতুনত্ব হলো, দ্বিতীয় পরাশক্তি চীন এশিয়ায় আধিপত্যের জন্য লড়ছে। তাইওয়ান এর সরাসরি শিকার।
বেইজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে এই দ্বীপটি ১৯৪০-র দশকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির গৃহযুদ্ধ জয়ের শেষ অসমাপ্ত অংশ। সে সময় পরাজিত জাতীয়তাবাদীরা তাইওয়ানে পালিয়ে যান এবং তখন থেকেই তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে তাইওয়ান পুনরুদ্ধার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে পবিত্র কাজের মতো। চীনের কাছে তাইওয়ান পূর্ব এশিয়াজুড়ে এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের মূল চাবিকাঠি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চীনের শক্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি তাইওয়ানের ওপর হামলার মনোভাবও বেড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কয়েকবার বলেছেন, তাইওয়ানকে বহিঃশত্রæর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র। চীন-ভারতের মধ্যে হিমালয়-সংলগ্ন বিতর্কিত সীমানা ঘিরে যুদ্ধ জমে আবার দম নেয়। এই বিরোধ সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে। এশিয়ায় আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা ছড়াচ্ছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির নেতা কিম জং উন হুমকি দিয়েই রেখেছেন, তারা আক্রমণের হুমকি অনুভব করলেই পারমাণবিক হামলা চালাবে। এর মহড়া হিসেবে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে আসছে উত্তর কোরিয়া। অভ্যন্তরীণ ও প্রতিবেশী যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা বাংলাদেশের কাছে পড়শি মিয়ানমারেও। যুদ্ধোত্তর স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি এবং এর অনেক জাতিগোষ্ঠী কখনোই পুরোপুরি শান্তিতে ছিল না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফের ক্ষমতা দখল করা সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও অযোগ্যতা মিয়ানমারে বিস্তৃত সংঘাতকে কেবল অনিবার্যই করে তুলছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধের ধরন ভিন্ন। পরিস্থিতির ভয়াবহতাও বেশি। যুদ্ধ এখন শুধু সমরাস্ত্রের নয়, তা চলে অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতেও। কিছু লড়াই চোখেও দেখা যায় না। কিন্তু জনজীবনে এর প্রভাব মারাত্মক। ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট নামের একটি সংস্থা বলছে, বিশ্বে প্রতিদিন এমন অনেক প্রজন্ম বেড়ে উঠছে যাদের জন্ম যুদ্ধের ময়দানে। বেড়ে ওঠাও তাই। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণকারীদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে জন্মানোদের মনস্তাত্ত্বিক যে তফাৎ গড়ে উঠছে তা আগামী বিশ্বকে অশান্তিময় করে তুলবে। যার নমুনা কোরীয় উপদ্বীপ, পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান বনাম যুক্তরাষ্ট্র, ইয়েমেন, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, নাইজেরিয়া, মালি, লিবিয়া, মিসর, ইসরায়েল, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাক, তুরস্ক, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, ভেনেজুয়েলা, মেক্সিকোসহ আরো নানা দেশ ও অঞ্চলে। যুক্তরাষ্ট্র প্রাসঙ্গিক সবখানেই। পিছে পিছে রাশিয়াও।
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার দীর্ঘ অধ্যায়ের অবসান ঘটল আফগানিস্তানের পতনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আধাখেঁচড়া এক যুদ্ধ গলাধঃকরণ না করতেই বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিল চীনের অভিনব হাইপারসনিক মিসাইল। যা সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটতে পারে মাঝ আকাশেই। রাডারের চোখ ফাঁকি দিতে প্রয়োজনে গোটা দুনিয়াকে পাক খেয়ে বেশ খানিকটা নিচু দিয়েও উড়তে পারবে এটি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের হাতেই আছে ৩ হাজার ৭৫০টি নিউক্লিয়ার বোমা। এ অবস্থায় নিউক্লিয়ার নিরস্ত্রীকরণের কথা শুনতেই পারছে না রাশিয়া, চীন ও ইরান। চীনও বলে বেড়াচ্ছে, তারা নিউক্লিয়ার অস্ত্র হু হু করে বাড়াচ্ছে না, মেপে মেপে করছে সব। এশিয়ার নিরাপত্তা মানচিত্রে একটা বড় পরিবর্তন আসন্ন বলেই তাদের এত আয়োজন। সংখ্যায় কম হলেও ভারত, পাকিস্তানের হাতেও আছে পরমাণু বোমা। তবে আতঙ্কটা বোমার সংখ্যা নিয়ে নয়; আতঙ্ক বোমার সুইচ যাদের হাতে, তাদের নিয়ে। এ রকম অবস্থায় চলতি বছর বিশ্বের অন্তত ৩০টি দেশে নির্বাচন। পরিমাপে তা বিশ্বের অর্ধেক।
বিশ্বের টপ সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম চতুর্বার্ষিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এ বছরের শেষদিকে ৫ নভেম্বর। এ নির্বাচনে জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে মেয়াদপূর্তিতে তার বয়স দাঁড়াবে ৮৬ বছর। ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ফিরে আসতে পারেন বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্ব›দ্বী রাশিয়ায় কেউ কি ভøাদিমির পুতিনকে চ্যালেঞ্জ করবে- এসব প্রশ্ন ঘুরছে। চলছে নানা জরিপও। এক জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভোটার মনে করেন নেতিবাচক প্রভাব এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্ব›দ্বী থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি বয়সি ডেমোক্র্যাট নেতার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাব্য প্রতিদ্ব›দ্বী সাবেক প্রেসিডেন্ট ৭৭ বছর বয়সি ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘুরপাক খাচ্ছেন একাধিক ফৌজদারি মামলাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতায়। রাশিয়ায় ভøাদিমির প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতিদ্ব›দ্বী আলেক্সি নাভালনি ১৯ বছরের সাজা ভোগ করছেন। আসন্ন নির্বাচনে পুতিন স্বতন্ত্র নির্বাচনে জেতার মধ্য দিয়ে আর কোনো দলের না হয়ে সবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তিনি ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন।
প্রতিবেশী ভারতেও নির্বাচন আসন্ন। এপ্রিল-মে মাসে দেশটির প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ তাদের নেতা নির্বাচনে ভোট দেবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার আশা করছে। মধ্য জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৪০ কোটির বেশি মানুষ ভোট দেবেন। বিভিন্ন ইস্যুতে চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকা এই জোট নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবে। জুনে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও। ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও এ বছরই নির্বাচন। নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষের নির্বাচন হবে ভারতে। এটি এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি, চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশটি বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র হতে চায়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচন এরই মধ্যে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখা শুরু করেছে। গত সপ্তাহে ইউরোপের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম এবং মার্কিন হুইস্কি ও মোটরসাইকেলের শুল্ক নিয়ে আলোচনা আগামী নির্বাচনের পর করার বিষয়ে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস একমত হয়েছে। মেক্সিকোতে জ্বালানি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতি কী হবে, তা ঠিক করবেন ভোটাররা। আর ইন্দোনেশিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট নিকেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর বিষয়ে নীতি পরিবর্তন করতে পারেন।
একদিকে দেশে দেশে ভোট, আরেকদিকে যুদ্ধ- এই রসায়ন বিশ্বকে কোথায় নেবে উদ্বেগ আছে অনেকের। বিশ্বে এখন সচরাচর কারো ভূমি বা মানচিত্র কেউ নিয়ে যায় না। অর্থনীতি কবজায় নেয়। মোড়লীপনার হাব বানায়। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের জেরে সর্বশেষ সাগরের গুরুত্বপূর্ণ এক জলপথে জাহাজের ওপর ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধাদের হামলার ঘটনা বৈশ্বিক অর্থনীতির জগতে টালমাটাল করে দিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে তা করোনা বা রুশ-ইউক্রেনে যুদ্ধের কাছাকাছি আরেকটা ধাক্কা। এর মাঝেই দেশে দেশে একের পর এক নির্বাচন। ২০২৪ সালের নির্বাচন অলিম্পিয়াডে যেসব দেশ যোগ দিচ্ছে, সব মিলিয়ে তাদের অর্থনীতির আকার বৈশ্বিক অর্থনীতির ৬০ শতাংশ। অনেক দেশেই সরকারের বিরুদ্ধ অবিশ্বাস বাড়ছে, ভোটাররা তিক্তপূর্ণভাবে বিভক্ত। নিশ্চল আয়, জীবনযাত্রার মানের অবনতি ও ক্রমেই প্রকট হওয়া বৈষম্যের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্বায়নের বিষয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকে বর্তমান অবস্থার সঙ্গে ১৯৭০ দশকের পরিস্থিতির তুলনা করেন। আবার কেউ কেউ তুলনা টানেন ১৯৩০ দশকের সঙ্গে। সে সময়ের অস্থির রাজনীতি ও আর্থিক অসাম্য জনতুষ্টিবাদ উসকে দিয়েছিল। ফলে বাণিজ্যিক লেনদেন কমে, আর বাড়ে কট্টর রাজনৈতিক ভাবনা।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়