প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে নোবেলজয়ী বাঙালি-বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। একই সঙ্গে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ১৫ দিনের কারাদণ্ড। তবে আপিল করার শর্তে ড. ইউনূসসহ চারজনকে এক মাসের জামিন দেয়া হয়েছে। ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন ঢাকার শ্রম আদালত-৩ এর বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানার আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। ৩০ দিনের মধ্যে শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করা, কল্যাণ তহবিল গঠন এবং শ্রমিকদের ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার নির্দেশও দেন আদালত। রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বলেন- যে দোষ করেননি, সেই দোষেই তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। এটা কপালে ছিল। মনে দুঃখ রয়ে গেল নববর্ষের আনন্দের দিনে আঘাতটা পেলেন বলে। ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে এ মামলাটি হয়। অন্য তিন আসামি গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান।
নোবেলজয়ীদের জেল-জরিমানা বাংলাদেশের জন্য নতুন হলেও বিশ্বে নতুন নয়। জেল খেটে বা জেলে থেকে নোবেল পাওয়ার ঘটনা আছে কয়েকটি। আবার নোবেল পাওয়ার পর জেল খাটার ঘটনাও রয়েছে। এবারের শান্তিতে নোবেল পাওয়া ইরানি নার্গেস মোহাম্মদী এখনো কারাগারেই আছেন। ২০২৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ইরানের নারী অধিকারকর্মী এবং সাংবাদিক নার্গিস মোহাম্মদী নারীর অধিকার এবং মৃত্যুদণ্ড বিলোপের ক্যাম্পেইনের সঙ্গে যুক্ত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে আরো রয়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো। একাধিক রায়ে বর্তমানে ইরানের এভিন প্রিজনে মোট ১২ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন মোহাম্মদী। এর আগেও তাকে একাধিকবার কারাগারে নিয়েছিল ইরানি কর্তৃপক্ষ।
মাত্র মাস কয়েক আগে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং মানবাধিকার কর্মী আলেস বিলিয়াতস্কিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বিক্ষোভ ও অন্যান্য অপরাধের জন্য অর্থায়নের অভিযোগে বেলারুশের একটি আদালত এ রায় দেন। নির্বাসিত বেলারুশিয়ান বিরোধীদলীয় নেতা সভিয়াতলানা সিখানৌস্কায়া এই রায়কে ‘ভয়াবহ’ অভিহিত করে বলেছেন, বিলিয়াতস্কি এবং একই বিচারে দণ্ডিত অন্যান্য কর্মীদের অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিলিয়াতস্কিও আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। ৬০ বছর বয়সি বিলিয়াতস্কি ভিয়াসনা মানবাধিকার গোষ্ঠীর একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
এছাড়া শত শত বেলারুশিয়ানদের মধ্যে তিনি অন্যতম প্রধান, যারা ২০২০ সালের গ্রীষ্ম থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় কারাবন্দি হয়েছিলেন। কারাগারে আটক ব্যক্তিদের আইনি ও আর্থিক সহায়তা প্রদানে ভিয়াসনা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিনের নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোকে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করার পর বেলারুশে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। বিলিয়াতস্কিকে ২০২১ সালে ভিয়াসনা থেকে দুই সহকর্মীসহ গ্রেপ্তারের পর মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো তার বিরুদ্ধে করা মামলাকে বলেছিলেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েও দেশে-বিদেশে নানা আলোচনা চলমান। নোবেল লরিয়েট, মানবাধিকারকর্মী, বিশ্ব নেতারা ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। ড. ইউনূসকে হয়রানির নিন্দা জানানো ফিলিপাইনের নোবেল বিজয়ী মারিয়া রেসার বিরুদ্ধেও কর ফাঁকি দেয়ার মামলা হয়েছে; দিনের পর দিন তাকে সেই মামলা নিয়েই চলতে হয়েছে। রেসা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। রেসা বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন ফিলিপাইনের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের সময়। একসময় রেসা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা সিএনএনের হয়ে কাজ করেছেন। পরে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের সংবাদ পোর্টাল ‘র্যাপলার’। ওদিকে বেলারুশের এলেস বিলিয়াতস্কি শাস্তি পেয়েছেন এমন একজন শাসকের অধীনে, যাকে সাম্প্রতিককালে চেনা হয়েছে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের কারণে। তিনি আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। পুতিনের পাপেট এই ভদ্রলোক পরিচিত ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক হিসেবে, যে পরিচয়ে তার ন্যূনতম কোনো আপত্তি নেই।
কেবল নার্গিসই নন, কারাবন্দি অবস্থায় শান্তিতে এর আগে নোবেল পেয়েছেন আরো চারজন। ১৯৩৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন জার্মান সাংবাদিক ও শান্তিবাদী কার্ল ভন ওসিয়েৎস্কি। সে সময় তিনি একটি নাৎসি বন্দিশিবিরে আটক ছিলেন; এমনকি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অসলোতেও যেতে পারেননি। নোবেল প্রাপ্তির তিন বছর আগে, রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ডের পর এডলফ হিটলার বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলে ভন ওসিয়েৎস্কি গ্রেপ্তার হন। শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটিতে ভূষিত হন। অন্যদিকে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে এডলফ হিটলার জার্মানির নাগরিকদের যে কোনো বিভাগে নোবেল গ্রহণ করতে নিষেধাজ্ঞা দেন। ওসিয়েৎস্কি নিজে তার পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ করতে না পারলেও একজন জার্মান আইনজীবী কৌশলে তার হয়ে সেটি গ্রহণ করে নেন। ১৯৩৮ সালে বন্দি অবস্থায়ই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই নোবেলজয়ী। ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু কি যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জেতেন, তখন তিনি গৃহবন্দি।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় অহিংস আন্দোলনের জন্য নোবেলজয়ী সু কির আশঙ্কা ছিল, একবার বার্মা থেকে বেরোলে সামরিক জান্তা তাকে আর দেশে ফিরতে দেবে না; তিনি তাই অসলোতে তখন পুরস্কার গ্রহণ করতে যাননি। সু কির পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন তার দুই ছেলে ও স্বামী। তবে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে সু কির স্মরণে প্রতীকীভাবে একটি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়। অবশেষে ২০১২ সালে সু কির হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে ফের ক্ষমতা দখল করে নেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপর বিভিন্ন মামলায় সু কিকে মোট ৩৩ বছর কারাদণ্ড দেয় সামরিক আদালত। ২০১০ সালে জেলে থাকা চীনা ভিন্নমতাবলম্বী লিউ শিয়াওবো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। গণতন্ত্রপন্থী লিউকে দেয়া হয় ১১ বছরের কারাদণ্ড। চীনে মৌলিক মানবাধিকারের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে চলা লড়াই ও অহিংস আন্দোলনের জন্য সম্মানিত লিউয়ের স্মরণে নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রতীকীভাবে একটি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়েছিল এবং পুরস্কারটি কাউকেই হস্তান্তর করা হয়নি। এছাড়া পুরস্কার ঘোষণার পর তার স্ত্রী লিউ শিয়াকে গৃহবন্দি করা হয় ও তিন ভাইকে চীন ত্যাগে বাধা দেয়া হয়। লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ৬১ বছর বয়সে চীনের একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। লিউ দ্বিতীয় নোবেলজয়ী, যিনি কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
ফিলিপাইন, বেলারুশ বা ইরানের নোবেলজয়ীদের বিচার দিয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক তৎপরতার যৌক্তিকতা দেয়া মানায় না। আবার তা অগ্রাহ্যও করা যায় না। কারণ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কেউ অপরাধ করতে পারেন না- এমন কোনো কথা নেই। তিনি বা তারা বিচারের ঊর্ধ্বেও নন। নোবেলজয়ীদের বিচারের উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই আসছে। এছাড়া বাংলাদেশের ড. ইউনূসের বিষয়টিতে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। গুণেমানেও তিনি ভিন্ন। অধ্যাপক ইউনূস হলেন পৃথিবীতে সাতজন ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম, যিনি নোবেল, ইউএস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল এবং ইউএস প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পেয়েছেন। মার্কিন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তার মধুর সম্পর্কও বেশ আলোচিত। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন ও ইরানের শিরিন এবাদিসহ বিশ্বের ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠিও দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছিল, অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর বিষয়ে তারা শঙ্কিত এবং এর মাধ্যমে তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে বলে তারা মনে করেন। চিঠিতে অধ্যাপক ইউনূস ‘ধারাবাহিক বিচারিক হয়রানির শিকার’ বলে উল্লেখ করা হয়।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে যখন মামলা চলছে, তখন এ সংক্রান্ত আরো ১৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। মামলার বাদী ১৮ জন শ্রমিকের মধ্যে ১৭ জন অবসরে গেছেন এবং একজন কর্মরত। তার পক্ষে বিবৃতি দেয়া বিশ্বব্যক্তিত্বরা ড. ইউনূসের কারাদণ্ড হতে পারে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন সেই চিঠিতে। তাদের শঙ্কা বাস্তব হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতি ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা হলে তিনি নির্দোষ প্রমাণ হবেন বলে আত্মবিশ্বাসের কথাও জানিয়েছিলেন তারা। কারাদণ্ডের শঙ্কা ফললেও তাদের সেই আত্মবিশ্বাস বাস্তবে ফলেনি।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন। [email protected]
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।