ডিএমপির আদাবর থানা : ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামি পালিয়েছে হাজতখানা থেকে

আগের সংবাদ

নাশকতার জবাব ভোটে দিন : ঢাকায় নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

রাজনীতিতে ধর্মযোগের কুফল

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে ধর্মযোগ বা ধর্মের ব্যবহার নতুন বিষয় নয়। যুগ-যুগান্তর ধরে উপমহাদেশে রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালেই সেটা মোটা দাগে ধরা পড়বে। মহাত্মা গান্ধী চরমভাবে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তার চরম শত্রæও তাকে সাম্প্রদায়িক বলতে পারবে না। তবে তিনি কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। অর্থাৎ ধর্ম এবং রাজনীতিকে যুগলবন্দি করেছিলেন। সেটা আত্মঘাতী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দেশভাগ এবং হিন্দুত্ববাদীদের হাতে তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড সেটাই প্রমাণ করে। উপমহাদেশ বিভক্তির মূলে একমাত্র ক্রিয়াশীল ছিল ধর্ম। ধর্মকে উপলক্ষ করেই দেশ বিভাগ সম্পন্ন হয়েছিল, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনে। প্রধান দুই ভ্রাতৃপ্রতিম সম্প্রদায়ের উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, উৎপাটন, নৃশংস দাঙ্গা উপলক্ষ হয়েছিল মর্মান্তিক দেশভাগে।
পাকিস্তান এবং ভারত পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে জাতি পরিচয়কে পাশ কাটিয়ে উদ্দেশ্যমূলক ধর্মকেই অবলম্বন করা হয়েছিল। মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে জাতিভেদ সামনে আসেনি ওই ধর্মেরই টানে। বহুজাতি ও ধর্মাবলম্বীর ভারতে স্ব স্ব জাতীয়তাকে এড়িয়ে ‘ভারতীয় জাতীয়তার’ কুশলী বন্ধনে ভারতীয়দের আবদ্ধ করা হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রাধীনে ব্যতিক্রম বাঙালি জাতি। জাতি পরিচয় বিলুপ্তি মেনে নেয়নি। ধর্মীয় পরিচয়কে অতিক্রম করে ভাষা-সংস্কৃতির দাবিতে এবং পাকিস্তানি শাসকদের বিভেদ-বৈষম্যের শিকারে পরিণত হওয়ার ফলে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পরিণতিতে পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ কেবল ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না। স্বাধীন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও ছিল নিষিদ্ধ। যেটি ভারত কিংবা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রেই ছিল না এবং নেই। ১৯৭৪ সালে ভারত ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানভুক্ত করলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সক্রিয় থাকার ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ক্রমাগত তীব্রতর হয়ে ভারতের শাসনভার এখন ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের করতলগত হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্রমাগত হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসীন। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি দিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে তারা ক্ষমতায়। বাস্তবতা হচ্ছে বহু ভাষাভাষী ও সম্প্রদায়ের দেশ ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র বাস্তবায়ন যে সম্ভব নয়, এই সত্যটি বিজেপি সরকার ভালো করেই জানে। হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি নির্ভেজাল ভোটের রাজনীতিই কৌশলমাত্র। তাই বলে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা কিন্তু থেমে নেই। বহুত্ববাদকে উচ্ছেদে হিন্দুত্ববাদী অপতৎপরতা চলছে দেশজুড়ে। গো-রক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক নৃশংস-বর্বরতা অবিরাম ঘটে চলেছে। গো-হত্যা, গো-মাংস বহন ও রক্ষণের বানোয়াট অভিযোগে মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটে চলেছে বিজেপির শাসনামলজুড়ে। বিজেপিশাসিত অনেক রাজ্যে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ যেসব রাজ্যের ক্ষমতায় বিজেপি নেই সেসব রাজ্যের ওপর গো-হত্যা বন্ধের কড়া হুমকি দিয়ে আসছে বিজেপির উগ্রবাদীরা।
মহাত্মা গান্ধী গো-রক্ষার জন্য নানাবিধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। খেলাফতের সঙ্গে চুক্তি করে অকপটে বলেছেন, মুসলমানদের ছুরির কবল থেকে গো-মাতাকে রক্ষায় তিনি ওই চুক্তি করেছিলেন। গো-রক্ষার প্রচার-প্রচারণায় সারা ভারত চষে বেড়িয়েছেন। গান্ধী অহিংসায় বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি বলেছেন, গো-রক্ষার নামে হিংসার আশ্রয় নেয়া যাবে না। তিনি আরো বলেছেন, তিনি নিজে গো-সেবা করলেও, আমিষাশী মুসলমান ও খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ যারা গো-মাংস খায় তাদের খাদ্যাভ্যাসে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এ কাজ অন্যায়। তিনি স্বীকার করতেন এবং বলেছেন, ভারতবর্ষ কেবল হিন্দুদের দেশ নয়। এ দেশে বিভিন্ন জাতি-ধর্মের মানুষ বসবাস করেন। তাদের প্রত্যেকের নিজস্বতাকে সম্মান করতে হবে। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ করে চলেছে। অডিন্যান্স পর্যন্ত জারি করেছে। যেটি ভারতের জাতির জনক গান্ধীর আদর্শ ও নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী।
আপাতদৃষ্টিতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সঙ্গে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস দলের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন বলেই মনে করা হয়। অনেকে কংগ্রেসকে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবেও গণ্য করেন। অথচ এই কংগ্রেস দলের শাসনামলেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছিল। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের বিপরীতে কংগ্রেস সরকার তখন মৌলবাদীদের ঘৃণিত অপকীর্তির তামাশা দেখেছিল। স্বীয় কর্তব্য পালনে পুরোমাত্রায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল কংগ্রেস সরকার। সে দায় বা অভিযোগ থেকে কংগ্রেসের পরিত্রাণের উপায় নেই। বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে সহিংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দায়ও কংগ্রেস সরকারের ওপরই বর্তায়। ব্যর্থতার সে দায় কংগ্রেসকে বহন করতেই হবে।
প্রবল পরাক্রম বিজেপিকে রুখতে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে কলকাতায় বিজেপিবিরোধী বিগ্রেট মাঠে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি ছাড়া সব রাজনৈতিক দল বিজেপি ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে লড়ার ডাক দিয়েছিল। কংগ্রেস বলেছে নির্বাচনে নয়, নির্বাচন-পরবর্তী ঐক্যের কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিবিরোধী জোট গঠনে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভবিতব্য এই যে, মমতা দ্রুত তার অবস্থান পরিবর্তন করে বিজেপিবিরোধী জোট গঠন থেকে সরে দাঁড়ান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই অতীতে বিজেপি জোটে শামিল হয়ে বিনিময়ে হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী। পশ্চিম বাংলায় মমতার হাত ধরেই বিজেপির আগমন ঘটেছিল। আসাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যে শূন্য অবস্থান থেকে বিজেপির রাজ্য ক্ষমতা লাভ মমতার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। পশ্চিম বাংলায় বিজেপির ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি ঘটছে। কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের অবস্থান তলানিতে ঠেকেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে মমতার প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপিকে ঠেকানো অতি আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে বিজেপি ঠেকানো ছাড়া তার গতি নেই। বামফ্রন্ট সরকারের প্রবল বিরোধী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বামফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্যের জন্য ছুটোছুটি শুরু করলেও অবাক হব না। ক্ষয়িষ্ণু বামফ্রন্টকে আর প্রতিপক্ষ মনে করছেন না। তৃণমূলের প্রতিপক্ষ এখন কংগ্রেস কিংবা বামফ্রন্ট নয়, খোদ বিজেপি। অথচ এই বিজেপিকেই মমতা পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গড়ে তুলতে সর্বাধিক সহায়তা করেছিলেন।
সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস প্রকাশ্যে অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশ এঁটে থাকলেও ক্ষমতায় থাকাবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার অনেক দৃষ্টান্ত তারা রেখেছিল। গত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তুরুপের চাল চেলেছিল। যেটি নির্ভেজাল বিজেপির অনুসরণে। কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হরিশ রাওয়াত প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে অযোধ্যায় একটি বিশাল রামমন্দির নির্মাণ করবেন তারা। রাওয়াত দাবি করেন, আগেরবারও যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখনো রামমন্দির নির্মাণের জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তারা। তিনি ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রতি অভিযোগের আঙুল তুলে বলেন, বিজেপি রামমন্দির বিষয়ে আন্তরিক নয়। রামমন্দির বিষয়ে তাদের অবস্থান কপট। বিজেপিতে অনৈতিক লোকে ভরা। অনৈতিক লোক পুরুষোত্তম রামের ভক্ত হতে পারেন না। তার এই প্রতিশ্রæতি কংগ্রেস দলীয় কিনা জিজ্ঞেস করা হলে হরিশ রাওয়াত বলেছিলেন, ‘রামমন্দির বিষয়ে আমার বক্তব্য গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারিত হয়েছে। কংগ্রেসের তরফে সেটির বিষয়ে কোনো আপত্তি করা হয়নি।’ ভোটের রাজনীতিতে সব বুর্জোয়া তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমতাবস্থা অভিন্নই বলা যায়। তাই বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের পার্থক্য আর কোথায়!
আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার সেটা বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি শাসনতন্ত্রের চার মূলনীতির দুটি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে বিদায় করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় অপর সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ প্রবর্তন করেছিলেন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। এরশাদ-পরবর্তী অসামরিক শাসকরা সেটার পরিবর্তন তো পরের কথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পর্যন্ত দিয়েছেন। এমনকি সংবিধানের অসম্প্রদায়িক ধারা পাল্টে সাম্প্রদায়িক ধারাগুলো সংবিধানভুক্ত পর্যন্ত করেছেন। একাত্তরের ঘাতক দল জামায়াতে ইসলাম এখন চাপে রয়েছে তবে হেফাজতিদের প্রবল উত্থান ঘটেছে সরকারি মদদে। হেফাজত গণতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস করে না। করে না নির্বাচনী ব্যবস্থায় শাসক বদলের ব্যবস্থাও। তলোয়ার হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলই তাদের লক্ষ্য। হেফাজতের দাবির প্রেক্ষিতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করে সাম্প্রদায়িক শিক্ষার নানা উপকরণ যুক্ত করা হয়েছে। হেফাজতিদের যেরূপ আশকারা দেয়া হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে বর্তমান সরকারের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে হেফাজতে ইসলাম আবির্ভূত হলে নিশ্চয় অবাক হব না। যেহেতু সরকার বিরোধী দল হিসেবে সংসদে কিংবা সংসদের বাইরে এখন কার্যত সক্রিয় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্রায় সবাইকে কারাগারে পাঠিয়েও ক্ষান্ত হয়নি, শাস্তিও দ্রুত দিয়ে তাদের কোণঠাসা করা হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মূলত ক্ষমতারই রাজনীতি। ক্ষমতাই একমাত্র লক্ষ্য। ওই লক্ষ্য পূরণে হেন অপকীর্তি নেই যেটা করতে তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সংকোচ হয়। ধর্মকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে ব্যবহার করতেও ছাড়ে না। মুখে অসাম্প্রদায়িকতার আওয়াজ তুললেও ক্ষমতার মোহে সবই জায়েজ করে নেয়। ক্ষমতা একমাত্র ক্ষমতার মোহেই তথাকথিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নীতি-আদর্শের ধার ধারে না। কবি নজরুল ‘মানুষ’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘হায়রে ভজনালয় তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গায়ে স্বার্থের জয়’। জাতীয়তাবাদী শাসকদের ক্ষেত্রে অমনটা খাটে।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়