ডিএমপির আদাবর থানা : ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামি পালিয়েছে হাজতখানা থেকে

আগের সংবাদ

নাশকতার জবাব ভোটে দিন : ঢাকায় নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকার জন্য

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনা বলতে হবে যে একজন ঋণখেলাপিকে পুলিশ আটক করেছে। এর আগে আমরা শুনেছি ও পত্রিকায় পড়েছি- ঋণ খেলাপ করার অপরাধে মামলা হয়েছে কোনো ব্যবসায়ী, শিল্পপতির নামে; মামলার রায়ের পর সেই অপরাধীকে ধরতে পুলিশ হন্যে হয়েছে, কিন্তু তাকে পায়নি। তিনি নিখোঁজ, লাপাত্তা। দেশের বাইরে তিনি চলে গেছেন। ফলে ধরা হয়নি বা ধরা যায়নি। পাসপোর্ট আটক করেও তাকে বা তাদের আটকানো যায়নি। কারণ তারা নতুন পাসপোর্ট তৈরি করে চলে গেছেন। এখন পাসপোর্টে এনআইডি নম্বর দিতে হয়, এতে আর দুটি পাসপোর্ট বানানো সম্ভব নয়। তাই হয়তো নূরজাহান গ্রুপের এমডি দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি। পারলে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার বাড্ডার মতো গরিবি এলাকায় গা-ঢাকা দিতেন না। পুলিশ তক্কে-তিক্কে ছিল। তাকে আটক করে চট্টগ্রাম নিয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক নূরজাহান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহির আহমেদকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার বাড্ডা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম ওবায়েদুল হক বলেন, কোতোয়ালি থানার ১৮টি ঋণখেলাপির মামলায় জহির আহমেদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা রয়েছে। এছাড়া বিচারাধীন ছয়টি মামলায় পরোয়ানা রয়েছে। জহির আহমেদকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করা হবে। (প্রথম আলো ১২/২৯/২৩)।
একে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা বলতে হবে। তিনি তেল শোধনাগারের মালিক হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পর্যায়ক্রমে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে পেরেছেন। তবে তিনি বৈধ কাগজপত্র দিয়েছেন কিনা, নাকি অবৈধ কাগজের মারফতেই ঋণগুলো পেয়েছেন, সেটা তালাশ করে দেখা উচিত। কথায় আছে, একহাতে তালি বাজে না। বৈধ বা অবৈধ হোক, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে শাখা ও মূল অফিসের অনুমোদন দরকার পড়েই। যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা ঋণ দিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা, তারাও খেলাপকারীর সহযোগী। তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। না হলে ওই ঋণ খেলাপের লিগেসি বন্ধ হবে না।

দুই.
১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মালিকরা কোথায়? এ প্রশ্ন তো আমরা করতে পারি। নূরজাহার গ্রুপের এমডি জহির আহমেদ তো আর একা ওই পরিমাণ টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। জহির আহমেদের মতো খেলাপি ঋণের অধিকর্তাগণের নাম তো আমরা জানি না। দেশের বিদ্যমান শিল্পপতিগণের অনেকেই যেমন সেই তালিকায় আছেন, তেমনি আছেন তৈরি পোশাক খাতের অধিপতিগণও। আছেন আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায়ীগণও। কৈর তেলে কৈ মাছ ভেজে খাওয়ার লোকের অভাব আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে কম নেই। এরা ব্যাংকের টাকায় শিল্প কারখানা গড়ে তোলেন। আবার তারাই সেই ব্যাংকের পাওনা ঠিক সময়ে পরিশোধ করেন না।
উল্টো রাজনৈতিক দলের নেতাদের দিয়ে হুমকি-ধমকি লাগান, কিংবা অনৈতিক পথে ব্যাংকের দাবি না মিটিয়ে এক বা একাধিক ব্যাংকারের খাই মেটান বছরের পর বছর। এই অনৈতিক পথের তরিকা সব থেকে কাজের। যখন তারা ঋণ নিতে যান, তখনই অলিখিত চুক্তি হয়, তারা কীভাবে শিল্পপতিকে সাহায্য করবেন। ফলে জহির আহমেদের সঙ্গে ওতপ্রোত ব্যাংকারগণকেও আসামি করা হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
তিন.
থলে থেকে একটি কালো বিড়াল বেরিয়ে গেছে। সেই বিড়ালের নাম সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন রিয়ালিস্টেট বিজনেসে। মাত্র ২ হাজার ৮৪০ কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড।পড়–ন, সেই রিপোর্টের সামান্য অংশ।
নাম প্রকাশ না করে ও বিস্তারিত তথ্য না দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি জানিয়েছিল, এক মন্ত্রীর বিদেশে ছয় কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে। এসব কোম্পানির সম্পদের মূল্য ১৬ কোটি ৬৪ লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। এসব সম্পদের তথ্য তিনি নির্বাচনী হলফনামায় গোপন করেছেন। গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা ওই মন্ত্রীর নাম, কোন দেশে তার বিনিয়োগ আছে এবং কোম্পানিগুলোর নাম জানতে চেয়েছিলেন। তবে টিআইবি নাম প্রকাশ না করে বলেছিল, সরকারের কোনো সংস্থা চাইলে তারা তথ্যপ্রমাণ দেবে।
সমকাল জানতে পেরেছে, লন্ডনে মন্ত্রী জাবেদের কোম্পানি ছয়টি না; আটটি। কোম্পানিগুলোর সম্পদমূল্য ২০ কোটি ৩১ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। স্ত্রী রুখমিলা জামান এবং মেয়ে জেবা জামানের নামেও কোম্পানি খুলেছেন তিনি। এছাড়া পারিবারিক মালিকানায় থাকা ব্যবসায়িক গ্রুপ আরামিটের নামেও একটি কোম্পানি খুলেছেন।
সরকারের কোনো সংস্থা চাইলে টিআইবি তথ্য দেবে বলা হলেও গত বুধবার পর্যন্ত কোনো সংস্থা বা দুদক এ বিষয়ে কোনো তথ্য চায়নি। তবে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একজন কর্মকর্তা জানান, অনুমোদন ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ করা বেআইনি। নির্বাচনের পর তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। (সমকাল ২৯ ডিসেম্বর, ২৩)
আমরা যতটা জানি, তা হলো কোনো ব্যক্তি যদি বিদেশে বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পারমিশন নিতে হবে। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাবেদ) কোনোরকম অনুমতি নেননি। তাহলে তিনি কী উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে নিয়ে গেলেন? টাকা লুটের এটা একটি নমুনা। পারমিশন না নিয়ে একজন সাইফুজ্জামান যদি টাকা পাচার করতে পারেন, তাহলে তার মতো কত মন্ত্রী, কত এমপি আছেন, তার মতো আর কত আওয়ামী লীগ নেতা আছেন, যারা এই টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত? বাদ দেন, নেতারা তো দেশপ্রেমিক, তারা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত নন। কিন্তু এটা তো সত্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুনামকে গ্রাস করে নিয়েছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী, যারা ব্যাংক খালি করে দিয়েছে। দিন কয়েক আগে পত্রিকার রিপোর্টে পড়েছি ৮-১০টি ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তাদের ড্রয়ারে টাকা নেই। ব্যাংক ব্যবস্থা নাজুক করার প্রধান ঘটনা তো ঘটিয়েছে এসএ গ্রুপ। তারা ৮-১০টি ইসলামী নামের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২০ হাজার কোটিরও বেশি। তারা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য না করলেও প্রতিবাদ জানিয়েছে যে তারা বিনা বৈধ কাগজে ঋণ নেয়নি। সেই তথ্য কেউ যাচাই করে দেখেনি। এমনকি দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকও।
ঋণ করে ঘি খাওয়ার রেওয়াজ আজকের নয়, এর শুরু বহুকাল আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তবে গত ১৫ বছরে এর পরিমাণ এতটাই বেড়েছে, তা লুটপাটের তরিকায় পর্যবসিত হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, গত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মাত্র ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে কিছু ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। গত বুধবার পর্যন্ত সরকারি কোনো সংস্থা বা দুদক টিআইবির কাছে কোনো তথ্য চায়নি। তবে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক কর্তাব্যক্তি বলেছেন, অনুমোদন ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ বেআইনি। নির্বাচনের পর তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। এই খতিয়ে দেখার মানে কী? উপরওয়ালাদের কাছে থেকে কোনো রকম নির্দেশ আসে কিনা, তাই দেখার জন্য তিনি বা তারা নির্বাচনকে ঠেকা দেয়ার উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করলেন। তারা যে একটি সরকারের কর্মকর্তা এবং তার কাজ অফিস খোলা থাকলে সেই সময়েই শুরু করতে বাধ্য। কারণ এই বিষয়টি বিপুল পরিমাণ অর্থের লোপাট হওয়ার সঙ্গে জড়িত। নির্বাচন সেখানে কোনো বাধা নয়। তারপরও সরকারি কর্মকর্তাদের মতো রাজনৈতিক সরকারের কাছে আবেদন করবেন এই বলে যে টিআইবি যে তথ্য দিয়েছে, তা নিয়ে তারা এগোবে কিনা। এই রকম মন-মানসিকতা নিয়ে জনগণের সেবা দেয়া ও জনগণের অর্থ রক্ষা করা যায় না, যাবে না। আর দুদক একটি পা ভারী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। তাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত না দেয়া পর্যন্ত তারা কালো মেঘেই থাকবে, জনগণের অর্থ-বিত্ত রক্ষার জন্য তৎক্ষণাৎ কাজে নামবে না। তাদের কাছে যদি কেউ কমপ্লিন করেনও তারপরও তারা অদৃশ্য বসের ইশারার জন্য গা এলিয়ে বসে থাকে। দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কেউ ওই ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ করলেই কেবল তারা কাজে নামবেন। এই হলো সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশনের দুর্নীতি দমনের মনোভাব। দুদকের এ রকম মনোভাব নিয়ে কি কোনো দিন দুর্নীতি দমন করা যাবে? তাদের এই মনোভাবই যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ের অন্তর্গত, সেটা কেউ না বললেও না লিখলেও তা অনুমান করা যায়।
আমরা এ রকম দুর্নীতিপরায়ণ মনোভাব পোষণ করব আর মানসিকভাবে আমরা যে দুর্নীতিরই আশ্রয়-প্রশ্রয় নিই, তাই প্রমাণ করে। প্রভু হে, এদের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করো।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়