রাজধানীতে ৬ বছরের শিশুকে গণধর্ষণের অভিযোগ

আগের সংবাদ

সম্ভাবনার নবদিগন্তে বাংলাদেশ

পরের সংবাদ

ভুলের আবর্তে বিএনপি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি আরেকটি ঐতিহাসিক ভুলের জন্ম দিল। অবশ্য এমন ভুল বিএনপির নতুন নয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দল অসংখ্য ভুল করেছে, যার খেসারত দিতে হয়েছে জাতিকে। শুরুতে এবারের ভুলটা উল্লেখ করি। ২০১৪ সালের নির্বাচন একেবারে শেষ পর্যায়ে বয়কট করে আওয়ামী লীগের ১৫৩ জনকে বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। ২০১৮ সালে করবে কি করবে না এমন সিদ্ধান্তহীনতায় শেষ পর্যন্ত অংশ নিলেও আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে ধরাশায়ী হতে হয়েছে তাদের। এবার বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতা কিংবা ১৮ সালের কৌশল কোনোটাই কাজে লাগাতে পারত না আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের পক্ষে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী রাজপথে নামত। আর সে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ভোটের গ্যারান্টি দাবি করলে বাস্তবতা ভিন্ন হতে পারত।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ও চেতনাকে ধূলিসাৎ করার সব ধরনের চেষ্টাই শুধু করেননি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়ে স্বাধীন দেশে তাদের পুনর্বাসিত করেছেন রাষ্ট্রীয় মদদে ও আর্থিক সহযোগিতায়। সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মুছে দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এসব করতে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর নামনিশানা মুছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার সব ধরনের চেষ্টা করেছেন। সমাজে আজ যে সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ঘটেছে, রাজনীতি কলুষিত হয়েছে, রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে, ছাত্ররাজনীতি আদর্শহীন হয়েছে- তার মূলে আছে জিয়াউর রহমানের কূটরাজনীতি। রাজনীতিকদের ঘুষ দিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে এবং কখনো ভয় দেখিয়ে ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। তার আগে নিজের অবৈধ ক্ষমতাকে হালাল করতে হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করে ভোটের সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে-বিদেশে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। সংসদে ইনডেমনিটি বিল পাস করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার রুদ্ধ করেছেন। এ অপকর্মগুলো করে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম বেনিফিশিয়ারি হিসেবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলারদের পুনর্বাসিত করে পার্বত্যবাসীর সঙ্গে বাঙালির দীর্ঘকালীন সংঘাতের পথ উন্মুক্ত করেছেন। এরপরে ক্ষমতায় আসেন তারই উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ, যিনি জিয়ার অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পূর্ণ করেছেন। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করে দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে এক কঠিন সাংবিধানিক সংকট তৈরি করেছেন। এখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম আছে পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাও আছে।
৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতনের পর যে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল তাকেও ব্যর্থ করেছে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে খালেদা জিয়া তৎকালীন তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী দেশকে নতুন করে, নতুন উদ্যমে পরিচালিত করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা না করে তার প্রয়াত স্বামীর পথ ধরে তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার উদ্যোগ নেন। তারই অংশ হিসেবে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করেন। ২০০১ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় প্রমাণ করেছেন যে খালেদা জিয়ার সরকারের মদদে এ দেশে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশয় দেয়া হয়। সে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সবচেয়ে বিতর্কিত ও ক্ষতিকর কর্ম ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা। যে কারণে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। দুবছর আর্মিব্যাক একটি অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল তৎকালীন সরকারের ইন্ধন ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। বিশ্বের রাজনীতির ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা বিরল। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে রাজনৈতিক সম্প্রীতির সম্ভাবনা চিরতরে রহিত হয়ে যায়।
এর ঠিক উল্টো অবস্থান আওয়ামী লীগের। নির্বাচন বয়কট করার ঘটনা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে নেই। সেই পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান নির্বাচন পর্যন্ত। এমনকি জিয়ার একতরফা নির্বাচনের তামাশার সময়েও। তবে ব্যতিক্রম আছে ১৯৮৮ সালে এরশাদের ভোটারবিহীন নির্বাচন যেখানে আ স ম আবদুর রব শ’খানেক দল নিয়ে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি বা কপ গঠন করে অংশ নিয়ে প্রথমবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। আরেকটি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ভোটারবিহীন নির্বাচন, যে নির্বাচনে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বজলুল হুদাকে সংসদ সদস্য বানিয়েছিলেন। এরশাদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মেনে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ বড় দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি। বিএনপির ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ না নেয়ায় সে সরকারও টেকেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করেই তাদের পদত্যাগ করতে হয়। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করলেও সে নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ পূর্ণ সময় ক্ষমতায় ছিল। ২০১৮ সালে কারচুপির অভিযোগ আনলেও আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর পূর্ণ করছে। এবারের নির্বাচনেও বোধহয় তেমন ঘটনাই ঘটতে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি জামায়াতে ইসলামী সে নির্বাচন বয়কট করেছিল বলে। জামায়াত বয়কট করেছিল মানবতাবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাদের নেতাদের বিচার ও শাস্তি হচ্ছে বলে। সে সময় নির্বাচনে অংশ নিতে অনুরোধ জানিয়ে খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন শেখ হাসিনা, এমনকি নির্বাচনকালীন সরকারের কয়েকটি মন্ত্রিত্বসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব বিরোধী দলকে দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজ দলেরই ক্ষতি করেছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না এই দোদুল্যমানতার ভেতর দলকে অপ্রস্তুত রেখে শেষমেশ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাতে লাভ হয়নি। নমিনেশন দিতে কারচুপি, দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে কোনো কোনো আসনে একাধিক প্রার্থী দিয়ে নিজেদের ঐক্য বিনষ্ট করে আওয়ামী লীগকে সুবিধা করে দেয়া হয়েছিল। ফলে নির্বাচনে কথিত অনিয়ম ঠেকাতে পারেনি বিএনপি। তাতে বিপুলভাবে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে আবারো পাঁচ বছর দেশ শাসন করে। বিএনপির মূল সমস্যাটি হচ্ছে নেতৃত্বের। ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যর্থ বিএনপি ধারণা করেছিল আমেরিকা ও তার মিত্রশক্তি তাদেরকে বঙ্গভবনে নিয়ে গদিতে বসিয়ে দেবে। এটা যে সম্ভব নয় সেটা অনুধাবন করার মতো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নেই বিএনপির নেতাদের। যে কারণে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনই জোরালো করতে পারল না বিএনপি এমনকি নির্বাচনও ঠেকাতে পারবে বলে মনে করার কারণ দেখা যাচ্ছে না। এতদিন কিছু করতে না পেরে এখন বলা হচ্ছে, নির্বাচনের পর আন্দোলন জোরদার করা হবে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ল। বন্যা হয়েছে। ডুবে যাচ্ছে বাড়িঘর। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাড়িঘর ফেলে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু একলোক কিছুতেই যাবেন না। তিনি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে আশ্রয় চাইলেন। সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচানোর প্রতিশ্রæতি দিলেন। পানি বাড়ছে। তার পরিবার তাকে রাজি করাতে পারল না বাড়ি ছাড়তে। অগত্যা তারা চলে গেল নিরাপদ আশ্রয়ে। গ্রামের সবাই যাওয়ার আগে নৌকা নিয়ে আসে তাকে বাঁচাতে। সে রাজি নয়। পানি বাড়তে বাড়তে চাল ডুবে যাচ্ছে। গ্রামের শেষ নোকাটি চলে যাওয়ার পথে তাকে নিতে চাইল। সে সবাইকে একই উত্তর দিল আমার ঈশ্বর আমাকে বাঁচাবে। সে গেল না এবং একসময় পানিতে ডুবে মারা গেল। মারা যাওয়ার পর সে ঈশ্বরকে বলল, তুমি না আমাকে বাঁচাবে বলে ভরসা দিয়েছিলে? শুনে ঈশ্বর বললেন, তোমাকে বাঁচানোর জন্যই তো এত লোক পাঠিয়েছিলাম। তুমি তো কারো পরামর্শই শোননি। আমি নিজে গিয়ে তো আর পানি সরিয়ে তোমাকে বাঁচাতে পারি না। নির্বাচন হয়ে গেলে, তাতে আওয়ামী লীগ জিতে গিয়ে সরকার গঠন করলে তাদের ‘অবতার’ তেমন কোনো উত্তর দেয় কিনা তা শোনার অপেক্ষায় রইলাম। বিএনপির জন্মটাই একটি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ভুল। কারণ এ দলের সৃষ্টি হয়েছিল বলে জাতি আজ মুক্তিযদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত। না হলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে ধারণ করেই রাজনীতি করতে হতো। সবশেষে অনেক ভুলের কারিগর বিএনপি আরেকটি ঐতিহাসিক ভুলের মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক কফিনে আরেকটি পেরেক ঠুকে দিল কিনা সেটি এখন দেখার বিষয়।

কামরুল হাসান বাদল : কবি ও সাংবাদিক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়