নাশকতায় সংশ্লিষ্টতা : ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতিসহ ১১ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নৌকা প্রতীকে ভোট চাইলেন প্রধানমন্ত্রী : বরিশালে বিশাল নির্বাচনী জনসভা

পরের সংবাদ

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অধরাই রয়ে যাবে

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের দুটি অত্যাবশ্যকীয় ভিত্তি। এ দুটি বিষয় আমাদের দেশে আগে ছিল না, এখনো নেই। পৃথিবীর যেসব দেশ গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, সেখানে এগুলো আছে বলে বলা হয়, কিন্তু খুব যখন প্রয়োজন পড়ে তখন দেখা যায় নেই। আমেরিকার নেতৃত্বে যখন পুঁজিবাদী বিশ্বের ইরাক ও আফগানিস্তান দখল চলল, তখন সেই ঘটনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছিল এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। দাবি করা হয়েছিল, ইরাকে এমন সব ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন রয়েছে, যেগুলোর একটি মাত্র আঘাত অসংখ্য মানুষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট; পইপই করে খোঁজা হলো কিন্তু আক্রমণ-উন্মাদেরা তেমন কোনো অস্ত্রের খবর বিশ্ববাসীকে দিতে পারল না। তবু দখল করা হলো, হত্যা এবং রক্তপাতের কোনো সীমা-পরিসীমা রইল না, কিন্তু না দেখা গেল স্বচ্ছতা, না দায় রইল জবাবদিহিতার। আফগানিস্তান দখলের অজুহাত ছিল তালেবানদের হটানো, যে তালেবানরা একদা মার্কিনিদের হাতেই তৈরি হয়েছিল; সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ব থেকে আফগানিস্তানকে ‘মুক্ত’ করার জন্য। সে দেশে মানুষ ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে বিপুল; তালেবানরা নিশ্চিহ্ন হয়নি, তারা নানা উপায়ে ফিরে এসেছে। আফগানিস্তানের ধ্বংসকাণ্ডের জন্য আমেরিকাকে জবাবদিহিতার কাঠগড়াতে দাঁড়াতে হয়নি- না বিশ্ববাসীর কাছে, না নিজ দেশের জনগণের কাছে।
স্বচ্ছতা থাকলে ধরা পড়ত যে উভয় ক্ষেত্রেই আসল উদ্দেশ্য ছিল দেশ দুটির জ^ালানি তেল ও খনিজসম্পদ হস্তগত করা; সেই সঙ্গে ছিল সমরাস্ত্র তৈরি এবং সেনাবাহিনীতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। আমেরিকা এটাও দেখাতে চেয়েছে যে তারা দুর্ধর্ষ, যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত মানুষ হত্যা করছে, সে জন্য কারো কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই। কোন যুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে তাদের বাসভূমি দখল করে বসে আছে তার জবাবও ইসরায়েল কখনো দেয়নি, দেবেও না। সাম্প্রতিক ফিলিস্তিনে নৃশংস বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো কেবল নিশ্চুপ নয়, জায়ানবাদীদের মদত জুগিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা সংঘটনে। মিয়ানমারে কী ঘটছে, সে ব্যাপারে স্বচ্ছতা নেই দেখে ‘গণতান্ত্রিক’ বিশ্ব বেশ ক্ষুব্ধ ছিল, সে দেশের নিষ্ঠুর সামরিক জান্তার ওপর নানাবিধ চাপও প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে তারা ‘উদার’ হয়। শেষ পর্যন্ত নাকি খানিকটা উদারতা প্রকাশে সম্মত হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কেন নাগরিক অধিকার দেয়া হচ্ছে না, কেন তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তাদের ঘরবাড়ি কেন জ^ালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে, হত্যা করে এবং হত্যার হুমকি দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে কেন পাহাড়ে, জঙ্গলে, নৌকায় পালিয়ে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা উদারতা-প্রদর্শনকারী শাসকরা উপস্থিত করছে না। গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকেও এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ উঠছে না। অং সান সুচি মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন, বিশ্ব তার প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছে, কিন্তু তিনি নিজে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবের পক্ষে প্রথমে কোনো কথা বলেননি, পরে যা বলেছেন তা হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের পক্ষে যায়নি।
আমাদের নিজেদের দেশেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিলক্ষণ অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোকে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করার বাধ্যবাধকতা মানা হয় না। সংসদের কার্যক্রমের দিকে তাকালে দেশে কোনো বিরোধী দলের উপস্থিতি আছে বলে টের পাওয়া যায় না। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয়, অপরাধীরা ধরা পড়ে না। সরকারি ব্যাংক থেকে হলমার্কওয়ালারা কীভাবে হাজার হাজার কোটি আত্মসাৎ করল, সেটা রহস্যই রয়ে যায়। সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতিকে কারা এবং কেন হত্যা করল, সেটা পরিষ্কার হয় না। গুম হয়ে উধাও হয়ে কোথায় চলে গেল ওরা, তার কোনো হদিস নেই। এ ধরনের বড় বড় ঘটনার ক্ষেত্রেই যখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চিহ্ন পাওয়া যায় না, তখন ছোটখাটো অপরাধের যারা ভুক্তভোগী, তারা ন্যায়বিচার পাবেন এমন আশা নিশ্চয়ই বাস্তবসম্মত নয়। বাস্তবেও তেমনটা দেখা যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে; খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দিক দিয়ে দেশ এখন ঘটনাবহুল। অভাব কেবল ওই দুই বস্তুর- স্বচ্ছতার ও জবাবদিহিতার, যাদের অভাব ঘটলে গণতন্ত্র আছে এমনটা বলা মুশকিল।
কিন্তু গণতন্ত্র তো এমনি এমনি আসে না, তার জন্য চাপের দরকার পড়ে। আর সেই চাপটা দিতে পারে অন্য কেউ নয়, জনসাধারণই। যে জন্য প্রতিটি দেশেই জনগণের জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় শাসক শ্রেণিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অনুশীলনে বাধ্য করা। নিজের দেশে গণতন্ত্র এলে তবেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা সম্ভব। সুখের বিষয় এটুকুই, বোধটা পৃথিবীব্যাপী এখন পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে, আমাদের দেশেও এই বোধের বিকাশ ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। নইলে যতই গণতন্ত্রের কথা বলি না কেন, গণতন্ত্র আকাশকুসুমই রয়ে যাবে।
এই মুহূর্তে ইসরায়েল গাজাতে যেভাবে মানুষ, বিশেষ করে শিশু হত্যা ঘটিয়ে চলেছে, তা গণহত্যা ভিন্ন অন্যকিছু নয়। কিন্তু মিডিয়া তাকেই বলছে যুদ্ধ। বলে চলেছে, সন্ত্রাসীদের দল হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলি নিয়মিত সেনাদের সংঘর্ষ বেধেছে। অথচ হামাস নয়, লড়ছে সব ফিলিস্তিনিই, জবরদখলের বিরুদ্ধে। গাজা একটি কারাগার। গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বোমার আতঙ্কে মানুষ সেখান থেকে পালাতে চায়। কিন্তু পালাবার জায়গা নেই, পথও নেই খোলা। সব পথ অবরুদ্ধ। ফিলিস্তিন তো ফিলিস্তিনিদেরই আবাস। জর্ডান নদী এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত মূল্যবান এই ভূখণ্ডে মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি সবাই সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে, এটাই হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিদের জন্য একটি বাসভূমি স্থাপনের ‘প্রয়োজনে’, মূলত কর্তৃত্বকারী ব্রিটিশের উদ্যোগে, ফিলিস্তিনের একটি অংশ কেটে নিয়ে ইসরায়েল নামে একটি ইহুদি বর্ণবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে ইসরায়েল তার দখলদারিত্ব বাড়াতে থাকে এবং ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনিদের ২২ শতাংশ ভূমি ইসরায়েলের দখলে চলে গেছে। এখন তো মনে হয় ফিলিস্তিনিদের বসবাসের এলাকাটুকুও দখল করে নেবে। এই প্রবন্ধটি যখন লিখছি, তখনই তো খবর পাওয়া গেল, গাজায় ২৪ ঘণ্টায় ৭০০ মানুষ নিহত হয়েছে, স্থল, আকাশ, জলপথে ইসরায়েলি আক্রমণে। পশ্চিমা গণমাধ্যম স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে, গত কয়েক মাসে নিহতের সংখ্যা শতবর্ষের রেকর্ড ভেঙেছে। বলতে বাধ্য হচ্ছে, ইরাক ও আফগানিস্তানের চেয়েও অনেক বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এই সময়ে। ইউক্রেনে দুই বছরে নিহতের সংখ্যার তুলনাতে অতি অল্প সময়ে গাজায় নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণেরও অধিক। ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। ইসরায়েলের দুর্নীতিবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ে যারা আলোচনা করে, ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য নিয়ে তারা দেখি নিশ্চুপ। হ্যাঁ, বিশ্বের নানা জায়গায় প্রতিবাদ হচ্ছে। সেগুলো বিবেকমান মানুষের প্রতিবাদ। রাষ্ট্রের নয়। আরব বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। কারণ সেখানকার শাসকরা এখন ধনী হয়ে উঠেছে এবং তারা আরো ধনী হতে অস্থির। ইসরায়েলও ধনী। ধনীতে ধনীতে বন্ধুত্ব, আরো বেশি ধনী হওয়ার ব্যাপারে। ফিলিস্তিনিরা আরবদের আত্মীয় বটে, তবে গরিব; গরিব আত্মীয়রা বোঝা হয়ে দেখা দেয়, তাদের সরাতে পারলে ভালো।
নতুন বছর আসে নতুন আশা নিয়ে। মনে করা হয় যে দিন বদলাবে। কিন্তু বদলায় না এবং বদলায় না যে সেই পুরনো ও একঘেঁয়ে কাহিনিই নতুন করে বলতে হয়। না বদলাবার কারণ একটি ব্যাধি, যার দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত। ব্যাধিটির নাম পুঁজিবাদ। এই ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। রাজনৈতিকভাবে আমরা বারবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি।
কিন্তু মুক্তি যে আসেনি তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যর্থতার স্মারকচিহ্নগুলো জ্বল জ্বল করছে। সবকিছুই গা-সওয়া হয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যে দু-একটি ঘটনা ঘটে, যাতে আমরা ধাক্কা খাই, চমকে উঠি, পরস্পরকে বলি- আমরা তো ভালো নেই, কঠিন বিপদের মধ্যে রয়েছি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়