নাশকতায় সংশ্লিষ্টতা : ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতিসহ ১১ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নৌকা প্রতীকে ভোট চাইলেন প্রধানমন্ত্রী : বরিশালে বিশাল নির্বাচনী জনসভা

পরের সংবাদ

মাদকের নাটের গুরু

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কয়েক দশক ধরে দেশে ধূমপান ও তামাকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যখন একটি ভালো অবস্থানে আসার জন্য লড়ে যাচ্ছি, ঠিক তখনই ‘ই-সিগারেট’ নামক নতুন মারণাস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছে ধূর্ত সিগারেট কোম্পানিগুলো। কৌশলী ও চটকদারি বিজ্ঞাপন, আকর্ষণীয় শব্দ, ব্র্যান্ড প্রমোশন ও বাজার সম্প্রসারণে পুরনো পদ্ধতি হলেও এবারে ‘ই-সিগারেট’ বাজারজাতকরণে আটঘাট বেঁধে নেমেছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। কারণটা সহজেই অনুমেয়, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বিশ্বজুড়ে প্রচলিত সিগারেটের বাজার পতন হলেও যেন তাদের মুনাফার পাগলা ঘোড়া লাগামহীন দৌড়াতে থাকে। প্রযুক্তিনির্ভর ই-সিগারেট, ভেপ, হিটেট টোব্যাকো প্রোডাক্টস এনে সেই ক্ষেত্র বাংলাদেশসহ অনেক দেশে বিস্তৃত করছে তারা। এগুলোর দ্রুত প্রসারে এবারের কূটকৌশল আরো নগ্ন, ভিত্তিহীন, বিভ্রান্তকর। শুরু থেকেই এবার মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে যে- ‘ই-সিগারেট’ প্রচলিত সিগারেটের বিকল্প, ধূমপান ত্যাগে কার্যকর এবং সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর, ডাহা মিথ্যা হলো- ‘ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর।’ প্রকৃতপক্ষে, ই-সিগারেটকে ভোক্তা পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলো।
সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, ই-সিগারেট কোনোভাবেই কম ক্ষতিকর বা নিরাপদ নয়। বরং এর মধ্যে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে এমন উদ্বেগজনক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবশেষ তথ্য মতে, নিকোটিনযুক্ত ই-সিগারেট প্রচণ্ড আসক্তি বাড়ায় এবং স্বাস্থ্যহানিকর। দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলো সম্পূর্ণরূপে বোঝা না গেলেও এটা প্রতিষ্ঠিত যে, তারা বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে, যার মধ্যে কিছু উপাদান ক্যান্সার সৃষ্টি করে, ফুসফুস এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি অনেক বৃদ্ধি করে। ই-সিগারেটের ব্যবহার বুদ্ধি বিকাশ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। ই-সিগারেট গর্ভবতী নরীদের ভ্রƒণ বিকাশ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। পথচারীদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ ই-সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়া। এজন্যই শিশু, অধূমপায়ী এবং জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সিগারেট কোম্পানির নতুন মরণফাঁদ ‘ই-সিগারেট’ নিয়ন্ত্রণে দ্রুততম সময়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএই)। অবস্থা বেগতিক দেখেই ডব্লিউএইও ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সদস্য দেশগুলোর কাছে এ আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশে ই-সিগারেটের ব্যবহার কম হলেও কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় কিশোর-তরুণদের মধ্যে যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! বিভিন্ন গবেষণা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে বিএটিসহ কয়েকটি সিগারেট কোম্পানি দেশে সুকৌশলে ই-সিগারেট বাজারজাত করতে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ মনে করে অনেকে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে। এমনকি গ্রামাঞ্চলেও ই-সিগারেট বিপণন, ব্যবহার বাড়ছে। আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে এবং ধূর্ত সিগারেট কোম্পানিগুলো সুযোগ নিচ্ছে। অন্যদিকে ফ্যাশন হিসেবে উঠতি বয়সিদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার বাড়ছে। কেননা ই-সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এসব পণ্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে থাকে। যা তরুণ ও উঠতি বয়সিদের আকর্ষণের মূল কারণ। টিসিআরসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ই-সিগারেট দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক গড়ে তোলা হয়েছে শুধু তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য।
আমেরিকার গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১৭ থেকে ২০১৮ মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুলপড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। হাইস্কুল পড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে, কারণ এসব স্বাদ বা গন্ধ তাদের পছন্দ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশভুক্ত অঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ১৩-১৫ বছর বয়সিদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার বেশি। কানাডায় ২০১৭-২০২২ সময়কালে ১৬-১৯ বছর বয়সিদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ইংল্যান্ডে (যুক্তরাজ্য) গত তিন বছরে তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে।
বস্তুত ই-সিগারেট একটি কৃত্রিম সিগারেট, যা আগুন ধরানো ছাড়াই টান দিলে ধোঁয়া বের হয়। বর্তমানে বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ/গন্ধযুক্ত ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস পাওয়া যায়। ই-সিগারেট নেশা উদ্দীপক এবং মাদকাসক্ত করে। ভ্যাপিং ব্যবহারকারীদের শরীরে ডোপামিন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা মস্তিষ্কে প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি দিতে থাকে। ফলে ব্যবহারকারীর মস্তিষ্ক ভ্যাপরকে প্রশান্তিদায়ক উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে এবং এর থেকে এক প্রকার আসক্তি সৃষ্টি হয়। ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণ যেমন : প্রোপোলিন, গিøসারিন, পলিইথিলিন গøাইসল, বিভিন্ন ফ্লেভার ও নিকোটিন গরম হয়ে উৎপাদিত ফরমালডিহাইড মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন ক্ষতিগ্রস্ত করে। ই-সিগারেটের ধোঁয়া থেকে যেসব রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে আসে তা অন্যান্য স্বাভাবিক তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যেও রয়েছে, তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব আসল সিগারেটের চেয়ে কম নয়। জাপানে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকর! ভেপ, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথের শিকার হতে পারেন। জার্নাল অব আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজির এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ই-সিগারেটে ব্যবহৃত তরল রক্তনালির কোষগুলো অকার্যকর করে, যা থেকে হৃদরোগের সৃষ্টি হয়। ভেপ, ই-সিগারেট ব্যবহারে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৭১ শতাংশ, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে ৫৯ শতাংশ! শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক ই-সিগারেটের নিকোটিন। ই-সিগারেটে থাকা নিকোটিন শুধু শ্বাসনালির মিউকাসের ক্ষতি করে না, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে (আমেরিকান জার্নাল অব রেসপিরেটরি অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন)। ই-সিগারেটে ব্যবহৃত হয় শক্তিশালী ব্যাটারি, যা দিয়ে তাপ উৎপন্ন করা হয়। এই ব্যাটারির বিস্ফোরণ হয়ে এর ব্যবহারকারীর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এমন ঘটনাও ঘটেছে নিকট অতীতে। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের সেন্ট পিটার্সবার্গে ই-সিগারেট বিস্ফোরিত হয়ে টলম্যাজ ডি’ইলা নামে ৩৮ বছর বয়সি একজন নিহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে উইলিয়াম ব্রাউন নামে ২৪ বছর বয়সি এক তরুণ মৃত্যুবরণ করে ভেপ বিস্ফোরিত হয়ে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ই-সিগারেট ব্যবহার ১ শতাংশের কম হলেও উদ্বেগজনক হারে তা বাড়ছে! ই-সিগারেট উৎপাদন, বাজারজাতকরণে আকর্ষণীয় ডিভাইস, রং ও বিভিন্ন স্বাদের ফ্লেভার যুক্তকরণ, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে প্রচারণা চালাচ্ছে। নাটক, সিনেমা, চলচ্চিত্রেও অহরহ ই-সিগারেট ব্যবহারের দৃশ্য প্রচার করা হচ্ছে। এসব ক্ষতিকর দ্রব্য অনলাইনে খুব সহজেই কিনতে পাওয়া যায়, ফলে তরুণদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। অপরদিকে বাংলাদেশকে ‘ই-সিগারেট হাব’ হিসেবে ব্যবহারে আমদানি আদেশ পাস ও বৈধতা দিতে সিগারেট কোম্পানিগুলোর দৌড়ঝাঁপ এবং অপকৌশল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে আশঙ্কা রয়েছে যে, বিদ্যমান তামাকজনিত সমস্যাগুলোর সঙ্গে ই-সিগারেট মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যে তরুণরা ই-সিগারেট ব্যবহার করে পরবর্তীতে সিগারেট ব্যবহার করার সম্ভাবনা প্রায় ৩ গুণ বেশি। আবার অনেকে ই-সিগারেটের সঙ্গে ধূমপানও করে থাকেন, যা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। শুধু ধূমপায়ীদের তুলনায় দ্বৈত ব্যবহারকারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০০% বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮% ধূমপায়ী। অর্থাৎ তারা ধূমপান দিয়েই নেশা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে ই-সিগারেটও মাদকের নাটের গুরু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সুতরাং ই-সিগারেট বন্ধে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিশ্বের ১২১টি দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ এবং বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে ৩৯টি দেশ। ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে দেশে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট আইন-নীতি নেই, উপরন্তু অসচেতনতা রয়েছে। আশার কথা হলো- তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর তৎপরতায় বাংলাদেশেও কাজ হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে ই-সিগারেট বা ভেপিংয়ের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধের পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তরুণদের নিয়ে স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ে তোলার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা পূর্ণতা পাবে, যদি আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ অর্জন করতে পারি। সেই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন নস্যাৎ করতে চায় সিগারেট কোম্পানিগুলো। সুতরাং তাদের মুনাফার পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানতে এবং ই-সিগারেট নিয়ে মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা বন্ধ করা জরুরি। অনতিবিলম্বে ভেপ, ই-সিগারেট, হিটেট টোব্যাকো বা ইমার্জিং টোব্যাকো আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলে নতুন সমস্যা ঘাড়ে চাপার আগেই সমাধান এবং সার্বিক মঙ্গল বয়ে আনবে। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ ও সুদৃষ্টি কামনা করছি।

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়