ভারতীয় হানি ট্র্যাপ চক্রের ২ এজেন্ট গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

রংপুরে তিনটি নির্বাচনী জনসভায় নৌকায় পক্ষে গণজোয়ার তুললেন শেখ হাসিনা : বাহে, হামাক একখান ভোট দিবা

পরের সংবাদ

নির্বাচন রোধ আন্দোলনে অদৃশ্যে বিএনপি, দৃশ্যপটে যুগপৎকারীরা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিএনপিসহ ৩০ এর অধিক নামসর্বস্ব দল আগামী নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনে রয়েছে। তবে বিএনপি দৃশ্যপটে নেই। বিভিন্ন জায়গায় চোরাগোপ্তা হামলা, মিছিল ও বক্তৃতার ফটোসেশন করে তারা কেটে পড়ে। এভাবেই ২৯ অক্টোবর থেকে চলে আসছে। আন্দোলনের কর্মসূচি বিএনপি ঘোষণা করে। যুগপৎ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে হিসাব কষে দেয় কিনা সন্দেহ আছে। হরতাল- অবরোধে এ পর্যন্ত ৫০ এর অধিক দিন কেটে গেছে। নির্বাচনের এখন বাকি আছে ১২ দিন। হরতাল-অবরোধ বিএনপির পক্ষ থেকে যাই ডাকা হোক না কেন, যুগপৎ আন্দোলনকারী অন্য দলগুলো তাই মেনে নিয়ে থাকে। যদিও হরতাল-অবরোধ শুরু থেকেই জনগণের তেমন কোনো সমর্থন পায়নি। তারপরও কর্মসূচির বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হচ্ছে। ঢাকায় ২-৪টি বাসে প্রতিবারই আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকে। তারপরও বাস, ট্রাকসহ সব ধরনের যানবাহন চলছেই। যাত্রীবাহী বাস-ট্রাকে সুবিধা করতে না পেরে এখন রেললাইনের চড়াও হয়েছে। বেশ কিছু বগিতে আগুন ধরানো হয়েছে, অনেক জায়গায় লাইন কাটা, ফিশপ্লেট উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। সর্বশেষ তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে তিনটি বগিতে ভোররাতে আগুন জ¦ালানো হলে তাতে এক কামরাতেই ৪ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এর মধ্যে মা এবং শিশুর অগ্নিদগ্ধ দৃশ্য সারাদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে, এ কোন হায়েনার কাজ? বেশ কিছু অগ্নিসংযোগকারীকে এ পর্যন্ত আটক করা সম্ভব হয়েছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় জানা গেছে। বেশির ভাগই ছাত্রদল এবং যুবদলের নেতাকর্মী এসব পোড়াপুড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এছাড়া কিছু ভাড়াটে সন্ত্রাসীকেও পোড়াপুড়ির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার পর বারবার বলা হচ্ছিল, যে নতুন কর্মসূচি আসছে। বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী আহমেদ অনলাইনে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বুধবার অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়ার পর সব মহলেই কর্মসূচির ব্যাপারে বিএনপি যে বড়ই বিপাকে আছে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অবরোধের মতো কর্মসূচি সাধারণত যখন গোটা দেশের জনগণ প্রধান নেতার ডাকে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায় যে কোনো কর্মসূচি পালনে, তখনই কেবল সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে কোন প্রেক্ষাপটে অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন, তা বয়স্ক নাগরিকরাই শুধু নয়, স্কুল পড়–য়া ছাত্রছাত্রীরাও কমবেশি জানে। ’৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অসহযোগের ডাক দেন। বেগম খালেদা জিয়া তখন রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। দুইবার অসহযোগ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থাকার পর বিএনপি ২০ তারিখ যখন অসহযোগের ঘোষণা দেয়; সঙ্গে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ রাখা, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিল বন্ধ রাখা, সরকারি অফিস-আদালতে কাজ না করে সরকারকে সহযোগিতা না করা, এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে যারা কোর্ট-কাচারিতে হাজিরা দিতে যান, তাদের না যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তখন বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেই এসব কিছু বাস্তবায়ন করা যে সম্ভব নয়, সে কথা উচ্চারিত হতে থাকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনকারী বেশ কিছু দল বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি পালনের জন্য প্রতিদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সম্মুখে, তোপখানা রোড, বিজয়নগর এই এলাকায় যার যার সমর্থক কয়েকজনকে নিয়ে বক্তৃতা করেন, সরকার উৎখাতের নানা সবক দেন। এককথায় যাদের বিএনপির ডাকা আন্দোলনের আউটসোর্সিংকারী হিসেবে অনেকে অভিহিত করে থাকেন। তাদেরও যখন বলা হয়ে থাকে, অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির প্রতি তাদের কী মনোভাব? তাদের উত্তর প্রায় একই। তা হচ্ছে, ‘নীতিগতভাবে আমরা সমর্থন করি, তাই রাস্তায় কর্মসূচি পালনের জন্য জনগণের কাছে প্রচার করি।’
যুগপৎ আন্দোলনকারী এসব দলের অনেক নেতাকেই মানুষ খুব একটা চিনত না। এখন বেসরকারি টেলিভিশনগুলো তাদের ডাকেন, তারা তাদের কথা বলেন, তাদের পরিচয় জানাতে পারেন। তবে তাদের আলোচনা এ পর্যন্ত যারা শোনেন, তাদের কাছে সবকিছুই মনে হয় কে কি বলবেন বা বলবেন না, তা নতুন করে শোনার খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। অনেকটাই যেন মুখস্ত বিদ্যা ঝেড়ে যাচ্ছেন। যেমন প্রায় সবাই ২৮ তারিখের ঘটনাকে সরকারের কোনো না কোনো বাহিনী দ্বারা সংগঠিত করা হয়েছে বলে দাবি করেন। তারা কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস করেন না, ওই দিন পুলিশ হত্যাকারীরা ছাত্রদল বা যুবদলের চিহ্নিত নেতাকর্মী ছিল। প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ অন্যান্য স্থাপনায় আক্রমণ, গাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়া, সাংবাদিকদের পেটানো, পুলিশের ৯টি অস্ত্র কেড়ে নেয়া ইত্যাদি ঘটনাগুলোও তারা বিএনপির নেতাকর্মীদের দ্বারা সংগঠিত ঘটনা- এমনটি স্বীকার করতে নারাজ। তারা দাবি করেন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে প্রমাণ না করা পর্যন্ত বলা যাবে না ওই সব ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কেউ জড়িত ছিলেন। অথচ সিসিটিভিতে ব্যক্তির ছবি যখন দেখা যায়, তখন সেটিকে কীভাবে চিহ্নিত করার জন্য বিচার বিভাগীয় কমিশনের প্রয়োজন পড়বে? জো বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টার কথা এখন আর কোনো সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন না। জিজ্ঞাসা করলে হয়তো তাদের বক্তব্য জানা যেত। বিভিন্ন বাসে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে কারা জড়িত এই প্রশ্নেরও উত্তরে তারা নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করেন। তাদের একটিই কথা, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীরা কেন পুলিশ মারতে যাবে, সাংবাদিক পেটাতে যাবে কিংবা অন্য যেসব পোড়াপুড়ি, মারামারির ঘটনা ঘটেছিল সেগুলো করতে যাবে? রেললাইন কাটাকাটি, বগি পোড়ানো এবং মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগিয়ে মা-ছেলেসহ চারজনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা নিয়েও অনেকটা একই কথা তাদের মুখ থেকেই শোনা যায়। অবরোধ এবং হরতালের দিন তাদের বক্তৃতার যে ছবিটি ধারণ করা হয় এবং তাতে যে বক্তব্য থাকে সেটি শুনলে মনে হয়, গোটা বাংলাদেশের সাড়ে ১৭ কোটি মানুষকে তারা হাজেরনাজের করে কথা বলছেন। অথচ এই দলগুলোর নামই এ দেশের মানুষ আগে জানত না। নেতাকর্মীও কি আছে বা নেই, তাও খুব একটা জানা নেই। ১৯ শতকে রাশিয়ায় একটি রাজনৈতিক দল জারের বিরুদ্ধে গোপনে আন্দোলন করছিল, দলটির নাম ‘নারোদনিক’। রুশ ভাষায় ‘নারোদ’ শব্দের অর্থ জনগণ, ‘নারোদনিকের’ অর্থ জনগণের। রুশ নেতা লেনিন ওদের সম্পর্কে বলেছিলেন ওদের নামে জনগণ আছে, কিন্তু জনগণ ওদের সঙ্গে নেই। আমাদের দেশে বড় বড় রাজনৈতিক দলের পেছনে এখন অসংখ্য নামধারী রাজনৈতিক দলের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। তারা বড় বড় রাজনৈতিক দলের আউটসোর্সিং করছেন, নিজেদের পরিচয়টা অন্তত দেশে সামাজিক গণমাধ্যম এবং টিভি-টকশোর মাধ্যমে দেয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে একদিন হয়তো এই সুবাদে দেশের মানুষ কাউকে না কাউকে চিনতেও পারবে, গ্রহণও করতে পারে! কিন্তু আপাতত এদের সংখ্যা যাই থাকুক, এদের পেছনে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই, সমর্থনও নেই। কিন্তু তারা প্রতিদিনই আমাদের জনগণ জনগণ বলে আর্তনাদ করে বেড়াচ্ছেন। জনগণের খবর তারাই রাখেন, গণতন্ত্রও তারাই বোঝেন, বাংলাদেশ তারাই ভালোবাসেন, এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। বিদেশিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে, বাংলাদেশ ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে, কূটনীতিতে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে যাচ্ছে। আরো কত কি কান পাতলে শোনা যায়! বিএনপি যাই ঘোষণা করে, তাই যারা পালন করার জন্য ঢাকার নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিদিন চেঁচামেচি, চিৎকার করেন আর টকশোতে এসে নীতিগত সমর্থন জানিয়ে কথা বলে মনে করেন যে তাদের কথা শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যান। মুগ্ধ হওয়ার মতো রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ একমাত্র স্বাধীনভাবে যেসব দল গ্রহণ করে থাকে, জনগণের বিষয়আশয় তুলে ধরেন, দেশের সমস্যা ও সমাধানের পথ বাতলানোর মতো কর্মপরিকল্পনা থাকে, তাহলেই কেবল সেই বক্তার আলোচনা শোনার জন্য উপযুক্ত হয়।
একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের দেশে একসময় অনেক ত্যাগী নেতা দু-একটি দেশপ্রেমিক বাম রাজনৈতিক দলে ছিলেন। তাদের যেমন ছিল সততা, দেশপ্রেম এবং বাস্তবোচিত জ্ঞান। সে কারণেই তাদের এখন পর্যন্ত অনেকে চেনেন, তাদের লেখা কিছু বইপত্র পড়ে রাজনীতির ইতিহাসটাও কিছুটা জানা যায়। কিন্তু ওই সময়ই আরো অসংখ্য বাম নামধারী রাজনৈতিক দল এবং নেতা ছিলেন, যারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কিংবা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হননি, নানা ধরনের তত্ত্ব নিয়ে তর্কে লিপ্ত হতেন, নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, বিভাজন তৈরি করেছেন। নিজেদের তারা বাম বললেও বাম রাজনীতির সামান্যতম সংস্কৃতিটা তাদের জীবনবোধ ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিল না। স্বাধীনতার পরও অনেকেই বাম বলে অনেক কিছু বলেছেন। কিন্তু তাদের বামজ্ঞান ডানেই পড়েছিল। কারো কারো ঠিকানা শেষ পর্যন্ত ডানে হয়েছে। আর অসংখ্য তরুণ-তরুণীর জীবন তাদের খপ্পরে পড়ে শেষ হয়েছে। সেই বামরা এখন ভাঙতে ভাঙতে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখার পর্যায়ে চলে গেছে। বলেন তারা বাম, আসলের তারা ডানে আউটসোর্সিং করেন, কোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন হয়তো। কিন্তু মহৎ বামতত্ত্ব ধারণ করার মতো যে বিদ্যাবুদ্ধি, লেখাপড়া ও বিশ্ববাস্তবতা সম্পর্কীয় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, তা কতটা তাদের রয়েছে সেটি তাদের টকশোর আলোচনা আর মাঠের চেঁচামেচি থেকে আন্দাজ করার কোনো উপায় নেই। বইপুস্তক লেখার তো তাদের অভ্যাস নেই, পড়ার অভ্যাস কতটা আছে জানি না। কিন্তু বামরা অনেক আগে থেকেই ডানের কাছে আত্মসমর্পণ করে আছেন। সেই তালিকা অনেক দীর্ঘ। এখন যারা আছেন, তারা প্রায় সবাই ডানেই আছেন। যদিও তারা তা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু তাদের পার্টি কংগ্রেসে সব সময়ই যে কথাটি বলা হয় তা হচ্ছে, ‘আমাদের আগে এসব ভুল হয়েছিল, ডানের দিকে ঝোঁক ছিল। এখন সেটিকে শুধরে সামনের দিনগুলোতে আমরা সঠিক লাইনে রাজনীতি করব।’ স্বাধীনতার পর থেকে বহু বাম রাজনৈতিক দলের মুখ থেকে কিংবা লেখালেখি থেকে এ কথাই শুনে এসেছি, দেখে এসেছি। এখন নির্বাচন নিয়েও অসহযোগ নীতিগতভাবে সমর্থন দিচ্ছে বামেরা। কিছুদিন পরেই এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে তারাই স্বীকার করবে। তবে অসহযোগের পর লন্ডন থেকে আন্দোলনে আর কী যোগ করা হবে, সেটি দেখা ও শোনার অপেক্ষায় আছি।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়