ভালা জার্নালিস্টস ফোরাম : সভাপতি রুমেন পরশ সাধারণ সম্পাদক

আগের সংবাদ

নাশকতার টার্গেট এখন রেল

পরের সংবাদ

যেন সত্যের সন্ধানে নিবেদিত প্রাণ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যুদ্ধ কখনো কোনো জাতির জন্য আশীর্বাদ হতে পারে না। তাই যুদ্ধকে না বলাই শ্রেয় বলে জ্ঞানীজন মনে করেন। ধর্মের কারণে, ক্ষমতার আধিপত্য দেখানোর জন্য, কিংবা মাতৃভূমির নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধ হলেও বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ চায় না এখানে নিরপরাধ শিশু, সাধারণ মানুষ ও নারীদের হত্যা করা হোক। মাতৃভূমিকে রক্ষা করা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। তাই লড়ে যাচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু ফিলিস্তিন জাতি দীর্ঘদিন ধরে। যদিও আন্তর্জাতিক সমর্থন তারা এখনো পুরোপুরি লাভ করতে পারেননি। কিন্তু তারা লড়ে যাচ্ছেন দৃঢ় মনোবল নিয়ে। তারা জানেন বিজয় একদিন আসবে, কিন্তু সেটির জন্য কত প্রাণ আর কত রক্ত তাদের দিতে হবে তারা তা জানেন না। যেন সত্যের সন্ধানে নিবেদিত প্রাণ। ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর ফিলিস্তিনে বোমাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েল। যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার অনেক এলাকায় পুনরায় হামলা শুরু করেছে এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্থল ইউনিট উত্তর গাজা উপত্যকার অন্যান্য অংশে অনুপ্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর গড়িমসির কারণে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং ইহুদিবাদীরা যুদ্ধ বিরতি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজায় তাদের হামলার মাত্রা তীব্র করে। গাজা উপত্যকার দক্ষিণে খান ইউনিসে অবস্থিত আল-কাররাহ এলাকার আবাসিক ঘরবাড়িতে পুনরায় হামলা শুরু করেছে। ইসরায়েল বাড়িঘর, হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবিরসহ পুরো গাজায় নির্বিচার বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে গাজায় অসংখ্য শিশু পরিবারের সবাইকে হারাচ্ছে। শুধু তাই নয়। নিজেরাও হচ্ছে পঙ্গু। এমনো আছে অনেকের দুহাত বা দুই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এখন যেন তাদের কাছে বেঁচে থাকা মানে অভিশাপ মনে হচ্ছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। এই হামলায় ফিলিস্তিনের ২৮০ জন স্বাস্থ্যকর্মী এবং জাতিসংঘের ১৩০ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের ইতিহাসে কোনো একক সংঘাতে এটি সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৭ জন কর্মী আহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে ইউএনআরডব্লিউএ।
তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেছেন, গাজার দক্ষিণাঞ্চল থেকে তাদের চিকিৎসা সরঞ্জাম সরিয়ে নিতে বার্তা দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এদিকে হামলায় আহত ব্যক্তিরা পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পাওয়ায় প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছেন। একের পর এক বোমা হামলায় কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিক মোয়ামেন আল শরাফির পরিবারের ২২ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। আল শরাফি আল জাজিরাকে বলেছেন, হামলার সময় একটি বিস্ফোরক ব্যারেল বাড়িটিতে আঘাত করে এবং এর ফলে মাটিতে গভীর গর্ত তৈরি হয়। তিনি আরো বলেন, সিভিল ডিফেন্স ক্রুদের কেউ নিহতদের মৃতদেহের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। আমাদের প্রিয়জনকে বিদায় জানানো থেকে বাধা দেয়া হয়েছে এবং তাদের যথাযথভাবে কবর দেয়া থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এখানে বিশ্বের মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম মূলত চোখে পড়ছে না। মার খেয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে অসহায় মানুষগুলো তবুও যেন অনেকে নীরবতা পালনে বিশ্বাসী হয়ে বসে রয়েছেন। এদিকে গণমাধ্যম সূত্রে আরো জানা যায়, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিসে একটি বিদ্যালয়ে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে অন্তত ২৫ জনের প্রাণ যায়। নিহত মানুষের এ সংখ্যা জানিয়েছে হামাস নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারা জানিয়েছে, ওই বিদ্যালয়ে গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষরা আশ্রয় নিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলায় অনেকে আহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে অনেককে উদ্ধার করে স্থানীয় নাসের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খান ইউনিস। কয়েক দিন ধরে শহরটিতে নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল বাহিনী। এখানে হামলায় মোহাম্মদ সালোউ নামে এক ব্যক্তির বোন নিহত হয়েছেন। তিনি এএফপিকে বলেন, আমার এক ভাই আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমার বোনের দেহ পড়ে আছে। আমরা তাকে উদ্ধার করতে পারিনি। তবে আমার ওই ভাই পরে বোনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মোহাম্মদ সালোউ বলেন, আসলে স্কুল শুধু নয়, আশপাশের এলাকাগুলোও হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ বলেছে, অবরুদ্ধ ও সংকীর্ণ গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে চলমান যুদ্ধে ৮০ শতাংশই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ গেছে ১৯ হাজার মানুষের। গাজায় নির্বিচার হামলায় ৬০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে, চলমান সংঘাতে বেসামরিক মানুষদের ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে হামাস। সংগঠনটির যোদ্ধারা বাস্তুচ্যুত মানুষদের মধ্যে আত্মগোপন করে রয়েছেন। এমনকি হাসপাতাল আর বিদ্যালয়েও লুকিয়ে রয়েছেন তারা। হামাস বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এদিকে হাসপাতালগুলোর অবস্থা এখন আরো ‘নাজুক’ বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (টুইটার) এক পোস্টে বলেন, শনিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল নাসের মেডিকেল হাসপাতালে যায়। সেখানে ৩০০ রোগীর জায়গায় ১ হাজারের বেশি রোগী রয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে অবিরাম বোমা ফেলে নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে। এ ঘৃণ্য গণহত্যাকে আরো উসকে দিয়েছে হোয়াইট হাউস। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে নজিরবিহীনভাবে ৩৮০ কোটি ডলারের জরুরি সামরিক ও সাধারণ সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। তড়িৎ গতিতে সেটা দেয়া হয়েছে। ৭ অক্টোবর চালানো হামাসের হামলাকে ইসরায়েলের ‘নাইন-ইলেভেন’ বলে আখ্যায়িত করা বাইডেনসহ মার্কিন কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য বিবেচনায় নিলে ফিলিস্তিন ও মুসলিমদের ওপর চালানো দমন, পীড়নের সঙ্গে পশ্চিমের কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের যোগসাজশ দেখাটা মোটেও অমূলক হবে না। মুসলমান, আরব ও ফিলিস্তিনিদের নিশানা করে পীড়ন চালানো ও তাদের ওপর নজরদারির শুরুটা নাইন-ইলেভেন হামলার পর হয়েছে, তা নয়। ২০২১ সালে প্রজেক্ট সাউথের ‘স্পাইয়িং অন দ্য মারজিনস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী নজরদারি তৎপরতার ইতিহাস নথিপত্রসহ তুলে ধরা হয়। সেখানে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই তারা এ চর্চা করে আসছে বলে বলা হয়েছে। ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে যে নকশা কাঠামো দাঁড় করিয়েছে, তাতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকা লোকজনের ওপর নজরদারিতে সর্বোচ্চ জোর দেয়া হয়েছে। এ কারণে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়ে মুখ খোলা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো যে এফবিআই ও অন্যান্য সংস্থার বিশেষ নজরদারিতে থাকবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নাইন-ইলেভেন হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র গণজরদারির যে কাঠামো করেছে, তা নাগরিক অধিকারকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। বিশেষ করে মুসলিম এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার লোকজনের সঙ্গে তারা এমন আচরণ করেছে, যা মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এসব নাগরিকের ব্যক্তিগত প্রোফাইল চরম বৈষম্যমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়েছে। গায়ের চামড়ার রং দেখে, বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসী পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের সম্পর্কে আগেভাগেই নেতিবাচক ধারণা নিয়ে রাখা হয়। ২০ বছর আগের সেই নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সরেনি। ফিলিস্তিন, আরব ও মুসলিমদের পাশাপাশি কৃষ্ণাঙ্গদের বিষয়ে ভয়ংকর ভাষ্য দাঁড় করানো হয়েছে। সেই ভাষ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অনেক নাগরিক আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। কালোদের জীবনেরও দাম আছে, এই বার্তা দেয়া ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন দমানোর ঘটনা তার একটি বড় উদাহরণ। ফ্লোরিডার গভর্নর রন স্যান্টিস ফিলিস্তিনিপন্থি ছাত্রসংগঠন স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন ফিলিস্তিনকে ওই অঙ্গরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে নিষিদ্ধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ হিসেবে বলা হচ্ছে, তারা সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যুক্তরাষ্ট্র কখনো চাইবে না ফিলিস্তিন স্বাধীন হোক। তাই ফিলিস্তিনিদের বিশ্ব সমর্থন আদায় করতে হয়তো আরো অনেক সময় লেগে যেতে পারে। কিন্তু তাদের যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে তা কখনো ধ্বংস হবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছেন, ফিলিস্তিনের হামাস একটি চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের নাম, এটাকে ধ্বংস করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওয়েবসাইটে তার এই বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, আপনি একটি বিশ্বাস বা চিন্তাধারাকে মুছে ফেলতে পারবেন না, যদি না প্রমাণ করতে পারেন আপনার কাছে এর চেয়ে উত্তম চিন্তা বা বিশ্বাস রয়েছে। বোরেলের মতে, আন্তর্জাতিক উপাদানের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনিদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ সময় তিনি ৫ হাজারের বেশি শিশু হত্যার নিন্দা জানান। এদিকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসানে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে এগিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। বিশ্ব সংস্থা বলেছে, দুই দেশেরই রাজধানী হবে জেরুজালেম। জেনেভায় জাতিসংঘ কার্যালয়ের মহাপরিচালক তাতিয়ানা ভালোভায়া মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এতে বলা হয়, জাতিসংঘের প্রস্তাব ও আন্তর্জাতিক আইনের ওপর ভিত্তি করে অপরিবর্তিত রূপে চূড়ান্তভাবে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাতিয়ানা বলেন, জেরুজালেমকে রাজধানী বানিয়ে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা পাশাপাশি শান্তি ও নিরাপদে বসবাস করবে। জাতিসংঘ মহাসচিব সংঘাত শুরুর পর বিভিন্ন সময় দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলেছেন। এ ছাড়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও একই কথা বলেছেন। তাই এখন অপেক্ষার পালা। সময়ই বলে দেবে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথা।

ড. আজিজুল আম্বিয়া : কলাম লেখক ও গবেষক।
[email protected].

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়