নীরব-মজনুসহ বিএনপির ৪৭ নেতাকর্মীর কারাদণ্ড : নাশকতার তিন মামলা

আগের সংবাদ

অপশক্তিকে রুখে দেয়ার অঙ্গীকার : বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ

পরের সংবাদ

বিজয় ও উন্নয়নের অভিযাত্রায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ২৯ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১০০ বছর বয়স অতিক্রম করে মৃত্যুবরণ করলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির মহিরুহ ছিলেন অবশ্যই, কিন্তু তার হাতে রয়েছে নিহত লাখো মানুষের রক্তের দাগ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবে, বাঙালিদের নয়- এ সিদ্ধান্ত এক বছর আগেই নিয়ে রেখেছিলেন কিসিঞ্জারের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট নিক্সন। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে, সেনা মোতায়েন হচ্ছে, এ কথা কিসিঞ্জার খুব ভালো করেই জানতেন। ১৩ মার্চ নিক্সনের কাছে এক মেমোতে তিনি পরামর্শ দিলেন, ‘এখন এমন কিছুই আমরা করব না, যা ইয়াহিয়া আপত্তিজনক মনে করেন। পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে আমাদের উচিত ইয়াহিয়ার সঙ্গে থাকা।’ ঢাকায় ২৫ মার্চ গণহত্যায় কিসিঞ্জার মনে মনে খুশি হয়েছিলেন। ২৯ মার্চ নিক্সনকে জানালেন, মনে হয় ইয়াহিয়ার গৃহীত ব্যবস্থায় কাজ হয়েছে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এখন ইয়াহিয়ার নিয়ন্ত্রণে।’ সে কথা শুনে নিক্সনের জবাব ছিল, ‘চমৎকার। মাঝে মধ্যে শক্তির ব্যবহার কাজে লাগে।’ এরপরে পাকিস্তানিদের হাতে গণহত্যার খবর পত্রপত্রিকার প্রকাশিত হতেই ১৯ এপ্রিল এক মেমোতে তিনি লিখলেন, পাকিস্তানের প্রতি সাহায্য বন্ধের যে দাবি উঠেছে, তিনি তার বিরুদ্ধে। ভবিষ্যতে নিজের স্মৃতিকথায় কিসিঞ্জার যুক্তি দেখিয়েছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন আমেরিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আর সে সম্পর্ক স্থাপনে ‘একমাত্র’ সূত্র ছিল পাকিস্তানের ইয়াহিয়া। কথাটা যে সর্বৈব মিথ্যা তা পরে প্রমাণিত হয়েছে।
আজ বেঁচে থাকলে তিনি নিশ্চয় গভীর আত্মগøানি বোধ করতেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানকে একটি গোটা নতুন দেশ হতে দেখে একান্ন বছর আগে তিনি উপহাস করেছিলেন ‘আ বটমলেস বাস্কেট কেস’ বলে। অথচ আজ বাহান্ন বছরের স্বাধীন জীবন পার করে বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিশ্বপৃথিবীতে একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না। বাইরের এবং ভেতরের নানা গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ- সব মোকাবিলা করে আজ বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে তার যে সাফল্যময় অবস্থান, বহু উন্নয়নশীল দেশকে তা আত্মজিজ্ঞাসার আবর্তে নিক্ষেপ করতে পারে। গত তিন দশকে বিশ্বে সবচেয়ে স্থিতিশীল উন্নয়ন-গতিরেখা ধরে এগিয়েছে যে দেশ- বাংলাদেশ তার মধ্যে উঁচু জায়গা নিয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জিডিপির বৃদ্ধির হারের নিরিখে সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে। এ যদি অর্থনীতির কথা হয়, রাজনীতির দিকটিও কম চমকপ্রদ নয়। আগামী ২০২৪ সালের প্রস্তাবিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে একটানা চতুর্থ বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরল সম্মান লাভ করবেন শেখ হাসিনা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়িয়ে গৌরবসহকারে বলাই যায় যে, বিশ্বের দীর্ঘতম শাসনকারী মহিলা প্রধানমন্ত্রী হলেন এক বাঙালি কন্যা- শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। অত্যাশ্চর্য সব বাধা তাকে পেরোতে হয়েছে, দশকাধিক কাল ধরে তিনি প্রাণনাশের হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে, অসামান্য দক্ষতায় দেশ শাসন করছেন। তার ‘ভিশন ২০৪১’ ইতিমধ্যেই দেশ-বিদেশে যথেষ্ট বাস্তবসম্মত বলে স্বীকৃত। এই ভিশনের প্রধান কথা : বাংলাদেশ তত দিনে একটি ‘উন্নত’ দেশ হবে এবং দারিদ্র্য ফাঁদ থেকে সে দেশ মুক্ত হবে।
পদ্মা সেতু, কর্ণফুলীর সুড়ঙ্গপথ, মেট্রো রেল চালুর মতো নজরকাড়া উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রগতির একটা বড় বিজ্ঞাপন নিঃসন্দেহে। কিন্তু বিজয়ের পর থেকে আজকের বাংলাদেশ এগিয়েছে কোন পথে? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে যে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র আবাসভূমি অর্জিত হয়েছিল, তার প্রধান রসদ বাংলার মুসলিমরাই জুগিয়েছিল। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন পাকিস্তানে শিগগিরই তারা বুঝতে পারে, বাঙালিদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা এখনো অর্জিত হয়নি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, ৬০-এর দশকে এসে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা স্ব-শাসনের দাবিতে রূপ লাভ করে। ৭০-এর নির্বাচনে জনতার দেয়া ম্যান্ডেট মেনে নিতে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের অস্বীকৃতি আগুনে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে। অগণিত শহীদের আত্মত্যাগ ও অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অবশেষে দেশ স্বাধীন হলো। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর মধ্যে ফিরে এলেন। দেশ মুখোমুখি হলো এক নতুন অথচ কঠিন চ্যালেঞ্জের। যুদ্ধের শেষের দিকের দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের ওঠা-নামার কাহিনি প্রত্যেকেই জানেন। যতবার দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছে, ততবারই দুর্নীতি নামের ব্যাধি বাংলাদেশকে পশ্চাতে টেনে নিয়ে গেছে। তাই এখন দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়াও স্বাধীনতা অর্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা ও অর্থনীতিতে সামনের সারিতে থাকা শ্রীলঙ্কান অর্থনীতির দেউলিয়াত্বের ব্যাপারে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কখনই পড়বে না। কিন্তু ঘটনাটা বাংলাদেশের মতো ছোট আয়তনের দেশকে মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে আজ বিরোধী রাজনীতি কখনই দানা পাকিয়ে ওঠেনি। এর জন্য বাংলাদেশের একটি বড় সংখ্যার মানুষ শাসক দলকে দায়ী করেন। কিন্তু বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিরোধী দলের সে দায়-দায়িত্ব আছে এবং গঠনতান্ত্রিক ভূমিকা আছে সেই দায়িত্ব বাংলাদেশের বিরোধী দল সাম্প্রতিককালে সেভাবে মনে রাখছেন না। তাদের কার্যকলাপ বাড়ছে নির্বাচন আসার আগে। প্রশ্ন উঠছে সুশাসন নিয়ে। সুশাসনের নির্ধারণ কীভাবে হয়? উচ্চ প্রবৃদ্ধি অবশ্যই। কিন্তু শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সূচকগুলো একটা বড় ভূমিকা পালন করে। পদ্মা ব্রিজ, রূপপুর পারমাণবিক প্লান্ট, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, উড়াল সেতু প্রভৃতি বড় বড় কাঠামো অতি অবশ্যই জাতীয় প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার বজায় রাখে। কিন্তু বাকি পরিকাঠামোর বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে দেশের ভেতরে প্রশ্ন উঠলেও আন্তর্জাতিক উঠোনে বাংলাদেশ কিন্তু তার স্থান বজায় রেখেছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা হিসেবে শেখ মুজিব ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় বাংলাদেশের আইনসভায় সে দিনের নবীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সংবিধান গ্রহণের সময় তিনি বলেছিলেন : ‘আমরা ধর্মাচরণ বন্ধ করব না… মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবেন… হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবেন… বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবেন… খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবেন… আমাদের আপত্তি শুধু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে।’ সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে হাসিনাকে প্রশ্ন করা হয়। হাসিনা জানান, ‘বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে বহু ধর্মের মানুষ বাস করেন। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকলেও একটা দুটো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যায়। আমরা যখন থেকে ক্ষমতায় আছি, তখন থেকে দেশের সংখ্যালঘুদের বলেছি যে, আপনারা দেশের নাগরিক। আপনারা নিজেদের দেশেই বসবাস করছেন। নিজেদের দুর্বল বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।’ ১৯৮৮ সালের ৫ জুন তদানীন্তন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে সংবিধানের ‘অষ্টম সংশোধনী’ যুক্ত করা হয়। নতুন ওই সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’
এ কথা স্বীকার করা ভালো যে ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতের ভূমিকার স্বীকৃতি বারেবারে ভারতকে দিয়েছে বাংলাদেশ। সে প্রশ্ন কারণে অকারণে তুলে দাদাগিরির অর্থ হয় না। তবে বিজয়ের বাহান্ন বছর পরও ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক স্তর বাদ দিলে অন্যান্য ক্ষেত্রে অবিশ্বাসের বাতাবরণ দূর হয়েছে কী? কোভিডের সময় টিকা বা আক্রার সময় পেঁয়াজ পাঠালেই এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় প্রলেপ পড়ে না। প্রয়োজন অবাধ বাণিজ্য ও সহজ ভিসানীতি। বিজয় ও উন্নয়নের অভিযাত্রায় বাংলাদেশ আজ ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং একই গতিতে এগোচ্ছে ভারত সে কথা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেলেও আমরা কতটা অনুভব করি? কতটা অনুভব করি পরস্পর পরস্পরকে? তাই দায়িত্ব শুধু সরকার বা অন্যপক্ষকে না দিয়ে সময় এসেছে আমাদেরও একটু ভাবার। সেই ভাবনাই হোক এবারের বিজয় দিবসের চিন্তার পাথেয়।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়