নীরব-মজনুসহ বিএনপির ৪৭ নেতাকর্মীর কারাদণ্ড : নাশকতার তিন মামলা

আগের সংবাদ

অপশক্তিকে রুখে দেয়ার অঙ্গীকার : বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ

পরের সংবাদ

বিজয়ের অবিনাশী অহংকার

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাস কল্পিত কাহিনি নয়। ইতিহাস যদিবা পুরনো, পেছনের, তবু তাকে কখনো গাতায়ু বলার অবকাশ নেই। কারণ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পথে সুদৃঢ় পায়ে চলতে একটি জাতির জন্য যা জরুরি- তার ভিত্তি থাকে ইতিহাসের পাতায়।
ইতিহাস যথার্থ অর্থে জাতির অহংকার ও অর্জন। এ অহংকার ও অর্জন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে শুভবুদ্ধি ও যুক্তিবাদী মানুষের সঙ্গে বোধহীন প্রাণীর পার্থক্য থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বৃহত্তর জাতীয় জীবনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন না। কিন্তু ব্যক্তি নিয়ে যে সমাজ, তার ইতিহাস সচেতনতা জরুরি। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা হয় না। কিন্তু কোনো জাতি ইতিহাস সচেতন না হলে ক্রমান্বয়ে সে বীর্যশূন্য, ঐতিহ্যশূন্য, সভ্যতাবিবর্জিত জনসমষ্টিতে পরিণত হয়।
ইতিহাসে সব জাতি-গোষ্ঠীরই কিছু দিক নির্দেশনা থাকে, থাকে এমন অনেক সত্যের খুঁটি গাঁড়া, যা থেকে ছিটকে পড়া মানেই আপন অহংকারের বৃন্ত থেকে খসে পরা। ব্রিটিশ উপনিবেশিক ব্যবসায়ীরা ২০০ বছর ধরে ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছে। এই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময়ে আমরা দুই ধরনের মানুষ দেখেছি। এক. এ দেশেরই এক শ্রেণির সেবাদাস- যারা বৃত্তির সুবিধার্থে দাসত্বকে বরণ করে নিয়েছে। দুই. আরেকটি দল- যারা নিজেদের বর্তমানকে তুচ্ছ করে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে জাতীয় মর্যাদার জন্য লড়াই করেছেন, এমনকি মৃত্যুবরণ করেছেন।
যদিও দুই পক্ষই ইতিহাসের অংশ, তবু ইতিহাসের আমোঘ নির্দেশ হচ্ছে এই- লড়াকু পক্ষকেই ঐতিহ্য বলে বরণ করে নেয়া। আরো যে শিক্ষা ইতিহাস দেয় তা হচ্ছে, সেই দাস মনোবৃত্তির মানুষের বিরুদ্ধে সতর্ক থেকে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে নির্মাণ করা। কারণ ইতিহাস শিখিয়েছে উপনিবেশবাদ আর বন্য শাসনব্যবস্থাকে ঘৃণ্য করতে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে চীনের মাটিতে জাপানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা চেপে রেখে নানাবিধ বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছিল জাপানি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে। এটি ছিল নতুন প্রজন্মের কাছে জাপানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ঢাকার অপচেষ্টা। কিন্তু সচেতন চৈনিক জাতি ইতিহাসের মিথ্যাচার মেনে নেয়নি। তীব্র প্রতিবাদ করেছে চীন। প্রতিবাদ এসেছে কোরিয়ার কাছ থেকেও। সেই প্রতিবাদের ভাষা এতই প্রবল ছিল যে সামান্য কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে জাপান বিতর্কিত পুস্তক বাজারে থেকে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান নাজি বাহিনীর বুট, বোমা ও বুলেটে ফ্রান্সের প্যারিস নগরী প্রকম্পিত হয়েছিল। হিটলার বাহিনীর নির্মমতায় রক্তস্নাত হয়েছিল ইউরোপের বহু জনপদ। লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল পোলান্ডে। নাজি বাহিনীর প্রবল বোমায় লন্ডন নগরী কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তীকালে সেই জার্মানির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক আবারো গড়ে উঠেছে। কারণ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের স্বার্থেই সম্পর্কের পুনঃস্থাপন করতে হয়।
কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, জার্মানির যুদ্ধবাজ ভূমিকাকে সবাই ভুলে গেছে। হিটলার আজো ইউরোপ তথা বিশ্বের তাবৎ জনগোষ্ঠীর কাছে নিষ্ঠুরতম যুদ্ধবাজ। নাজি বাহিনী আজ, হয়তো অনাদিকাল ধরে, পরিচিত হবে বর্বর-ফ্যাসিবাদী সেনাবাহিনীর পরিচয়ে।
যুগ ও শতাব্দীর ঘটনাপঞ্জি আশ্রয় করে ইতিহাস গড়ে ওঠে। ইতিহাস নির্মম হোক কিংবা ভালোবাসার হোক তাকে নতুন করে তৈরি করা যায় না। বাঙালি এ ভূখণ্ডে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, সে তার ইতিহাস। ধর্মের নামে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ রক্তাক্ত লড়াই করে স্বাধীনতা লাভ করেছে- এ আমাদের ইতিহাস।
ইতিহাস আরো আছে। শুধু ধর্মের বাঁধন থাকলেই এক জাতি হয় না, এর সঙ্গে অনস্বীকার্য ভাষা, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং সম্পদ বণ্টনের গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা। যে পাকিস্তান বাংলাদেশকে ২৪ বছর শাসন ও শোষণ করেছে, নির্যাতন করেছে- সে পাকিস্তানের সঙ্গে যুগের চাহিদাতেই পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে গোড়ামির স্থান নেই। কিন্তু এ সম্পর্ক কখনই ইতিহাস থেকে আমাদের বিচ্যুত করতে পারে না। এ সম্পর্ক পাকিস্তানের শোষণের কথা ভুলে নয়, লাখো মানুষের রক্ত ভুলে নয়, ওদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা ভুলে নয়, পাকিস্তানি শাসকদের হাতে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হত্যাকে ভুলে নয়।
তেমনি গণচীনের সঙ্গে আমাদের আধুনিক জীবন গড়ে উঠবে সুসম্পর্কের। কূটনৈতিক বা অর্থনীতির প্রশ্নে হোক, সে সম্পর্ক নিবিড় হবে- সেটিই কাম্য। কিন্তু এ সম্পর্কের নামে জাতি যেন ইতিহাস ভুলে না যায় যে, চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের মতোই পাকিস্তানি শাসন ও শোষণকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, গণহত্যার সমর্থক হয়েছিল চীন। এমনকি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির বিরোধিতা করতে ‘ভেটো’ পর্যন্ত প্রয়োগ করেছিল!
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করার পেছনে গণচীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের যে যুক্তি ছিল তা কোনো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়নি। সৎ ও সত্যের স্বার্থে অবশ্যই মানতে হবে, বৃহৎ শক্তির দুর্ভাগ্যজনক সেই নীতি-অবস্থান আমাদের জাতির ন্যায্য অধিকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ নিপরাধ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। ধর্ম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দেশীয় অনুচরদের নিষ্ঠুরতা সমর্থন করে তারা যে অমানবিকতা দেখিয়েছে, যে অধর্ম করেছে- তাকে আমাদের ইতিহাস থেকে বাদ দেয়া যাবে না কখনো। এরপরও বলব- এদের সবার সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা যুগের চাহিদাকেই পূরণ করবে।
ভারত শুধু বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ নয়, বাংলাদেশের নিকটতম পড়শিও। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় এই দেশটির অবদান আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ অংশ। কিন্তু স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিনির্মাণ হবে পারস্পরিক স্বার্থ, সমঝোতা এবং সম্মানবোধের ভিত্তিতে। একাত্তরের রক্ত মাখা বন্ধুত্ব, যা জাতির স্বাধীনতা লাভে সহায়ক, সে বন্ধুত্বকে অস্বীকার করে ইতিহাস বিস্মৃত জাতি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এটিও মনে রাখার বিষয় যে, ভারতের মাটিতে সেদিনকার পূর্ববঙ্গ থেকে এক কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল, হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন- যা আমাদের ইতিহাসের অনন্য অংশ।
ইতিহাস বনেদি পরিবারের নিছক পারিবারিক অতীত নয়। ইতিহাস একটি জাতির চালিকাশক্তি। বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সুবিধার্থে এর নড়চড় হওয়ার নয়। যারা তা করতে চান তারা জাতির চলার পথকেই কেবল কণ্টকাকীর্ণ করেন না, একই সঙ্গে তারা জাতিকেও বিপদগ্রস্ত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসকে যারা বিকৃত করতে চান তারা দেশপ্রেমিক নন, হতে পারেন না। দেশপ্রেমিক হওয়ার প্রধান শর্ত- জাতীয় ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করা। যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা, যিনি তার বন্দিদশায় সাময়িক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি, মুখ্য নায়ক, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, অতএব সেই শেখ মুজিবকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব নয় কখনো।
তবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সাফল্য ও সমালোচনা মেনে নিতে হবে। প্রবল ষড়যন্ত্র চলেছে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। একদিকে পরাশক্তি আমেরিকার প্রতিশোধ স্পৃহা, অন্যদিকে দেশের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী এবং পরাজিত পাকিস্তান বাহিনীর দোসরদের অপতৎপরতা, যার সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী, প্রগতি ও গণতন্ত্রবিরোধী চক্র আবারো জায়গা করে নিয়েছে। এক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা বিপন্ন হয়েছে।
স্বাধীনতার বয়স এরই মধ্যে পাঁচ দশকেরও বেশি হয়েছে। একাত্তরে জন্ম লাভ করা শিশু আজ পরিপূর্ণ মানুষ। বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যে জাতীয় বিতর্কগুলোর সুরাহা হয়েছিল, মীমাংসিত সেই বিষয়গুলোও নতুন করে অমীমাংসিত করার চেষ্টা চলছে আবারো! জাতীয় প্রগতির পথে যা এক বড় অপরাধ।
দেশ এগিয়েছে। অসামান্য অগ্রগতি ঘটেছে যোগাযোগ উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে। জ্ঞানবিজ্ঞান, সামাজিক সূচক ও খেলাধুলায় বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। এর পরেও শঙ্কার কারণ আছে। এর প্রধান কারণ জাতির মনোজগতে নতুন করে কলঙ্ক বিছিয়ে চলেছে ধর্মান্ধতা ও উগ্র সাম্প্রদয়িকতা! এ এক দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা, যাকে অস্বীকার করা হলে বা আত্মতুষ্ট হলে, সব অর্জন ব্যর্থ হবে। খেয়াল রাখতে হবে ১৯৪৭-এর চেতনা যেন ১৯৭১-এর চেতনাকে ছাপিয়ে যেতে না পারে। এ থেকে পালাবার সুযোগ নেই।
নাগরিকদের ভেবে দেখতে হবে, যে মূল্যবোধ, আদর্শ ও চেতনার ওপর ভিত্তি করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার যেন অবমূল্যায়ন না ঘটে। দেখতে হবে, কী সেই চেতনা কিংবা আদর্শ যাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে এ মাটির লাখ লাখ যুবক রাইফেল ধরেছিল, মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল, জীবন উৎসর্গিত করেছিল। একাত্তরের বিজয় বাঙালি জাতির হাজার বছরের প্রত্যাশার শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এ ভূখণ্ডের মানুষ বিদেশি ও স্বদেশি শোষণের মাঝে বসবাস করে এসেছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। সামন্ত প্রভুদের নির্যাতনও আমাদের ইতিহাসের অংশ। মনে রাখতে হবে, শত বছরের শত চেষ্টা ও রক্তপাতের পরেও বাঙালি কখনই স্বাধীনতার মুখ দেখেনি- ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আগে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অর্থ- এই ভূখণ্ডের মুক্তিকামী মানুষের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম স্বদেশভূমি বিনির্মাণের সাধনা এবং সেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখা।
আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও তার চেতনার কথা বলি, তখন ভাবতে হবে, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে ভাঙতে হয়েছিল কেন? কেন বাঙালিকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও তার সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল? নতুন জেনারেশনকে অবশ্যই জানতে হবে, কী ছিল সেই বঞ্চনা ও নিষ্পেশনের ইতিহাস- যা জাতিকে বিদ্রোহী হতে বাধ্য করেছিল?
বুঝতে হবে, কোন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের মাটিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা পেয়েছিল বাঙালি- ধর্মের দোহাই দিয়েও যা টিকিয়ে রাখা যায়নি। কারণ একই দেশে বসবাস করে- কেবল ধর্মের নামে সংখ্যালঘু একটি সম্প্রদায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শোষণ করবে, অপমানিত করবে এবং মর্যাদাহীন করে তুলবে- তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের এটিও জানতে হবে- কেন এদেশেরই এক শ্রেণির ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক মানুষ জাতীয় স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে বর্বর দখলদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল- গণহারে হত্যা ও নারী নির্যাতনে যোগ দিয়েছিল!
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা জাতির মূল সংবিধানে গ্রন্থিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে- স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মাথায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ ছিল এক বিস্ময়কর জাতীয় সাফল্য। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মূলত এ বিষয়গুলোকেই সংক্ষিপ্ত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বলতে পারি, যদিও পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থান-পতনে অনেকেই এর ভিন্ন বিশ্লেষণে গিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টা করেছেন।
দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার রক্তার্জিত মূল্যবোধগুলোকে ১৯৭৫ পরবর্তীকালে নির্বাসিত করা হয়েছিল। যে কারণগুলোর জন্য এ দেশের লাখো তরুণ অস্ত্র হাতে তুলে শহীদ হয়েছেন, লাখো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, লাখো নারী নির্যাতিত হয়েছেন- সে কারণগুলো সর্বত্রই উপেক্ষিত থেকেছে বহুকাল। গণতন্ত্রের চেহারা যে কী করুণ হয়েছিল- তা আমরা দেখেছি, সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত ছিল না, জাতীয়তাবাদ পর্যন্ত বিতর্কিত করা হয়েছিল, এমনকি সংবিধান থেকে সুচতুরতার সঙ্গে উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা! শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যাশা পরিণত হয়েছিল দিবাস্বপ্নে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে স্বাধীনতাকামী, প্রগতি ও গণতন্ত্রকামী ব্যক্তি, গোষ্ঠীকে সচেতন ভূমিকা রাখতে হয়েছে, যার পরিণতি মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তির প্রত্যাবর্তন। এই প্রত্যাবর্তনকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের বর্মে, দেশপ্রেমের বর্মে দীক্ষিত করা।

হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়