‘আমরা একাত্তর’ : একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি দাবি

আগের সংবাদ

ভোটের মাঠে ফিরলেন যারা : আপিল শুনানির প্রথম দিন > প্রার্থিতা ফিরল ৫৬ জনের > বাতিল-৩২ > পেন্ডিং-৬

পরের সংবাদ

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাংলাদেশের অবস্থান

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জলবায়ুতে মানুষের সৃষ্টি ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ১৫৪টি দেশ ১৯৯২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। এরপর থেকে জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন (কপ) প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মিসরে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘কপ-২৭’ এর সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি ‘ক্ষতি ও লোকসান’ তহবিল সৃষ্টি করা; যা অভিযোজনবিষয়ক বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনের অনুকূল একটি চুক্তি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান কাজে লাগানোয় উৎসাহিত করার জন্য ‘কপ-২৭’ এ একটি নতুন পাঁচ বছরব্যাপী কার্যক্রমনির্ভর কর্মসূচি প্রণয়ন। জলবায়ুর পরিবর্তনে জ¦ালানির ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার তীরটা প্রথমে আসে পশ্চিমা বহুজাতিক জ¦ালানি কোম্পানিগুলোর দিক থেকে। তবে এ ক্ষেত্রে আড়ালেই থেকে যায়, জ¦ালানিশিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করা শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত জ¦ালানি কোম্পানিগুলো। এবারের সম্মেলনের সভাপতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সুলতান আল জাবের, যিনি নিজেও দেশটির জাতীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানি অ্যাডনকের প্রধান নির্বাহী। এ সম্মেলনের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ¦ালানি থেকে উত্তরণ। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণে ধীরে ধীরে তেল, গ্যাস ও কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে দেশগুলো সম্মত হয়েছে।
এবারের সম্মেলনের কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত দুর্বল দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ-সংক্রান্ত তহবিল চালু করতে সম্মত হয়েছেন বিশ্ব নেতারা। সম্মেলনের শুরুতেই জাতিসংঘপ্রধান অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ২০২৩ সাল বিশ্বের উষ্ণতম বছর। এভাবে চলতে থাকলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য পূরণ হবে না। কপ-২৮ সম্মেলন সফল করতে তিনটি বিষয়ের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। প্রথমত, মারাত্মকভাবে নির্গমন কমানো। দ্বিতীয়ত, জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ¦ালানির ব্যবহার বাড়ানো। তৃতীয়ত, কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী নয়, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে ভুক্তভোগী দেশগুলোকে তহবিলের প্রতিশ্রæতি নিশ্চিত করা।
কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ-২৮) সম্মেলনের শুরুর দিনেই জলবায়ু বিপর্যয় তহবিল গঠন করেছেন প্রতিনিধিরা। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য জলবায়ু বিপর্যয় তহবিল গঠন করাকে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন তারা। ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশ অনুদানের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। তাদের মধ্যে কপ-২৮ সম্মেলনের আয়োজক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ১ হাজার লাখ ডলার, জার্মানি ১ হাজার লাখ ডলার, ব্রিটেন কমপক্ষে ৫১০ লাখ ডলার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৭৫ লাখ ডলার এবং জাপান ১০০ লাখ ডলার অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত ১.৬২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে একবিংশ শতাব্দী শেষে পৃথিবীর বুক থেকে প্রায় অর্ধশত দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা, খরা, দাবানল বেশি হচ্ছে। চলতি বছরের ১০ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার দারনা শহরে সংঘটিত বন্যা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এর ফলে অন্তত ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জলবায়ুর প্রভাবে ২০২৫ সালের মধ্যেই থেমে যাবে আটলান্টিক মহাসাগরের স্রোত, অ্যান্টার্কটিকার পৃথিবীর বৃহত্তম বরফখণ্ড গলে ও সরে গিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, আমাজন শুকিয়ে যাচ্ছে প্রভৃতি। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের ৮৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
জলবায়ু-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল অর্থায়ন শুধু সরকারের তরফ থেকে জোগান দেয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। যেসব জনগণ ও জনগোষ্ঠী সর্বাধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাদের সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে বিদ্যমান তহবিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবহার করতে হবে। জনগণের যদি দুর্যোগের আঘাত সহ্য করার সক্ষমতা বেশি থাকে, বাংলাদেশের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। সর্বোচ্চ নিঃসরণকারীদের প্রতি জরুরি ও জোরালো আহ্বান এই যে, বৈশ্বিক উষ্ণতার হার ১.৫ ডিগ্রি সীমার মধ্যে রাখার লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থবহ প্রতিশ্রæতি প্রদান করতে হবে। ২০২২ সারের নভেম্বরে মিসরের শারম আল-শেখ এলাকায় ‘কপ-২৭’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘কপ-২৮’ সম্মেলন চলবে।
সবুজ শিল্পায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এক বিরাট সুযোগ নিয়ে আসে। পরিবেশের দেখাশোনা আর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সমন্বয় করার মাধ্যমে আর্থসামাজিক রূপান্তর ঘটানোর সুযোগ। সবুজ শিল্পায়ন ঘটলে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি পথ প্রস্তুত হবে। এর ফলে দেশগুলো বিভিন্ন রকম শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। শিল্পায়ন, বৈচিত্র্যকরণ এবং ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থাপনের মাধ্যমে কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারবে। সবুজ শিল্পায়নের জন্য বেসরকারি খাতের সহায়তার কথা থাকতে হবে এবং তিনটি মূল বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে। প্রথমত, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের তুলনামূলক সুবিধার ওপর ভিত্তি করে ব্যাপক সবুজায়নের কৌশল নির্ধারণের জন্য কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি লক্ষ্য রাখতে হবে যেন উৎপাদন এবং অন্য সব শ্রম সৃষ্টিকারী খাতে কর্মরত মানুষের জীবিকাগুলোর কোনো ক্ষতি না হয়। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পের উপযুক্ত আর্থিক উপকরণ, গ্যারান্টি, ঝুঁকিমুক্ত উপকরণ সৃষ্টি করতে হবে। সেই উপকরণগুলো যেন বেসরকারি খাতের পুঁজির দুয়ার খুলে দিতে পারে। বিনিয়োগকে চিহ্নিত ও সহায়তা করার জন্য জনকল্যাণের কথা মাথায় রেখে কাজ করা অতীব জরুরি। এই বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ক্রেডিট বর্ধিতকরণ, মিশ্রিত অর্থায়ন বা গ্যারান্টি প্রদানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ইক্যুইটি অর্থায়নকে বাড়ানো যাবে এবং উদ্ভাবন, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করা যাবে। তৃতীয়ত, সবার জন্য টেকসই অর্থকে সুলভ করতে বিশ্বব্যাপী আর্থিক কাঠামোর সংস্কার করা গুরুত্বপূর্ণ। উদীয়মান বাজারে পেনশন এবং সার্বভৌম সম্পদ তহবিল ইতোমধ্যে বিনিয়োগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মূলধন সরবরাহ করছে। এর পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ছাড়াও ব্যাসেল কমিটি অন ব্যাংকিং সুপারভিশনের মতো অন্যান্য কিছু বড় বড় সংস্থা রয়েছে। যেগুলো সাধারণ ব্যাংকিং মান এবং পদ্ধতি সমন্বয়ের লক্ষ্যে কাজ করছে। এছাড়া গøাসগো ফিন্যান্সিয়াল অ্যালায়েন্স ফর জিরো সব ব্যবসায়ীদের একত্রিত করে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এভাবে আরো বেশি বেশি বিনিয়োগবান্ধব নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে সহায়তা দেয়ার জন্য সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে একযোগে কাজ করতে হবে। এতে রূপান্তরমূলক প্রকল্প চালু হবে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে।
কপ-২৮ সম্মেলনে স্বল্পোন্নত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অত্যন্ত বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর পক্ষে বাংলাদেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে চায়। এ লক্ষ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিষ্পত্তিতে সমন্বিতভাবে কাজ করার লক্ষ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যগুলো হলো : প্রথম গেøাবাল স্টকটেক নির্ধারিত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কার্যক্রমের অগ্রগতি মূল্যায়ন, ভবিষ্যৎ উচ্চাকাক্সক্ষা, মাইলফলক নির্ধারণ এবং স্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ। অধিক বিপদাপন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর লোকসান ও ক্ষতি আমলে নেয়ার লক্ষ্যে কপ-২৮ সম্মেলনে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ কার্যকর করা এবং এর বিস্তারিত কর্মপরিধি ঠিক করা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘কপ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দেশের বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মতামত নিয়ে একটি অবস্থান পত্র প্রণীত হয়েছে।
অভিযোজন সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য ‘গেøাবাল গোল অন অ্যাডাপটেশন’-এর কাঠামো প্রণয়ন করা, সদস্য দেশগুলোকে অবশ্যই ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য তাদের এনডিসিতে বর্ণিত ২০৩০ প্রশমন লক্ষ্যমাত্রাকে শক্তিশালী করা এবং এনডিসি বাস্তবায়নের জন্য এলডিসি দেশগুলোর অর্থায়ন বাড়ানো। উন্নত দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি ডলার দেয়া নিশ্চিত করা ও জলবায়ু অর্থায়নের সংজ্ঞা চূড়ান্ত করা। অভিযোজনের অর্থায়ন দ্বিগুণ করা, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ২০২৫ পরবর্তী সময়ে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য ‘নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল অন ক্লাইমেট ফিন্যান্স’ আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করা।

ড. মো. মোরশেদুল আলম : কলাম লেখক ও শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়