হিমুর প্রেমিক রাফির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন পেছাল

আগের সংবাদ

আসন সমঝোতাই বড় চ্যালেঞ্জ : আ.লীগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ভোটে আসা দলগুলোর, ১৪ দলের সঙ্গে সমঝোতা, ঝুলে আছে জাপা

পরের সংবাদ

ঋণ করে ঘি খাওয়ার দিন কি শেষ?

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমরা খুব ছেলেবেলায় গনি মিয়ার ঋণ করে ছেলে বিয়ে দেয়ার গল্পটি পড়েছি। ঋণ পরিশোধের জন্য তাকে তার একমাত্র ধানি জমি বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে তিনি সম্পদহীন হয়ে পড়েন। তার মাথা গোঁজার কথাটি আমাদের মনে আছে। তার পরিবার শেষ পর্যন্ত সেই ঠাঁইও হারান। ফলে তাকে উদ্বাস্তু হতে হয়। খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হয় তার ও পরিবারের।
এই গল্পের পেছনে আছে আরো বহুবিদ কারণ। লোভী ধনবান প্রতিবেশীরও ছিল প্ররোচনা ও সামাজিক চাপ। আরো নানাবিধ সাংসারিক চাহিদার বিষয়টিও ছিল সেই চাপের একটি অংশ। ফলে গনি মিয়াকে ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিতে হয়েছিল। পরিণামে তিনি গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে উদ্বাস্তু। এই গনি মিয়াদের সংখ্যা বাড়ছে।

দুই.
এটি একটি মেটাফরিক্যাল গল্প। এই গল্পের রস কোথায় গড়িয়ে গেছে তা আপনারাই কল্পনা করুন। আর আমি ভাবছি বা খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছি গনি মিয়ার পরিণতি যেন মহাসামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াসের মতো ধেয়ে আসছে আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে এবং আমরা ধসের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি। কী কথা বলছে এই রিপোর্টের তথ্য?
জানা গেছে, ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলামে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা আগে ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। এছাড়া ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার আগের ১০ দশমিক ৪০ থেকে ১১ শতাংশে, ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ১০ দশমিক ৬০ থেকে ১১ দশমিক ২০ শতাংশে উঠেছে।
গতকাল ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ধার নেয়ার লক্ষ্য ছিল সরকারের, তবে শেষ পর্যন্ত তোলে ৪ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। এ কারণেই সুদহার বেড়ে যায় বলে সূত্রগুলো জানায়।
১৮২ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে দেড় হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা করলেও সরকার শেষ পর্যন্ত তোলে ৫০১ কোটি টাকা। এছাড়া ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা থাকলেও সরকার নিয়েছে ৪২২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ধারণা, ট্রেজারি বিলের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহারও বাড়বে। তবে সুদহার বাড়লে ঋণ বিতরণ কমে এবং তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য সম্প্রতি নীতি সুদহার বা রেপো রেট একবারে দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। নতুন রেপো রেট দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। ৫ অক্টোবর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর রয়েছে। এরপর থেকে সব ধরনের সুদের হার বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এখন প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এজন্য সুদহার আরো বাড়বে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের জমি ক্রয় এবং কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি ক্রয় ও তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি টাকা ছাপানোও এখন বন্ধ রয়েছে। এসব উদ্যোগ কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে হাতে থাকা সব ধরনের অস্ত্রও ব্যবহার করা প্রয়োজন। (প্র.আ /৪ ডিসেম্বর)
এই রিপোর্টের বেশ কিছু চিত্র আমাদের চোখে ভেসে উঠেছে। গনি মিয়ার মতোই যেন ঋণ করে সরকার জাতীয় নির্বাচনটি করতে যাচ্ছেন। যে নির্বাচন বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছে, যে নির্বাচনের প্রধান অংশীজন ভোটার জনগণ ভোট দিতে পারবে কি না, সেই শঙ্কায় তারা শঙ্কিত। কারণ তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোট দিতে পারেনি। ভোট কেন্দ্রে গিয়েও তারা ফিরে এসেছে এটা শুনে যে আপনার ভোট হয়ে গেছে। ভোটের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্টার হচ্ছে ভোটার জনগণ। তারাই দেখতে পাচ্ছে এবারো নির্বাচনে তাদের ভোট প্রয়োগের তেমন একটা সুযোগ নেই। সেজন্যই তারা শঙ্কিত। সরকারে ও তার রাজনৈতিক দলের বাণী-বক্তব্যের জেরে এটা জানা ও বোঝা যাচ্ছে যে তারা প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী না থাকায় ‘এসো নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে সরকার নির্বাচনটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলি। সেই মোতাবেক তারা আওয়ামী লীগেরই যারা দলের নমিনেশন পাননি, তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। ফলে তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি জমেছে, তারা কার জন্য কাজ করবেন? এই পরিস্থিতি নিয়েই আওয়ামী শিবিরে নিজেরাই বিভক্ত। যারা নমিনেশন পাননি লীগের তারা বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের নিয়ে নিজেদের পক্ষে প্রচারণার আয়োজনে ব্যস্ত। কে না জানে যে এবারো নির্বাচনটি একপেশে হবে। অর্থাৎ প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে আসছে না। তারা গোস্যা করেনি, তারা দাবি করেছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম করুক এবং পদত্যাগ করে চলে যান সরকারপ্রধান ও পারিষদবর্গ। কিন্তু ক্ষমতা ও তার লোভ এটাই প্রমাণ করে যে ধসে না পড়া পর্যন্ত কোনো সরকারই ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না। যারা জনগণের কথা শুনতে পায় না, তারা স্বৈরশাসক। পৃথিবীতে যে কয়েকটি দেশে স্বৈরশাসন চালছে তার মধ্যে বাংলাদেশকেও জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর কারণ হয়তো এই যে, বর্তমান সরকার আন্দোলনরত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আটক করেছে এবং জেলে রেখে দেয়ার আয়োজন করছে। নিম্ন আদালতের মাধ্যমে তারা দণ্ডিত হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ উচ্চ আদালতের মাধ্যমেও দোষী সাব্যস্ত করে জেলে রাখার আয়োজন হয়েছে। জেলের বাইরে বিএনপির যেসব নেতা আছেন তারা পালিয়ে থাকছেন। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর টকশোতে এখন আর বিএনপির কোনো প্রতিনিধিকে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপিবিহীন নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, সেটা সরকারি দল জানে ও বোঝে। তাই তারা দেখাতে চায় যে তারা বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ডেকেছে। কিন্তু তারা আসেনি বা সাড়াও দেয়নি।
নির্বাচন কমিশনের তাড়াহুড়োর আয়োজন যে সরকারের তুষ্টির জন্য, সেটা নানাভাবেই বোঝা যায়। সাংবিধানিক শর্ত অনুযায়ী ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন করা বাধ্যতামূলক হলেও প্রধানমন্ত্রী তার এখতিয়ার বলে পদত্যাগ করলে পারিষদ নিয়ে, তাহলে রাষ্ট্রপতি সেইদিন থেকেই ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন ইসিকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তো ইতিহাস সৃষ্টির জন্য একপেশে নির্বাচন করবেন… এটা বোঝা যাচ্ছিল রূপকল্প ২০৪১ সাল ঘোষণার মাধ্যমে। মাঠস্তরের মাঝারি আমলাদের জন্য গাড়ি কেনার প্রস্তাব সরকার দিয়েছিল। কিন্তু টাকার অভাবে সেই ঘুষ পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে। এতে যে আমলারা অখুশি, তা নয়, তারা বিগত ১৫ বছরে অন্যায় ও অনৈতিকভাবে যা কামাই করেছেন, তাতেই তারা হ্যাপি।
পত্রিকায় পড়েছি ও টিভিতে শুনেছি নির্বাচন কমিশন সব থানার ওসিকে বদলি করার পরিপত্র জারি করেছেন। ইসির নির্দেশিত পথেই সরকারের আমলারা পুলিশের ওইসব কর্মকর্তাকে বদলি করে দেবেন, এতে কোনো ভুল নেই। দেখে মনে হবে ইসি কতটা শক্তিশালী। ধরুন, প্রান্তিক স্তরের একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে জেলাস্তরের কোনো থানায় বদলি করা হলো। তিনি/তারা কি ভুলে যাবেন সরকার কী চায়? তারা কি সরকারি দলের পক্ষে কীভাবে কাজ করবেন বা তার কর্মদক্ষতা তো আর তার থানায় রেখে আসেননি। ফলে যে কাজটি তিনি প্রান্তিক থানায় করতেন, জেলা স্তরের থানায় এসেও সেই ছক অনুযায়ীই দায়িত্ব পালন করবেন, এতে কোনো ভুল নেই। ঠিক একই কথা খাটবে প্রশাসনের মধ্যম স্তরের আমলা পরিকল্পকদের ব্যাপারেও। কারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, সেটা দেখার কাজ তাদের নয়। তারা রীতি অনুযায়ী সরকারের নির্দেশ পালন করে যাবে। তবে হ্যাঁ, তারা চাইলে সন্ত্রাসী কর্মীদের প্রতিহত করতে পারেন। কিন্তু সেটা তারা করবেন না।
সরকারের আর্থিক অবস্থার যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও কমিয়ে আনার জন্য যেসব কৌশল নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তাতে কাজ হবে এটা বিশ্বাস করেন অনেক অর্থনীতিবিদ, কিন্তু হবেই তা তারা বলতে পারেন না। এটাও কম বড় সমস্যা নয়। দ্রব্যমূল্য তখনই কমবে যখন সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু আমরা এটা বুঝতে পারছি না যে সরকার ও প্রশাসন সত্যিই সিন্ডিকেটেড বাজারকে স্বাভাবিক করতে পারবে। যারা এই সিন্ডিকেট করছেন তারা সরকারপ্রধানের পেয়ারের লোক। যারা দেড় লাখ কোটিরও বেশি ঋণ নিয়ে তা খেলাপ করে বসে আছেন, তারাও সরকারের পেয়ারের বান্দা ও প্রিয় লোক। তাই সরকারপ্রধান তাদের আটক করে টাকা ফেরত আনেন না। এমনকি ওইসব লোক আইন খেলাপ করে, জনগণের টাকা ফেরত না দিয়ে সরকারপ্রধানকে তোয়াজ করছেন, তারা যে অপরাধী, এটা তিনি ভাবছেন না। তার মানে ঋণ খেলাপকারী অপরাধীদের তিনি তার বগলের নিচে রেখে দিয়ে তিনিও অন্যায় করছেন। তিনি অন্যায়কারীদের প্রতিপালক হিসেবে গণ্য হচ্ছেন, যা আমরা চাই না। জনগণের টাকা ফেরত আনতে হবে এবং সেটা শেখ হাসিনাকেই করতে হবে। তিনি যখন ২০১০ সালে ক্ষমতায় তখন ঋণখেলাপিদের হাতে ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। আর আজ ১৪ বছর পর সেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণের টাকাটা যদি অর্থনৈতিক কর্মধারার মূল স্রোতে আসত বা আনা হতো তাহলে আজকের দুর্দশায় পড়তে হতো না দেশকে।
তিনি যে জেনে-শুনেই এই বিষ পান করছেন, তা আমরা বুঝি। ওই হলাহলের মধ্যে অমৃত আছে। সেই অমৃত পেতে হলে ঋণখেলাপিদের মন্থন করে তা অর্জন করতে হবে। তিনি কি সেই পথে হাঁটবেন?

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়