বিজিএমইএ নির্বাচন মার্চে

আগের সংবাদ

জাপার আসনে নৌকা প্রত্যাহার! ৩০ থেকে ৩৫ আসন প্রত্যাশা জাতীয় পার্টির > চলছে দেনদরবার

পরের সংবাদ

দায়িত্বশীল সমানুভূতির সমাবর্তন ঘটুক রাজস্ব আহরণে

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমরা যখন কারো কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা বা প্রত্যাশা করি, দাবি পেশ করি, সেবা কিংবা বিচার চাই বা বিবেচনা আশা করি, তখন তার চেতনাকে সহানুভূতিশীল ও সক্রিয় করতে অর্থাৎ আমাদের প্রতি তার মনোভাবকে ইতিবাচক করতে, মোদ্দা কথায় তাকে আমাদের পক্ষভুক্ত করতে, শেষ ডোজ হিসেবে হয়তো বলি, ‘আমাদের জায়গায় আপনি হলে কী করতেন?’ তার চেতনার চৌহদ্দিতে এ প্রশ্ন যে আলোড়ন সৃষ্টি করে, সমানুভূতির সমাবর্তনে সচরাচর সাফল্য আসেই। রাজস্ব আহরণে করদাতা এবং আহরণকারীর পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, উপলব্ধি ও সম্মান-সমীহ বোধের বিকাশ ঘটাতে উভয় পক্ষের মন-মানসিকতার পরিবর্তনে সমানুভূতির প্রসঙ্গটি চলে আসে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এবং বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১১-১৯৮৯) মানবসেবায় ংুসঢ়ধঃযুর পাশাপাশি সমানুভূতি বা বসঢ়ধঃযুর ভূমিকার কথা প্রায় বলতেন। তিনি মনে করতেন, কারো দুঃখ-কষ্টে রোগভোগের নিরাময় কিংবা উপশমকল্পে চিকিৎসক অবশ্যই রোগীর প্রতি ংুসঢ়ধঃযবঃরপ হবেন, তবে তার ংুসঢ়ধঃযু প্রদর্শনের প্রেরণা আসতে হবে সমানুভূতিবোধ বা বসঢ়ধঃযু থেকে। চিকিৎসক রোগীর আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হবেন নিজেকে রোগীর স্থানে কল্পনা করে। রোগী এ মুহূর্তে কী চায়, ডাক্তারের কাছে তার প্রত্যাশা কী, এটা তাকে বুঝতে হবে। ডা. ইব্রাহিম রোগীর আর্থিক সামর্থ্যরে কথাও বিবেচনা করে প্রেসক্রিপশন দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। চিকিৎসা কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার আগে তিনি রোগীর আর্থিক অবস্থা, সামর্থ্য উপলব্ধির স্তর আগে যাচাই করে নিতেন। তিনি মনে করতেন, রোগীর অসুখ সারানো যেখানে উদ্দেশ্য সেখানে রোগীর ওষুধ কেনার সামর্থ্য অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন দেয়া যুক্তিযুক্ত এ জন্য যে, সে যদি ওষুধ না কিনতেই পারে, তাহলে তার চিকিৎসাই হবে না।
করদাতাকে যদি কর আহরণকারী আস্থায় না আনতে পারেন, তাকে সহায়তা-সহযোগিতার মনোভাব না প্রদর্শন করতে পারেন, তাহলে করদাতা নিজেকে উন্মুক্ত করবেন না তার কাছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস ভয়-ভীতি, ফাঁকিজুকির অন্ধগলির অন্তরালে চলে যেতে পারেন তিনি। করদাতাকে সহায়তার মনোভাব নিয়ে কথা বলতে হবে। হিসাবায়ন ও অন্যান্য বিষয়ে তার সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করে তাকে সঠিক আয় ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিদেশে কেউ বেশি কর পরিশোধ করলে হিসাবান্তে তার অতিরিক্ত পরিশোধিত টাকার চেক তিনি না চাইতেই তার ঠিকানায় চলে আসে। সেখানে করদাতারা মনে করেন, যেটুকু কর দেয়ার সেটুকুই তাকে দিতে হবে। তার কাছ থেকে কম কিংবা বেশি নেয়া হবে না। এর বিপরীতে যদি এ ধারণা পরিব্যাপ্ত হয় যে, রাজস্ব বিভাগে কর জালে একবার বাঁধা পড়লে টাকা দিতেই হবে। বেশি দিলে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম এবং হরেক রকম ঝামেলা-ঝক্কিতে আকর্ণ, তাহলে কর দপ্তরের থেকে যেভাবে হোক যত দূরে থাকা যায় সে চেষ্টা চলতে থাকে। কর আহরণকারীর পক্ষে এ ধরনের নিরুৎসাহী করদাতার পেছনে ধাওয়া করতে সময় ও বুদ্ধির ব্যয় হয় বেশি। অথচ এটা প্রয়োজন হতো না, যদি আস্থার পরিবেশ সৃজন সম্ভব হতো।
এ কথা বলাবাহুল্য, করদাতারও দায়িত্বশীল ও সক্রিয় সাড়া তথা সহযোগিতা ছাড়া রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে বাঞ্ছিত সফলতা অর্জন সম্ভব হয় না। এর জন্য প্রয়োজন আস্থার পরিবেশ সৃজন। আয় হলে আয়কর, সম্পদ সৃষ্টি হলে সম্পদ কর, আমদানি হলে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজিত হলে মূল্য সংযোজন কর দেয়ার প্রশ্ন উঠবে। করদাতার ন্যায্য আয় বৃদ্ধি, তার ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ ও পরিবেশ এবং আমদানি-রপ্তানির প্রকৃত অগ্রগতি এবং মূল্য সংযোজন উত্তর সামগ্রীর বাজারজাতকরণের সার্বিক পরিস্থিতির টেকসই উন্নয়ন ব্যতীত বর্ধিত রাজস্ব আয়ের সুযোগ সীমিত। আর এ ক্ষেত্রে করদাতা ও আহরণকারীর পারস্পরিক উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে। করদাতা যদি রাজস্ব সংগ্রহকারীকে এড়িয়ে চলে এবং রাজস্ব আহরণকারী যদি করদাতাকে শুধু সংশয়-সন্দেহের চোখে দেখে, তাকে তাড়িয়ে বেড়াবার মতো পরিবেশ যদি সৃষ্টি হয়, তাহলে বলা বাহুল্য, উভয়েরই সমস্যা।
বিধিবিধান অনুসরণ যেহেতু দায়িত্ব ও কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে, সেহেতু এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারটি গুরুত্ববহ। রাজস্ব আহরণকালে যেমন করদাতার প্রকৃত আয়ের ব্যাপারটি দেখা হবে, তেমনি করদাতার তরফে বিধিবিধান মেনে রাষ্ট্রের দেয়া পরিশোধে যতœবান বা দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদও থাকবে। কাউকে দায়িত্বশীল হতে বলার আগে ক্ষেত্র প্রস্তুতের প্রশ্ন এসে যায়। আগেই বলা হয়েছে, রাজস্ব আয় ও ব্যয় উভয় পক্ষের পারস্পরিক স্বার্থে বিষয়টি অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগের মতো মনে হতে পারে। রাজস্ব আয় সার্বিকভাবে আয় রোজগারের ওপর নির্ভরশীল দেখতে হবে- (১) আয় রোজগার হচ্ছে কিনা কিংবা আয় রোজগারের পরিবেশ বা সুযোগ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে কিনা, (২) অর্জিত আয়ের হিসাবায়ন বা প্রদর্শনের স্বচ্ছ পরিবেশ ও উৎসাহব্যঞ্জক সুযোগ আছে কিনা, (৩) প্রদর্শিত আয়ের ওপর দেয় রাজস্বের হিসাবায়ন এবং সর্বোপরি (৪) তা পরিশোধ তথা সংগ্রহের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কতটা সহজ বা সরল। কেননা এর যে কোনো একটি ক্ষেত্রে জটিলতা, অসম্পূর্ণতা, অস্বচ্ছতা পুরো পরিবেশটাকে প্রশ্নবোধক করে তুলতে পারে। রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় অনুপ্রেরণাদায়ক সহজ সাবলীল ব্যবস্থা যেমন থাকা দরকার আবার সে সহজীয় সুযোগের অসৎব্যবহার যাতে না হয়, তা নিশ্চিতকরণার্থে প্রতিবিধানের ব্যবস্থাও থাকা দরকার। করদাতা যাতে হয়রানির শিকার হয়ে নিরুৎসাহিত না হন, এটা দেখাও যেমন জরুরি তেমনি কর প্রদান এড়িয়ে চলার বা ফাঁকিজুকি দিয়ে পার পাওয়ার প্রতিরোধাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি।
সমাজে যদি কর পরিশোধযোগ্য ১০ জন লোক বাস করে এবং রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা যদি হয় ১০ টাকা, তাহলে প্রত্যেকে ১ টাকা করে কর দিলে চলে। কিন্তু কর পরিশোধযোগ্য হয়েও যদি ৮ জন কর পরিশোধের আওতায় না আসে, তাহলে যে দুজন কর পরিশোধ করে তাদের ওপর গিয়ে পড়ে ১০ টাকা পরিশোধের পুরো চাপ। পরের বছর কর আহরণ মাত্রার স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করে যদি ১১ কিংবা ১২ টাকা নির্ধারিত হয় লক্ষ্যমাত্রা, তাহলে সে বর্ধিত বোঝাও গিয়ে পড়বে ওই দুই নিয়মিত করদাতার ওপর। তাদের আয়-রোজগার সেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কি পায়নি, সেটার দিকে না তাকিয়ে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং সে সূত্রে নানা বিসংবাদ সৃষ্টি হতে পারে, যা কর প্রদানে নিরুৎসাহিত কিংবা ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাকে উসকে দিতে পারে। ১০ জনের স্থলে দুজন কর দেয়াতে বাকি আটজন নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে জাতীয় উন্নয়নে, যে দুজন দিচ্ছেন তারাও যথাযথ কর পরিশোধ করেন কিনা তাদের ব্যাপারে স্বচ্ছতার প্রশ্নে কোনো উচ্চকণ্ঠ দাবি নির্লিপ্ত ভূমিকা পালনকারীদের পক্ষ থেকে আসার কথা নয়। এ ধরনের পরিবেশে জবাবদিহিতার বিষয়টি গণসচেতনতার প্রযতœ লাভে ব্যর্থ হয়।
একইভাবে করের হার কমানোর যে সর্বজনীন দাবি, তাতে যথাবিবেচনা সহকারে সাড়া দেয়া সম্ভব হয় না রাষ্ট্রের পক্ষে। এটা মনে হতে পারে, সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর দিতে যে কোনো একজন করদাতার পক্ষে কষ্টকর (মেধা ও পরিশ্রম সহকারে ১০০ টাকা আয় করে ২৫ টাকা সরকারকে দেয়া হলে)। ক্ষেত্রমতে অবিবেচনাপ্রসূত (যখন অধিকাংশ লোক কর না দিয়ে পার পেয়ে যায়) এবং নিরুৎসাহব্যঞ্জক। আয়করের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন যদি যথাযথ রাখতে হয়, তাহলে করদাতার সংখ্যা না বাড়লে রাষ্ট্রের পক্ষে করের হার কমানো রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে সঠিক শুল্ক পরিশোধে কতিপয়ের উপেক্ষা, ফাঁকিজুকি ও অপারগতার চাপ দায়িত্বশীলদের ওপর গিয়ে বর্তায়। করদাতার সংখ্যা বাড়লে কিংবা শুল্কের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে হারাহারি মতে করের হার কমিয়েও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। করদাতার সংখ্যা কম থাকলে তাদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়, তা কর আইনের প্রয়োগকেও জটিল করে তোলে। এর ফলে কর জালের আওতায় আসতে অন্যরা নিরুৎসাহ বোধ করে। এসব কারণে কর পরিশোধের রীতিপদ্ধতি সহজ-সরল ও প্রয়োগে জটিলতাপ্রসূত ভীতিসঞ্চারের পরিবর্তে সহযোগী সমন্বয়ধর্মী দৃষ্টিদানের মাধ্যমে করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব। এর ফলে অধিকসংখ্যক করদাতা করদানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলে অধিক রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে এবং করের হার কমিয়েও অধিক কর সংগ্রহ সহজতর হবে। আগেই বলা হয়েছে, ডিম আগে না মুরগি আগে। করদাতার সংখ্যা বাড়লে করহার কমানো না করহার কমিয়ে অধিক করদাতাকে আকৃষ্ট করা সম্ভব। এটি পরস্পর প্রযুক্ত ব্যাপার মনে হলেও করহার কমালেই যে অধিক লোক এসে কর দেবে এটি নিশ্চিত নয়। এরূপ পরিবেশে নিজেকে সব সময় আড়াল করে রাখার, এড়িয়ে চলার, সম্মানজনক চলাচলে, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠালাভের ক্ষেত্রে নাজুক অবস্থায় আপতিত হওয়ার মতো দুঃখজনক পরিস্থিতি পরিহার করে চলাই উত্তম। এ কথা উপলব্ধি আবশ্যক যে, রাষ্ট্রকে কর ফাঁকি দেয়া মানে প্রকারান্তরে নিজেকে ফাঁকি দেয়া। কেননা রাষ্ট্র কর থেকে বঞ্চিত হলে নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিতে অপারগ হলে ভোগান্তি নাগরিকেরই আর রাষ্ট্র্রেকে দেয় পরিশোধে নিজের দায়িত্ব পালনে অপারগতার দায়ভাগ আইনের আওতায় নেয়ার যে অধিকার রাষ্ট্রের আছে, তার আওতায় নিজেকে শাস্তির হাতে সোপর্দিত হওয়ার অনিবার্য পরিণতি তো আছেই। অপরাধ ও শাস্তি যে অবয়বেই হোক না কেন, দুজনে দুজনার।

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়