সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনকে তিন নির্দেশনা

আগের সংবাদ

নতুন রক্ত সঞ্চালনে গুরুত্ব : তিনশ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত, আজ ঘোষণা > আসছেন শতাধিক নতুন মুখ

পরের সংবাদ

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য হ্রাসের উপায় কী?

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিগত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকার নবাবপুর, ইমামগঞ্জ, চকবাজার প্রভৃতি স্থানে বিপুলসংখ্যক আমদানিকারক ছিলেন। ছোট ছোট লটে তারা নিয়মিত পণ্য আমদানি করতেন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানসহ দেশের অন্যত্রও এমন আমদানিকারকের দেখা মিলত। চিত্রটা বর্তমানে ভিন্নতর। ছোটরা ঝরে পড়ছে, রাজত্ব শুরু হয়েছে বড়দের। তাতেই হয়েছে সংকট। ভোগ্যপণ্য আমদানি করেন যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়ে কথা হচ্ছে বেশি। তারা সংখ্যায় নগণ্য, কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকে খুবই শক্তিশালী। হামেশাই তারা একজোট হয়ে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাড়িয়ে দেন পণ্যের মূল্য। তাতে নাভিশ্বাস উঠে ভোক্তাসাধারণের। একেই বলে সিন্ডিকেটের খেলা। এ খেলার কাছে সরকারও পরাস্ত, অসহায়। খোদ মন্ত্রীদের কেউ কেউ এই অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করছেন। সত্যভাষণ প্রশংসাযোগ্য হলেও এক্ষেত্রে প্রশংসার উপায় নেই, বরং উল্টো অভিযুক্ত করা যায়। ব্যর্থতার দায় তারা এড়াতে পারেন না।
সিন্ডিকেটের এই যে দৌরাত্ম্য একে রোধ করার উপায় কী? স্তরে স্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে তদারকি জোরদার ও সফলকাম হওয়া এর একটি উপায়। অন্য উপায়ও আছে, যার প্রধানতম হলো প্রতিযোগিতা বাড়ানো বা প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করা। পুঁজির বিকাশ অসমভাবে হওয়ায় প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির বদলে প্রতিযোগিতা বিপন্ন হয়েছে। যে কারণে অতীতের ক্ষুদ্র অসংখ্য আমদানিকারকের অস্তিত্ব বিলোপের পথে। অভ্যুদয় ঘটেছে প্রবল প্রতাপশালী গুটিকতক গোষ্ঠীর। সরকার না পারছে তাদের লাগাম টেনে ধরতে, না পারছে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে। অর্থনীতি অর্থনীতির নিয়মে চলছে না। বাজার না-একচেটিয়া, না-প্রতিযোগিতামূলক। মুক্তবাজার অর্থনীতি কারো জন্য মুক্ত, কারো জন্য মুক্ত নয়। ছোটরা ঝরে পড়ার কারণ শুধু পুঁজিই নয়, অনাচারও। বড়দের অনেকে আন্ডার ইনভয়েসিং করে আমদানি খরচ কমাতে পারেন। ঘোষণার চেয়ে বেশি পণ্য আনার ‘অসাধারণ’ ক্ষমতা তাদের, ফলে আমদানি খরচ কম পড়ে (ঘোষণাতিরিক্ত পণ্য ট্যাক্সমুক্ত হয়ে যাওয়ায়)। তাছাড়াও নানা কায়দাকানুন জানা আছে তাদের। ছোটরা এমন ক্ষমতা রাখেন না। মজুত করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিরও সাধ্য নেই তাদের। এ অবস্থায় সিন্ডিকেটের আধিপত্য হ্রাস করতে চাইলে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে, তৈরি করতে হবে প্রতিযোগিতার পরিবেশ।
ইদানীং মার্কিন ডলারের যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাতে ছোট আমদানিকারকরা আরো বেশি বিপাকে পড়বেন। তাদের পক্ষে ডলার সংগ্রহ করা বড় ব্যবসায়ীদের তুলনায় কঠিন হবে। বড়রা প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে যে-পরিমাণ ব্যাংকের সহায়তা পান ছোটরা তা পান না, ব্যাংক তাদের (ছোটদের) প্রতি অতটা সদয় নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত বড়দের মতো ছোটরাও যাতে গুরুত্ব পান সেদিকে নজর রাখা। নতুবা প্রতিযোগিতার পরিবেশ যতটুকু আছে তাও থাকবে না। অর্থনৈতিক বাস্তবতা এখন যথেষ্ট মাত্রায় রূঢ়। রিজার্ভ সংকটের কারণে ডলারের দাম কেবল বাড়ছেই। তাতে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংকট না কাটলে পণ্যের মূল্য বাড়তে বাড়তে নাগালের বাইরে চলে যাবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যাবতীয় অসঙ্গতির দিকে নজর রাখা জরুরি। বাংলাদেশ মূলত আমদানিনির্ভর দেশ। কৃষিপ্রধান হলেও কৃষিজাত অনেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি করে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হয়। ভূমির স্বল্পতা হেতু উৎপাদন বাড়ানোও সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভেতর এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুব কমই আছে যার কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতে হয় না। কাজেই আমদানি যত অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক হবে ততই মঙ্গল।

দুই.
সিন্ডিকেটের প্রভাব কেবল আমদানিজাত পণ্যের বেলায়ই নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রেও কম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ডিম, আলুর কথাই ধরা যাক। সাম্প্রতিক কালে পণ্য দুটির অভাবনীয় মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলো যে স্থানীয় সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে এমনটি হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছ থেকেও একই কথা শোনা গেল। বাস্তবেও এর সত্যতা পাওয়া গেল পণ্যদ্বয়ের আমদানির ঘোষণায়। আমদানিকৃত মালামাল দেশে আসতে না আসতেই দাম কমে গেল। তবে অনুমোদন দেয়ার পর ডিম আমদানিতে দীর্ঘ সময় লাগায় অনেক দিন ভুগতে হলো ক্রেতাসাধারণকে। পেঁয়াজ নিয়ে প্রতি বছরই সংকট হয়। দাম হঠাৎ বেড়ে নাগালের বাইরে চলে যায়। দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় তা যে চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয় সে কথা সরকারি পরিদপ্তর জানে, তবে ঘাটতির পরিমাণ জানে বলে মনে হয় না। উৎপাদনের যে হিসাব দেয়া হয় তা কাগুজে কিনা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নয়তো আমদানির সিদ্ধান্তে বিলম্ব হবে কেন? তবে এর অর্থ এই নয় যে চাষিদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকবে। মৌসুমে তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ যাতে পানির দরে না বিকোয় সে ব্যবস্থা রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ডিম নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হলো এবার, সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করল এর দাম। অস্বাভাবিক এই দাম বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে, যা নীতিনির্ধারকরাও স্বীকার করে নিয়েছেন। দেশে হাজার হাজার মুরগির খামার রয়েছে, যাতে ডিম ও ব্রয়লার মুরগি উৎপাদিত হয়। এসব খামারের মালিকরা বাচ্চা ও ফিডের জন্য কয়েকটি মাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। তারা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়-কমায়। তাতে প্রায়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অনেক খামার। প্রতিযোগিতা না থাকায় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতায় ২৮টি খামার রয়েছে। বিস্তর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এসব খামারের অবস্থা করুণ। শেড ও যন্ত্রপাতির বেহাল দশা, জনবলও পর্যাপ্ত নেই। উৎপাদন নামমাত্র। ভর্তুকি দিয়ে এগুলোর অস্তিত্ব বজায় রাখা হচ্ছে। কী কারণে বলা মুশকিল। বলা হয়, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এসব খামার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুরগির বিশুদ্ধজাত সংরক্ষণ, মুরগি পালনে জনসাধারণকে উৎসাহিত করা ও পারিবারিক প্রয়োজনে লালনপালনের জন্য ন্যায্যমূল্যে বাচ্চার সরবরাহ এর উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পরিবর্তে সরকারি অর্থের অপচয়ই হচ্ছে কেবল একথা বলাই বাহুল্য। দাবি জানাই, অবিলম্বে এ ২৮টি খামারকে সচল ও আধুনিক করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হোক। তাতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে, সিন্ডিকেটের সুযোগ কমবে, মানুষের দুর্ভোগ হ্রাস পাবে।
মোদ্দাকথা, বাজারকে বাজারের রীতিতে চলতে দেয়া উচিত। তার জন্য প্রয়োজন হবে চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি ও ঘাটে ঘাটে তদারকি।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়