সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনকে তিন নির্দেশনা

আগের সংবাদ

নতুন রক্ত সঞ্চালনে গুরুত্ব : তিনশ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত, আজ ঘোষণা > আসছেন শতাধিক নতুন মুখ

পরের সংবাদ

বাঁশির সুরের মায়ায় বেঁধেছিলেন লোকসংগীত

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বারী সিদ্দিকী তার বাঁশির অন্তর্ভেদী সুরে মিশিয়েছিলেন নিজ মনের অন্তর্নিহিত কথামালা। বাঁশি আর গান নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলতেন, ‘আগে আমার বাঁশি বাজবে, পরে আমার গান’। বাঁশির সুরের মায়ায় বেঁধেছিলেন তিনি এই দেশের আদুরে মাটির লোকসংগীত। তার গানে শাস্ত্রীয়সংগীত ও লোকসঙ্গীতের সমন্বয় পেয়েছিল ভিন্ন এক মাত্রা। কখনো কখনো তিনি আধুনিক গানের বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করেছেন লোকসঙ্গীতের যন্ত্রায়োজনে। সংগীতায়োজনেও ছিল বিরহী কণ্ঠের দরদগাথা। বাঁশি ও গানকে সঙ্গী করেই ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন আমাদের লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তি। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গান গেয়ে জয় করেছিলেন তিনি দর্শক-শ্রোতাদের মন। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরা পেয়েছিলাম মরমী আত্মার গায়েন কিংবদন্তি বারী সিদ্দিকীকে। বাঁশি বাজানোর মাধ্যমে সংগীত জীবনের শুরু হলেও তার কণ্ঠের দরদ মেশানো গায়কীতে মুগ্ধ হয়েছিল সারাদেশের মানুষ। বলতে গেলে তিনি একজন বাঁশিবাদক, অতঃপর সংগীতশিল্পী।
ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন গানের প্রেরণা। তারপর ওস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক গান শেখা শুরু হলেও এক পর্যায়ে তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে বাঁশের ‘বাঁশি’। সুরের মোহনায় নিজে মগ্ন হয়ে শ্রোতাদের ভাসাতে বাঁশির দীক্ষা নিয়েছিলেন ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ বিভিন্ন গুণী শিল্পীদের কাছ থেকে। ছুটে গিয়েছেন ভারতে, পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের তালিম নিতে। নিজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বারী বাঁশরিয়া/বাঁশি যে মোর প্রাণপ্রিয়া’। তিনি সব সময় বাঁশিকে ভেবেছেন আত্মপ্রাণ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি দর্শক মাতিয়েছেন সাত ছিদ্রের সম্মোহনী জাদুতে।
ভাটি-বাংলার মানুষের প্রাণের সংগীত লোকসংগীত। প্রত্যেক দেশেই রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে গাওয়া এই প্রাচীন ধারার গান। কিংবদন্তি বারী সিদ্দিকীও আমাদের এই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন লোকগানকে পরিচয় করিয়েছেন সংগীতপ্রেমীদের অন্তরে। যে গান হয়তো কালের গহ্বরে হারিয়ে যেত, সে গানই তার কণ্ঠের দরাজ গায়কীতে হয়ে উঠেছে আরো জীবন্ত। গ্রামবাংলার মানুষ অথবা শহুরে লোকসংগীত শ্রোতা, তারা বারী সিদ্দিকীকে পেয়ে অনেকদিন পর লোকসঙ্গীতের ঝলমলে এক প্রদীপ পেয়েছিল। তিনি তার গানে মানবজীবন ও প্রকৃতির বিভিন্ন দিক-দর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন। তার গানে প্রায়ই এসেছে জন্ম-মৃত্যুর কথা, বলেছেন সৃষ্টিকর্তার কথা, প্রেমের কথা। তিনি তার গানে বলেন, ‘বিধি তোমার মতোই ভালো হতাম/থাকতাম যদি নিরাকারে/তুমি একটু হলেও নষ্ট হতে/থাকতে যদি মানুষের আকারে’; জগতের এই মায়াময় সংসারে নিরেট ভালো হয়ে বেঁচে থাকা ভীষণ কঠিন, ভালো-মন্দের মিশেলেই মানুষ। তার গানের ভেতর মানবজীবনের সূ² সব আবেগ-অনুভূতিকে অবলীলায় ব্যক্ত করেছেন। মানুষের বিচ্ছেদে একে অপরকে দোষী করার যে রীতি, তিনি তা অস্বীকার করে সমস্ত দায় অথবা যন্ত্রণা নিজেই বয়ে বেড়ানোর ইঙ্গিত দেন। মানবজীবনে ক্ষমাই মহত্ত্ব। তিনি বলেন, ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’ অথবা ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়/বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়’; সেই সঙ্গে এই গানে তিনি বন্ধুয়ারে পরকালের কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। মরমিয়া সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকীর মতে ‘দুঃখ দিলে দুঃখ পাবি।’
বারী সিদ্দিকীর ‘পুবালি বাতাস’ গান বাতলে দেয় নিঃসঙ্গতার মানে। যেন দূর থেকে ভেসে আসছে সঙ্গীবিহীন একাকী মানুষের ডাক- ‘আষাঢ় মাইস্সা ভাসা পানিরে/বাদাম দেইকখা চাইয়া থাহি/আমারনি কেউ আসে’। তিনি বাউল ছিলেন না, তবুও অন্তরে লালন করতেন বাউল ভাবধারা। আদর্শেও তাই। বারী সিদ্দিকীকে এমনই মনে হয় তার গানে। তিনি যখন বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের গানে গানে বলেন, ‘দেখবে খোদার মহান ছবি/তোমার চর্ম চোক্খের পর্দা খোলো/ভাবের দেশে চলো রে মানুষ/ধ্যানের দেশে চলো’ তখন আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার এই বাউল ভাব। মানুষকে তিনি বলছেন ধ্যানের পথে চলো। ধ্যানের মাধ্যমেই কেবল অন্তর্আত্মার সন্ধান মেলা সম্ভব। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থও তা-ই বলে।
আমাদের দেশের ভাটিয়ালি, মরমিয়া, দেহতত্ত্ব কিংবা মারফতি ইত্যাদি লোকসংগীত ধারার বিভিন্ন গান গেয়েছেন শিল্পী বারী সিদ্দিকী। তিনি তার গায়কী এবং বাঁশির মাধ্যমে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন লোকগানের সঙ্গে, যা গানে নিমগ্ন শ্রোতাকে আরো বেশি আলোড়িত করত। তার গানের কথাগুলো একদম আঞ্চলিক শব্দোচ্চারণে বাঁধা। যা লোকগানের অন্যতম রীতি। তার জন্মস্থান ও বেড়ে ওঠা ছিল নেত্রকোনায়, তাই শৈশব থেকেই হয়তো জন্মেছিল এই আঞ্চলিক ভাষার প্রতি টান। মূল কথা বারী সিদ্দিকী ছিলেন জনমানুষের প্রাণ। তার গায়কী আর বাঁশি পাগল করেছিল গ্রামাঞ্চলের শ্রোতাকেও। এখনো তাই গ্রামগঞ্জের বাজারগুলোতে বাজতে থাকে বারী সিদ্দিকী।
১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর ভাটি অঞ্চলের এই জেলাতেই আবদুল বারী সিদ্দিকীর জন্ম। পরিবারেই শৈশবে তার গান শেখার হাতেখড়ি হয়। কিশোর বয়সে নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন বারী। পরে ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ বহু গুণীশিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য পান। একটি কনসার্টে বারী সিদ্দিকীর গান শুনে তাকে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন ওস্তাদ আমিনুর রহমান। পরে ছয় বছর ধরে চলে সেই প্রশিক্ষণ। সত্তরের দশকে নেত্রকোনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হন বারী সিদ্দিকী। পরে ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ধ্রæপদী সঙ্গীতের ওপর পড়াশোনা শুরু করেন। এক সময় বাঁশির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং উচ্চাঙ্গ বংশীবাদনের প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন বারী। দেশে ফিরে লোকগানের সঙ্গে ধ্রæপদী সঙ্গীতের মিশেলে গান শুরু করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে বাঁশি বাজিয়ে বেড়ানোর মধ্যেই ১৯৯৩ সালে হুমায়ূূন আহমেদের জন্মদিনে তার বাসায় এক অনুষ্ঠানে বাঁশি শোনাতে যান বারী সিদ্দিকী। সেই অনুষ্ঠানে বারীর বাঁশির চেয়ে তার কণ্ঠে গাওয়া রশিদ উদ্দিন বাউল আর উকিল মুন্সির গানই বেশি পছন্দ হয় হুমায়ূনের। পরে লেখক হুমায়ূনের আগ্রহেই বারীর কণ্ঠে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়,’ ‘পুবালি বাতাসে’ গানগুলো রেকর্ড করা হয়। টেলিভিশনে ‘রঙের বাড়ই’ নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটি প্রচার করা হলে বারী সিদ্দিকী পৌঁছে যান সারাদেশের শ্রোতাদের হৃদয়ে। ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে ছয়টি গানে কণ্ঠ দেন বারী সিদ্দিকী। গানগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘শুয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’ এবং ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’। ‘শুয়া চান পাখি’ গানটি সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ওই বছরই জেনেভায় বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে যোগ দেন বারী সিদ্দিকী। পরে রূপকথার গল্প, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ, ও আমার দেশের মাটিসহ আরো কয়েকটি চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাকে গেয়েছেন এই শিল্পী। তার কণ্ঠের গান নিয়ে ডজনখানেক অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছে। বারী সিদ্দিকী ১৯৮৬ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে। বারী সিদ্দিকীর দুই ছেলে এক মেয়ে। ১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন।
২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর হাজারো ভক্তকে কাঁদিয়ে বিদায় নেন এ গুণীশিল্পী। হৃদরোগ ছাড়াও কিডনি জটিলতায় ভুগেছিলেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। ১৭ নভেম্বর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে বারী সিদ্দিকীকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। সাত দিন আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হলেও তার অবস্থার অবনতি ঠেকানো যায়নি। রাত আড়াইটার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও বাঁশিবাদক।

– মেলা প্রতিবেদক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়