৪৮ ঘণ্টার অবরোধ সফল করার আহ্বান বিএনপির

আগের সংবাদ

বাদ পড়ার শঙ্কায় ঘুম হারাম : রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে নৌকার মনোনয়ন চূড়ান্ত, টিকেট পাচ্ছেন না অনেক এমপি

পরের সংবাদ

হারিয়ে ফেলা ভালো লক্ষণ নয়

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমরা দেশের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার মধ্যে অনেক কিছু ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি। তা ছাড়া খাল-বিলের মধ্যে অধিকাংশের অস্তিত্বও বিলীন হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে বিভিন্ন রকমের খেলাধুলাও হারিয়ে গেছে। একটি দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য- এটা ভালো লক্ষণ নয়। কথায় আছে, একটি দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং কৃষিসহ অনেক বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়।
এগিয়ে যাওয়ার পথগুলো ভালোভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়, লালন করতে হয়। পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হয়। এগিয়ে যেতে হলে দেশের সব ফসল উৎপাদন, প্রাকৃতিক মাছ, খেলাধুলা, বিভিন্ন রকম পিঠা, সংগীত-নৃত্য, নদী-নালা, খল-বিল, ডোবা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে রাখতে হবে- হারিয়ে যাক বলে এদের ভুলে গেলে চলবে না। অতীতের অতি দরকারি জিনিসের উন্নয়নের দিকটি ভুলে যাওয়া হবে বোকামি।
আমরা জানি ঢাকার ‘বুড়িগঙ্গা’ নদীর পানি অতি দূষণের শিকার, মুখে নেয়া যায় না। ‘তুরাগ’ নদের পানিরও কাছাকাছি অবস্থা। শুধু তাই নয়, রাজধানী ঢাকা আজ অন্যতম বায়ুদূষণের নগরী। এমনটা হয়েছে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির অভাবে। আমাদের ছোট্ট এ দেশটির জন্য খনিজসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ বিষয়েও নিজের দেশের যোগ্যতম অনুসন্ধানীদের কাজে লাগাতে হবে। অনেক অভিজ্ঞ, দক্ষ প্রকৌশলী আছে আমাদের দেশে। তারপরও তাদের জরুরি ভিত্তিতে আরো দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
আমরা জানি গ্রাম বাংলার মানুষ আগের দিনে গরু দিয়ে হাল চাষ করত। প্রত্যেকের ঘরে এক-দুই জোড়া হালের ‘গরু’ ছিল। আরো ছিল ‘গাভী’ ও ‘ছাগল’। মানুষ এদের দুধ খেত সারা বছর। ‘গরু’, ‘গাভী’, ‘ছাগল’ এখন আর ঘরে ঘরে নেই। আছে গ্রামের মাত্র দুই-একটা পরিবারে। গরু-গাভী নেই বলে এখন ‘লাঙল’, ‘জোয়াল’, ‘মই’- আঞ্চলিক ভাষায় ‘চগম’, ‘আচড়া’, ‘কাবাইর’, ‘পাজুইন’, ‘ইটাবাড়ি’ কিছুই নেই।
গ্রামের মানুষ আগে পাট চাষ করত। পাট বিক্রি করে সংসার চালাত। পাট ছিল তখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। পাট চাষ আজ হারিয়ে গেছে। পাট ক্ষেতে থাকত ‘শিয়াল’। এখন আর পাট চাষ নেই বলে, গ্রামে এখন ‘পাটশোলা’ নেই। পাট ক্ষেত নেই বলে এলাকায় আগের মতো ‘শিয়াল’ও নেই। ‘পাট কাটা’, ‘পাট ভিজানো’, ‘পাট লওয়া’, ‘পাট ধোয়া’ এবং ‘পাট শুকানো’র চিত্র আজ চোখে পড়ে না।
শুধু তাই নয়, কারোর বাড়িতে এখন আর ‘পাটের কাড়ি’ নেই, নেই ‘পাটশোলার কাড়ি’। তাই তো এখন আর পাটশোলা দিয়ে ‘ধান সিদ্ধ’ করা, চুলায় রান্না করার চিত্রও দেখা যায় না। শুধু তাই নয়, পাটশোলা দিয়ে বানানো হতো ‘আওতা বেড়া’, যা ছিল মেয়েদের পর্দা বেড়া, পাটশোলার পর্দাবেড়া তাও এখন নেই।
এলাকায় আগে পুকুর পাড়ে অনেক ‘তুলা গাছ’ ছিল। আবার মানুষ করত ‘কারপাস তুলার’ চাষ। ঘরে ঘরে ছিল ‘চড়কা’, করত সুতা তৈরির কাজ। উৎপাদিত তুলায় চলত টেক্সটাইল মিলগুলো। তুলার অভাবে আজ অনেক মিল বন্ধ হয়েছে।
আবার ধানের মধ্যে ছিল ‘নাজিরশাইল’, ‘গরচা’, ‘তিলি বাজাল’সহ অন্যান্য ধান। আরো ছিল ‘ধোন্দা’, ‘কাউন’। এলাকায় বছরে কয়েক মাস ধান সিদ্ধ, ধান শুকানো, খড় শুকানোর ধুম লেগেই থাকত। প্রত্যেকের ঘরে ছিল ধান-চাল রাখার জন্য ‘ডোল’, ‘মটকা’। ঢেঁকিতে ‘ধান ভানা’, ‘চাল গুঁড়া’ করা প্রত্যেকের জন্য ছিল বড় কাজ।
আরো থাকত চালের গুঁড়া দিয়ে ‘খোলা পিঠা’, ‘বড়া পিঠা’, ‘ফুল পিঠা’র মতো অন্যান্য ‘পিঠা’ ও ‘চিড়া’ তৈরির প্রতিযোগিতা। তখন প্রত্যেকের ঘরে ছিল মাটির ‘হাঁড়ি-পাতিল’। ছিল ‘মাটির কলসি’, ছিল পাটের তৈরি ‘ছিক্কা’। আরো ছিল ‘হারিকেন’, ‘কুপি’, ‘ঠনা’। এগুলো এখন আর নেই। এক সময় মানুষ ‘পিঁড়ি’তে বসে খেত, এটাও অনেকটা কমে গেছে। তখন প্রতি পরিবারেই থাকত ‘ঢেঁকি’, ‘কাইল’, ‘ছিয়া’, ‘কুলা’, ‘ডুলা’, ‘চালনি’। তখন প্রায় প্রত্যেক পরিবারে থাকত বার্ষিক কামলা বা কাজের লোক। তাদের প্রায় সবাই ‘হুক্কা’য় ‘তামাক’ খেত, ‘বেনা’য় আগুন জ্বালিয়ে রাখত। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষায় তারা মাথায় দিত ‘মাথলা’, ‘জোংড়া’।
বাড়িতে যখন বিভিন্ন রকম ‘পিঠা’ এবং ফলের আয়োজন থাকত তখন মেয়ের জামাই, বোনের জামাই এবং তাদের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত দেয়া হতো। আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসতেন। এতে সবার মাঝে বাড়ত আন্তরিকতা। তাই আনন্দময় হয়ে উঠত দাওয়াতের অনুষ্ঠানটি।
এখন আর নেই ‘আন্তা’, ‘কৈয়া জাল’ পাতা, ‘বড়শি’ পাতার দৃশ্য। নেই খালগুলোতে ‘বাঁশের সাঁকো’, ‘কাঠের সাঁকো’। নেই ছেলেমেয়েদের পানিতে ‘লাফ-ঝাঁপ’। নেই ‘শাপলা-শালুক’, ‘শামুক-ঝিনুক’ কুড়ানোর আনন্দ। নেই ‘কোচ’, ‘টেডা’, ‘সাবল’, ‘খোন্তা’, নেই ‘ধর্ম জাল’, ‘কুনীজাল’, ‘পাসন জাল’, নেই ‘পলো’। নেই পুকুর-ডোবা থেকে হাতিয়ে মাছ ধরার চিত্র।
নেই পুকুরে ‘সাঁতার কাটা’, নেই গাছ থেকে পানিতে ‘লাফ দেয়া’র চিত্র। গ্রামে এখন আর নেই ‘কলার ভেলা’ও।
নেই গ্রামের প্রতি পরিবারে ‘নৌকা’, নেই নৌকায় জাল দিয়ে পুকুর-ডোবা থেকে মাছ ধরার চিত্র।
এখন আর সম্ভব হয় না ‘ছইয়া নৌকা’য় নানা বাড়ি, ফুফু বাড়ি যাওয়া। এখন আর দেখা মেলে না এলাকায় ‘বাদাম দেয়া নৌকা’। নেই ‘ছটকি’ দিয়ে আগের মতো বক ধরার চিত্র।
আগে এলাকার সমবয়সি এবং স্কুল, কলেজগুলোতে হতো ‘সাঁতার’ প্রতিযোগিতা, ‘ফুটবল’, ‘ভলিবল’ প্রতিযোগিতা। এলাকায় হতো হাডুডু, ‘গোল্লাছুট’, ‘দাড়িয়াবান্দা’, ‘টেমডাং’, ‘কানামাছি’, ‘চাড়াখেলা’সহ আরো অনেক খেলাধুলা। ‘হাডুডু’, ‘গোল্লাছুট’, ‘সাঁতার’ প্রতিযোগিতাও হতো গ্রামের সমবয়সিদের মধ্য।
এলাকার খাসজমিগুলো ছিল খেলার মাঠ। তখন এলাকায় অনেকের মধ্যে ছিল ‘ঘুড়ি’ উড়ানোর আনন্দ। ঘুড়ির মধ্যে ছিল ‘হাফা’, ‘পত্তন’, ‘ডাবুইস’, ‘তেলেঙ্গা’র মতো আরো অনেক ঘুড়ি। ঘুড়িতে থাকত ‘বোমা’, বাতাসে বাজত দিন-রাত।
এলাকায় এখন আর আগের মতো হয় না ‘যাত্রা’, ‘নাটক’, ‘জারিগান’, ‘পালাগান’। নেই ‘সার্কাস’, ‘জাদু’ দেখানোর আয়োজন।
কমে গেছে ওঝাদের ‘সাপের খেলা’, ‘শিঙ্গা’ লাগানো ও ‘কবিরাজি’ চিকিৎসার ব্যবস্থা। এখন গ্রামে নেই রাতের বিয়েতে বরযাত্রী ‘পাল্কি’তে যাওয়ার ব্যবস্থা। নেই কলাগাছের ‘সিংহ দরজা’র আয়োজন। এখন আর নেই বিয়ের পর বউকে ‘পালকি’ দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নেয়ার ব্যবস্থা।
এখন আর আগের মতো নেই এলাকায় বড় বড় ‘বটগাছ’। যেখানে পথচারীরা ক্লান্তি দূর করত বটগাছের ছায়ায় নির্মল বাতাসে। এমন চিত্র এখন আর নেই, সব হারিয়ে গেছে।

মো. এনামুল হক খান : প্রকৌশলী, রামপুরা, ঢাকা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়