৪৮ ঘণ্টার অবরোধ সফল করার আহ্বান বিএনপির

আগের সংবাদ

বাদ পড়ার শঙ্কায় ঘুম হারাম : রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে নৌকার মনোনয়ন চূড়ান্ত, টিকেট পাচ্ছেন না অনেক এমপি

পরের সংবাদ

সোহেল তাজের তিন দফা ও ইতিহাসের আর্তনাদ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শোকাবহ আগস্টের পর নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবন ও ইতিহাসের অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বেদনাবিধুর একটি মাস। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যা এবং ৭ নভেম্বর তথাকথিত সিপাহি-জনতা বিপ্লবের নামে বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যার দিন হিসেবে এ মাসটি জাতীয় ইতিহাসে আরেকটি কালো অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতিসত্তাকে চিরতরে হত্যা করার লক্ষ্যে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যা-পরবর্তী এ দুটি মৌলিক আদর্শ যাতে পরবর্তীতে জাতির মধ্যে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চারিত ও অভিষিক্ত না হতে পারে সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর শতভাগ সুযোগ্য উত্তরসূরি চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। বস্তুত ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর ছিল একই ঘৃণ্যসূত্রে গাথা জাতীয় ইতিহাসের দুই মর্মন্তুদ ঘটনা প্রবাহ। আর ৭ নভেম্বর ছিল ওই দুটি ঘৃণ্য পৈশাচিক ঘটনারই দুরভিসন্ধিমূলক পরিণতি। বছরের এই বিদগ্ধ নভেম্বরের ২ তারিখে চার মহান নেতার অন্যতম নেতা পরম শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দীনের তনয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ তিন দফা বাস্তবায়নের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার গণভবনে শতাধিক অনুসারী সমেত হাজির হন। দাবিগুলো- ১. ১০ এপ্রিল প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা, ২. ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা, ৩. জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সব বেসামরিক ও সামরিক সংগঠক, পরিচালক, শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনবৃত্তান্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা। অবশ্য এর আগে ১০ এপ্রিল একইভাবে তিনি এই তিন দফা দাবি জানিয়েছিলেন। তার এই দাবির প্রতি এ দেশের ইতিহাস সচেতন মানুষদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বহিঃ ও ঘরোয়া শত্রæ চক্রের যৌথ ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। অগণন বিসর্জনের বিনিময়ে অবশেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের নিষ্পেষণ থেকে আমরা মুক্তি পেলেও দ্বিজাতিতত্ত্বের অবাস্তব বিভাজনের প্রহসনী প্রভাব থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম না। অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রলোভন দেখিয়ে নিখিল পাকিস্তান গঠিত হলেও কার্যত ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শাসক পশ্চিম পাকিস্তানের নিদারুণ নিষ্পেষণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিষ্পেষণকেও কার্যত হার মানিয়েছিল। দীর্ঘ দুই যুগব্যাপী পূর্ব বাঙালির জীবনে-মননে ক্রমেই সৃষ্ট পুঞ্জীভূত কষ্ট-ক্ষোভ বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী অগ্নিমুখর নেতৃত্বের সংস্পর্শে জাজ¦ল্য হয়ে বহু ত্যাগের ধাপ পেরিয়ে তা ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি লাভ করে। একদা যে আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকানন যেন সেই বিষণ্ন আম্রকাননের প্রসন্ন রূপ পরিগ্রহ করে সেই ব্যথিত অস্তমিত সূর্যের আমোদিত উদয় ঘটিয়েছিল। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা ঘোষণা হওয়ার পর অন্তরীণ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান (এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) করে গণপরিষদ কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর ঘোষণা পত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন করা হয়। বলাবাহুল্য, গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক এম ইউসুফ আলি স্বাক্ষরিত ওই ‘ঘোষণা পত্র’-ই ছিল বিজয় পূর্ব বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, যা পরবর্তী ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত ও প্রচারিত হয়। সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করে এই সরকার শপথ নেন এবং কার্যক্রম শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়, যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা এমনকি যুদ্ধকালীন চরমতম সংকটের মধ্যেও সীমিত সম্পদ এবং বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত আর্থিক সহায়তায় এই সরকার শতভাগ নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে একটি বাজেট প্রণয়ন করেছিল। সর্বোচ্চ মেধা ও মননের সংযোগ ঘটিয়ে সম্মুখ সমরে ক্ষত-বিক্ষত স্বাধীনতাকাতর একটি জাতিকে এ রকম একটি সুদূরপ্রসারী রাষ্ট্রবিজ্ঞানভিত্তিক সরকার গঠনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দান করে সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ড ও জাতিকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বীরত্বপূর্ণ সফলতার শিখরে পৌঁছে দেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো নজিরবিহীন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ’৭১-এর পরাজিত শক্তি স্বাধীনতা-পরবর্তী দ্রুত অগ্রসরমান বাংলাদেশকে পশ্চাৎপদ করতে নিরপরাধ অন্তরীণ চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে চার জাতীয় নেতার প্রমাণিত রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও গভীর প্রাজ্ঞতা খুনিদের ভয়ের কারণ ছিল। খুনিরা বুঝতে পেরেছিল যে, এরা বেঁচে থাকলে তাদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য কখনোই সফল হবে না। হত্যার পূর্বে খুনি মোশতাক গং তাদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে।
উল্লেখ্য, হত্যার পর লালবাগ থানায় জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যে জিডি করা হয়েছিল তা-ও পরে বিনষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি আবু সায়েমের আমলে জেল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ হোসেন ও বিচারপতি কে এম সোবহানের সংশ্লিষ্টতায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গঠিত তদন্ত কমিশন রহস্যময় কারণে তখন হিমঘরে চলে গিয়েছিল। তদন্ত কমিশনকে বৈঠক করারও সুযোগ দেয়া হয়নি, যা ১৯৭৭ সালের ৪ এপ্রিল হতে ১২ এপ্রিল অবধি তৎকালীন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে। আবার ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ কুইন্স কাউন্সিলের বিখ্যাত আইন প্রণেতাগণ- স্যার থমাস উইলিয়াম, মি. সিন ম্যাক ব্রাইড, মি. জেফরি থমাস এবং মি. আবরে রোজ- এই চার বিশিষ্টজনের সমন্বয়ে জাতির জনক ও চার জাতীয় নেতা হত্যার বিষয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে তদন্ত কমিটির পক্ষে এমপি জেফরি থমাস তদন্ত বিষয়ে বাংলাদেশে আসতে চাইলে তৎকালীন বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাকে বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দেন। এর পূর্বে ১৯৮০ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যার বিচারের দাবিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। সেই হরতালকে বানচাল করার জন্য জিয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের পাশাপাশি তার দলীয় পেশীশক্তিরও যথেচ্ছা অপব্যবহার করে। সেই সময় দুজন নেতা নিহত হন এবং কমপক্ষে ১৫০ জন আহত হন। গ্রেপ্তার হয় কয়েকশ। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মিছিলের ওপর জিপগাড়ি তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ফিল্মি স্টাইলে হামলা করে। বলাবাহুল্য, ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের মতো লোমহর্ষক ও ঘৃণ্যতম ঘটনার ন্যূনতম তদন্ত ও বিচারের সব দ্বার খুনি মোশতাক-জিয়া গং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের মাধ্যমে বন্ধ করে দিয়েছিলেন, যা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে জঘন্যতম কলঙ্কময় উদাহরণ আর হতে পারে না। জিয়া ইতিহাস-ঐতিহ্য বিকৃতির মধ্য দিয়ে জাতির মগজ থেকে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা মুছে দেয়ার মাধ্যমে চিরায়ত বাঙালি জাতিসত্তাকে হত্যা করার বিচিত্র গভীর নগ্ন-মনস্ততাত্ত্বিক খেলায় মেতে ওঠেন, যা এই স্বল্প পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। সময়ের আবর্তে সেই বিকৃত ইতিহাসের নষ্ট-ভ্রষ্ট ধারায় রীতিমতো একটি প্রজন্ম বেড়ে ওঠে। জাতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন সেই বিকৃত প্রভাবিত, বিচ্যুত হয়ে বাঙালি জাতিসত্তা বিবর্জিত পথে যথেষ্ট ধাবমান, যা একটি গভীর অশনিসংকেত বটে! সোহেল তাজের তিন দফা একটি সময়োপযোগী দাবি, যাতে ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঘাতকদের স্বরূপ বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম যথার্থ উপলব্ধিকরণের পাশাপাশি বিকৃত ইতিহাস বিবর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত ইতিহাসে বিশ্বস্ত ও আসক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর চিরপ্রত্যাশিত একটি সত্যিকার অহিংস ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক সোনার বাংলা গড়নে সচেষ্ট হতে পারে।

কাজী মাসুদুর রহমান : লেখক, ঢাকা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়