প্রতারণার মামলা : জামিন পেলেন দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত হেলেনা জাহাঙ্গীর

আগের সংবাদ

আওয়ামী লীগে মনোনয়ন যুদ্ধ : দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু আজ, কার্যক্রমের সূচনা করবেন শেখ হাসিনা

পরের সংবাদ

ভাসানী-মুজিব সম্পর্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কটা ছিল দ্ব›দ্ব-মধুর। তাতে মাধুর্য ছিল স্নেহ-ভালোবাসার। আবার দ্ব›দ্বও ছিল দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানগত কারণে। উভয়েই ছিলেন গভীরভাবে বাঙালি, বাঙালির মুক্তির জন্য তাদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, তৎপরতা ছিল অদম্য। আবার তারা এসেছেনও একই শ্রেণি থেকে। একই সঙ্গে সংগঠন করেছেন, কারাভোগ করেছেন, সময় কাটিয়েছেন। আগরতলা মামলায় বন্দি অবস্থায় থেকে মওলানাকে মুজিব যে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন তাতে তপ্ত এক বারুদস্তূপে আগুন ধরেছিল, মওলানা জ্বলে উঠেছিলেন; হাজার হাজার মানুষের জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, মুজিবকে মুক্তি না দিলে জনগণকে নিয়ে মুজিবকে তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে আনবেন, ফরাসি বিপ্লবের মতো ঘটনা ঘটে যাবে। বিক্ষোভ ও ঘটনা নানা দিক থেকেই ঘটছিল, কিন্তু ভাসানীর অবস্থানই ছিল নির্ধারক। মুজিব মুক্তি পেয়েছিলেন, আগরতলা মামলা প্রত্যাহৃত হয়েছিল। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের জন্য সেটি ছিল প্রথম বড় পরাজয়, একাত্তরে দ্বিতীয় পরাজয়ের আগে।
শুরুতে দুজনের চলাটা ছিল একই পথে, আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে। হাজী দানেশ জানাচ্ছেন, ১৯৫০ সালে ঢাকা জেলে বসে মুজিবের সঙ্গে ভাসানী সশস্ত্র সংগ্রামের কথা আলাপ করতেন। কিন্তু ভাসানী তো কেবল স্বাধীনতার কথা ভাবেননি, ভেবেছেন মুক্তির কথাও। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ এ কথা মুজিবও অবশ্য বলেছেন, ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতায়। কিন্তু দুজনের সামনে মুক্তির পথ মোটেই অভিন্ন ছিল না। ভাসানীর জন্য মুক্তির পথটা ছিল সামাজিক বিপ্লবের; মুজিবের জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রের। পার্থক্যটা একেবারেই মৌলিক। বলা যায় রাজনীতির দুই ধারার। দৃষ্টিভঙ্গির এই ব্যবধানটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল; চূড়ান্ত হয় ন্যাপ গঠনের সময়ে। ১৯৬৯-এ গোলটেবিল বৈঠকে ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় ফিরে শেখ মুজিব যে বলেছিলেন ভাসানীর বয়স হয়েছে, তার রিটায়ার করা উচিত; এমন কথা কি তিনি সোহরাওয়ার্দীকে কখনো বলতে পারতেন? বোধ হয় না। কারণ ওটি শুধু বিরক্তির কথা ছিল না, ছিল রণনীতির ভিন্নতার কথাও, যে ভিন্নতা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা দেয়নি। প্রয়োজনের চাপে বাধ্য হয়ে সোহরাওয়ার্দীকে তিনি বড় জোর বলতেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকে লড়তে হবে স্বাধীনতার জন্য, পাকিস্তানকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার থাকুক, এখন যেমন আছে।’
কিন্তু মিল তো অবশ্যই ছিল দুজনের- ভাসানী ও মুজিবের। তারা উভয়েই ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিক। প্রজ্ঞা ও সাহস উভয়ের জন্যই ছিল বড় সম্পদ। তারা কেউই বৈঠকখানার রাজনীতি করতেন না, আবার গোপন রাজনীতিও নয়। তারা মাঠে ময়দানে ছিলেন, অনায়াসে চলে গেছেন কারাগারে, বের হয়ে আবারো শামিল হতেন একই কাজে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সুবিধাবাদী মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত ও দলছুটদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনে দুজনেরই ছিল প্রবল আপত্তি; যদিও পরিস্থিতির চাপে তাদের পক্ষে বিরোধিতার অনড় অবস্থানে থাকা সম্ভব হয়নি। সাংগঠনিক ক্ষমতা দুজনেরই ছিল অসামান্য। ব্যক্তিত্বতেও তারা অসাধারণ। শুরুতে তাদের চিন্তাধারার ঐক্য ছিল।
আন্তর্জাতিক বিষয়ে মুজিব তেমন একটা মাথা ঘামাতেন না বলে সোহরাওয়ার্দী উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তৎপরতার বিষয়ে তিনি যে অমনোযোগী ছিলেন তা মোটেই নয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ১৯৫৪ সালে ‘পাকিস্তান-আমেরিকান মিলিটারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং পরে পাকিস্তান সিয়াটো ও সেন্টো বা বাগদাদ চুক্তিতে যোগদান করে পুরোপুরি আমেরিকার হাতের মুঠোর মধ্যে চলে যায়, […] চুক্তির মধ্যে যা আছে তা পরিষ্কারভাবে কমিউনিস্টবিরোধী বলা যেতে পারে।’ বোঝা যাচ্ছে ওই পর্যায়ে তিনি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নীতি চাচ্ছিলেন, যেটি আওয়ামী লীগেরও দাবি ছিল। তিনি আরো স্মরণ করেছেন যে ১৯৫৪-এ ‘গ্রেপ্তারের পূর্বেই পাক-আমেরিকান মিলিটারি প্যাক্টের বিরুদ্ধে এক যুক্ত বিবৃতি দিই।’ ওই সময়ে তিনি ভাসানীপন্থিই ছিলেন, সোহরাওয়ার্দীপন্থি হয়েছেন সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিত্বপ্রাপ্তির পরে। ১৯৬৪-তে ভাসানীর পাল্লাটা অনেক ভারী ছিল, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত ২২২ জন সদস্যের মধ্যে ১৬৮ জনই সামরিক চুক্তিবিরোধী ওই বিবৃতিতে দস্তখত দেন। ১৯৫৭-তে এসে ভারসাম্যটা উল্টে যায়, যে জন্য ন্যাপ গঠিত হয়। বলাবাহুল্য এই পরিবর্তনে শেখ মুজিবের সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রত্যক্ষ। ওই সময়ে এমন সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় যে যুবলীগের নেতারা অর্থাৎ কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগের ভেতরে থেকে আর কাজ করতে পারবেন না। এতে মুজিবের সম্মতি ছিল।
মুজিব যে সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির দিকেই ঝুঁকবেন এটা ছিল অবধারিত। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, কারাবন্দি অবস্থায় তিনি খবরের কাগজে পড়েছেন যে আতাউর রহমান খান জুরিখ যাচ্ছেন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে এবং সেখান থেকে বিলাত যাবেন ভাসানীর কাছে। খবরটা তাকে চিন্তিত করেছিল, তার সন্দেহ হয়েছিল কোনো একটা ষড়যন্ত্র চলছে, পরে যখন শুনলেন সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী হয়েছেন তখন তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছেন এবং তার মধ্যে একটা হতাশার ভাবও জেগে উঠেছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ১৯৫৫-তে এসে শেষ হয়েছে, ফলে পরবর্তী ঘটনার কথা তাতে আসেনি। কিন্তু পরবর্তী ঘটনা তো এটাই যে আওয়ামী লীগ ভাঙল এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিত্ব শুধু মেনে নিতেই হলো না, তার সঙ্গেই থাকতে হলো। সেটাই করতে হতো, কারণ ভাসানীর পথটা তো উল্টো দিকের।
সোহরাওয়ার্দী লক্ষ করেছেন যে মুজিব পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বেশি একটা মাথা ঘামাতেন না সেটা ঠিক, কিন্তু তিনি তার লিডার সোহরাওয়ার্দীর এই বক্তব্য অবশ্যই মানতেন যে রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতার দ্ব›দ্ব এবং এই দ্ব›েদ্ব শক্তি সংগ্রহ করতে হলে আমেরিকার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অপরদিকে ভাসানী বিশ্বাস করতেন আন্তর্জাতিকতায়; সারা বিশ্বের উৎপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রাম তাকে আকর্ষণ করত এবং পূর্ববঙ্গের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের যে ঔপনিবেশিক শাসন সেটি যে সাম্রাজ্যবাদের, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ঘটছে এ জিনিসটা তার কাছে মোটেই অপরিষ্কার ছিল না। তাই তিনি ছিলেন যাকে বলে কট্টর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সেটাই।
ওদিকে আমেরিকাকেও তখন চতুর্দিকে মিত্র খুঁজতে হচ্ছে, বিশেষ করে কমিউনিজমের ভীতিতে। পাকিস্তানকে সেন্টো সিয়াটোতে টেনে নেয়ার কারণ কমিউনিস্টদের রুখবার চিন্তা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পূর্ববঙ্গে যে জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সে-বিষয়ে তারা পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিল এবং তাদের উদ্বেগ ছিল এ আন্দোলন পাছে কমিউনিস্টদের হাতে চলে যায়, ভিয়েতনামে যেমনটা ঘটেছে। ন্যাপের অভ্যুদয় দেখে তাদের উদ্বেগ বাড়ারই কথা; তাদের সমর্থন তাই আওয়ামী লীগের দিকে থাকবে- এটা আশা করাটা অসঙ্গত ছিল না।
অতিপ্রগতিশীলরা অবশ্য তাদের কাজের এরকম ব্যাখ্যা মোটেই মানবেন না। তাদের বক্তব্য, বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুর্জোয়া নেতারাই অকার্যকর করেন, এবং জনগণের কাছে তারা তাদের ব্যর্থতা নিজেরাই প্রমাণ করে দেন, কারণ তারা নিজেদের স্বার্থটাই শুধু দেখেন, জনগণের স্বার্থকে পদদলিত করে। ভাসানী এই অতিপ্রগতিশীলদের দিকেই ঝুঁকেছিলেন, সে জন্য একদা ভাসানী-মুজিবের যে সম্পর্কটা ছিল গুরু-শিষ্যের, সে-সম্পর্কটি টেকেনি, বিচ্ছেদ ঘটেছে।
আর্চার ব্লাড ভাসানীর সঙ্গেও কথা বলেছেন। তার কৌতূহল ছিল ওই নেতা সম্পর্কে জানবার। কারণ একদিকে রাজনীতিতে মওলানার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ অন্যদিকে তার সম্পর্কে নানা রকমের বর্ণনা তিনি শুনেছেন, যেমন- ‘সধমহবঃরপ, ষড়াধনষব, ধ সুংঃরপ, ধ ঈড়সসঁহরংঃ, ঃযব ঢ়ধঃৎড়হ ংধরহঃ ড়ভ ষবভঃরংঃং, ধ ংবহরষব ড়ষফ ভড়ড়ষ, ধহফ ৎবাবৎবফ যবৎড় ঃড় ঃযব ারষষধমবৎং ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ.’ কৌতূহল নিয়ে দেখা করতে গেছেন এবং গিয়ে হতাশ হয়েছেন। দোভাষীর মাধ্যমে দুই ঘণ্টা ধরে আলোচনা করে বুঝেছেন যে ভাসানীর ধরনটা হলো একজন প্রান্তিক বিপ্লবীর, যিনি জ্বালাও-পোড়াও ধরনের বাগবিস্তারের মাধ্যমে এমন ভাব করছেন যে কেবল আইয়ুবের সরকারকেই যে হটাবেন তা নয়, গোটা সমাজটাকেই তিনি পাল্টে দেবেন। শেষ পর্যন্ত আর্চার ব্লাডের মূল্যায়নটা দাঁড়িয়েছে এই রকমের যে, মওলানা ভাসানী আসলে একজন ‘ৎধননষব-ৎড়ঁংবৎ যিড় ংড়সবঃরসবং ধিষশং ষরশব ধ ঢ়ড়ষরঃরপরধহ.’ সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাও যা হোক মেঠো বক্তা বলেই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন, ইনি আরো উচ্চে তুলেছিলেন মওলানাকে। মওলানাকে রাজনীতিক বলতেই তিনি রাজী নন, তাকে রাস্তার লোক-ক্ষেপানোর মানুষ হিসেবেই তিনি দেখতে পেয়েছেন। কারণ আছে। একটা কারণ মওলানা ইংরেজি জানতেন না, কথাবার্তা হয়েছে দোভাষীর মাধ্যমে। দ্বিতীয় কারণ মওলানার ঘরবাড়ি ও পোশাক-পরিচ্ছদ সুবিধার ছিল না। তার লুঙ্গিটা যে খুব পরিষ্কার ছিল না এটাও ওই রাষ্ট্রদূত লক্ষ করেছেন। সবচেয়ে বড় কারণ অবশ্য এই যে, তারা পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মানুষ। ভাসানীর কাছে আর্চার ব্লাড গেছেন মার্কিন সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আর ভাসানী তো হচ্ছেন দুর্বিনীত রকমের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। আরো একটা ব্যবধান অবশ্য ছিল; ক্লার্ক হচ্ছেন পিতৃতান্ত্রিকতার সমর্থক, আর ভাসানী হচ্ছেন পিতৃতান্ত্রিকতার তথা কর্তৃত্ববাদের ঘোরতর বিরোধী। সে জন্য রাষ্ট্রদূতের মনে হয়েছে যে লোকটা শুধু নৈরাজ্যই সৃষ্টি করতে চায়, আর কিছু নয়। কূটনীতিক হিসেবে ক্লার্ক যে মুজিবের স্বাধীনতামুখিতাকে সমর্থন করেছেন তা নয়, তবে মোটামুটি সহানুভূতিশীল যে ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। আমেরিকানদের কাছ থেকে তেমন সহানুভূতি ভাসানীর প্রাপ্য ছিল না, প্রাপ্য ছিল বিরোধিতা, যেটা তিনি পেয়েছিলেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়