৯৭ সহকারী জজ নিয়োগ

আগের সংবাদ

সমঝোতার সম্ভাবনা কী শেষ! বিশ্লেষকদের মতে, সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি > উদ্যোগ নিতে হবে দেশের ভেতর

পরের সংবাদ

ধর্মের ভিত্তিতে ভাষার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন গান্ধী

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারতবর্ষ কখনো এককেন্দ্রিক শাসনাধীনে কিংবা একক রাষ্ট্র ছিল না। ছিল না একটি দেশ এবং এক জাতির অস্তিত্বও। মৌর্য, গুপ্ত, সুলতানী, মোগল শাসনের যুগেও ভারতবর্ষ একীভূত কোনো রাষ্ট্র ছিল না। অজস্র খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল। রাজ্যগুলো সম্রাটদের আনুগত্য স্বীকারে প্রদান করত ধার্যকৃত রাজস্ব-কর। নিজ নিজ রাজ্যের শাসনক্ষমতা রক্ষায় স্থানীয় শাসকদের বিকল্প উপায়ও ছিল না। দিল্লির সম্রাটের আনুগত্য অস্বীকারের পরিণতিতে ঘটত সম্রাটদের আগ্রাসন, বেপরোয়া লুণ্ঠন, রাজ্য দখল। বিজয়ী সম্রাটকে অত্যধিক ভেট-মুচলেকা দিয়ে রাজ্যশাসনের ক্ষমতা ফিরে পেত পরাজিত রাজ্য শাসকরা। অনেক রাজ্য সম্রাটের আনুগত্য অস্বীকার করে টিকে থাকারও নজির ছিল। দূরবর্তী রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব হতো। আনুগত্যের ভিত্তিমূলে ছিল সম্রাটদের আর্থিক কর প্রদান। অতীত শাসকরা কেন্দ্রীভূত শাসনের অধীনে ভারতবর্ষকে একীভূত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারেনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধজয়ের পর একে একে দখলে নেয় গোটা ভারতবর্ষ। যুদ্ধ-বিগ্রহ, শঠতা-কৌশলতা, স্থানীয়দের বিশ্বাসভঙ্গের সুযোগে ভারতবর্ষকে এক রাষ্ট্রাধীনে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনাধীনের বাইরে করদরাজ্য ছিল কয়েকশ। সেসব করদরাজ্য স্থানীয় শাসকদের শাসনাধীনে ছিল। কেন্দ্রীয় শাসক ব্রিটিশদের বার্ষিক কর প্রদানের ভিত্তিতে স্থানীয় রাজ্যের শাসকরা ছিল চরমভাবে ব্রিটিশের অনুগত-তাঁবেদার। এক রাষ্ট্রাধীন ভারতে অজস্র রাজ্যের ভাষা-সংস্কৃতিগত পার্থক্য ছিল বহু-বিভাজিত। প্রত্যেকটি জাতিসত্তার ভাষা-সংস্কৃতি ছিল পৃথক এবং স্বতন্ত্র। কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল ছিল না।
ভারতের মানুষের মাতৃভাষা কয়েকশ। এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪১৫টি। এই ৪১৫টি ভাষার উপভাষার সংখ্যা ১৫৭৬টি (১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে)। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ২৯টি কথ্য ভাষায় ১০ লাখ মানুষ কথা বলে। ১২২টি কথ্য ভাষা ১০ হাজার মানুষের মুখের ভাষা। এছাড়াও অজস্র উপভাষা রয়েছে, যেগুলোর লিপি নেই। সেসব ভাষার অস্তিত্ব টিকে আছে মানুষের মুখে মুখে। বর্তমান ভারতের রাজ্যগুলোর ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। একই রাজ্যের একাধিক ভাষা যেমন রয়েছে। তেমনি একই ভাষা অপরাপর রাজ্যেও প্রচলিত আছে। ভারতের প্রাদেশিক সরকারি স্বীকৃত ভাষা- অসমীয়া, বাংলা, বোড়ো, ডোগরি, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মিরি, কোঙ্কনী, মৈথলী, মালয়ালম, মৈত্রৈ (মণিপুরী), মারাঠি, নেপালি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, সাঁওতাল, তামিল, তেলেগু, উর্দু, মিজো, ককবরক। ইংরেজি ভাষাও অনেক প্রদেশের সরকারি ভাষার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, যেমন অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, চণ্ডীগড়। ভারতের প্রাদেশিক ভাষাগুলোর তালিকাই প্রমাণ করে অপরাপর প্রাদেশিক ভাষার ন্যায় হিন্দিও প্রাদেশিক ভাষা। অনেক প্রদেশের সহকারী সরকারি ভাষা হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, মারাঠি, পাঞ্জাবি, [খাসি, গারো, ভুটিয়া, গুরং, লেপচা, লিম্বু, মাঙার, মুখিয়া, নেওরি, রাজ, শেরপা, তমাং ইত্যাদি সিকিম প্রদেশের সহকারী সরকারি ভাষা।]
প্রশ্ন থাকে বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারতে প্রাদেশিক হিন্দি ভাষা কেন সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পেছনে ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি এক রাষ্ট্রের সুবিধায় ভারতে বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার-প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। ব্রিটিশদের মুৎসুদ্দি রূপে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুযোগও হাতাতে পেরেছিল। তাদের মনস্কামনা পূরণে অন্তরায় ছিল ভাষার বিভক্তি। ব্রিটিশ ভারতেই ভারতীয় বুর্জোয়ারা স্বীয় স্বার্থে এককেন্দ্রিক শাসনের পাশাপাশি এক ভাষা ও এক জাতির আওয়াজ তুলেছিল। জাতি হিসেবে ভারতীয় এবং ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল তারা হিন্দি ভাষা-দেবনাগরী লিপি। নিজেদের কায়েমি স্বার্থে হিন্দি ভাষাকে ভারতের সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার ফন্দি এঁটেছিল; অপরাপর ভাষা-সংস্কৃতি, স্বজাত্যবোধকে বিলীন করে দেয়ার মতলবে। ব্রিটিশ ভারতে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ সম্ভব হলেও, তাদের পক্ষে হিন্দি ভাষাকে সর্বভারতীয় ভাষায় পরিণত করা সম্ভব হয়নি।
১৯১৫ সালে ভারতে ফিরে এসে গান্ধী সারা ভারতজুড়ে ভ্রমণ করেন। তখনই তিনি দেখতে পান ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা গো-রক্ষা এবং হিন্দি ভাষা প্রচলনে নানাবিধ পন্থায় মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে। গান্ধী সহসাই পুঁজিপতিদের পক্ষে সেই প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়ে যান। অর্থাৎ গো-রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি হিন্দি ভাষাকে সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার বুর্জোয়া শ্রেণির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই তৎপরতার মধ্য দিয়েই ভারতে গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। ১৯১৬ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘সর্বভারতীয় একভাষা ও একলিপি সম্মেলন’ গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালে হিন্দি ভাষা প্রচারে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উপ-কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন গান্ধী। ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থের জোগানে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু ন্যাশনাল কলেজে ১৯২০ সালের জুলাইতে গান্ধী বলেছিলেন, ‘হিন্দিই হবে সমগ্র ভারতের ভাষা এবং সেজন্য হিন্দি শেখা অন্য সমস্ত প্রদেশের কর্তব্য।’ গান্ধী প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন, ‘অহিন্দিভাষীদের হিন্দি শেখা হচ্ছে ধর্ম।’ ভারতীয়দের ধর্মীয় অনুভূতিতে হিন্দি ভাষা বিস্তারে ধর্মকে পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। হিন্দি ভাষাকে ধর্মীয় পর্যায়ভুক্ত করতেও দ্বিধা করেননি গান্ধী। গান্ধী লিখেছিলেন, ‘এলাহাবাদের হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোগে গত ১৮ মাসব্যাপী মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে হিন্দি ভাষার প্রচার খুব জোরালোভাবেই চলছে।’ হিন্দি ভাষাকে সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থানুকূল্যের বিষয়টিও স্বীকার করে গান্ধী বলেছিলেন, ‘হিন্দি প্রচারের কাজ ভারতের এই রাজতুল্য বণিকশ্রেণির বিশেষত্ব।’
১৯২১ সালে এক চিঠিতে গান্ধী মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর থেকেই আমি আপনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছি। আমার কাজে আপনারা প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। হিন্দি প্রচারের আন্দোলনকে আপনারা কার্যকরভাবে সমর্থন দিয়েছেন।’ গান্ধীর হিন্দি ভাষা প্রচারাভিযানে মাড়োয়ারিদের পাশাপাশি গুজরাটি, পার্শি বণিক শ্রেণিও আর্থিক সহায়তা প্রদানে পিছিয়ে ছিল না। বাংলা ও আসাম প্রদেশে হিন্দি প্রচারাভিযানে ১৯২৮ সালে হিন্দুত্ববাদী বুর্জোয়া ধনশ্যামদাস বিড়লাকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে কলকাতায় হিন্দি প্রচারের এক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে হিন্দি ভাষাকে জাতীয় ভাষায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজেন্দ্র প্রসাদকে সভাপতি করে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে ‘রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি’ গঠিত হয়। পরবর্তীতে স্বয়ং রাজেন্দ্র প্রসাদ লিখেছিলেন, ‘এর নীতি স্বয়ং গান্ধীজি নির্ধারণ করেছিলেন এবং আমাদের শিল্পপতি বন্ধুরা অর্থের জোগান দিতেন।’
হিন্দিভাষা ও দেবনাগরী লিপি সমগ্র ভারতীয়দের ওপর চাপানোর এই উদ্যোগে উত্তর প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। উর্দুভাষী মুসলমানদের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চারে তারা উপলব্ধি করে হিন্দির দৌরাত্ম্যে তাদের উর্দুভাষা-সংস্কৃতির বিলোপ ঘটবে। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে লক্ষেèৗতে মুসলিম লীগ অধিবেশনে সব মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার তীব্র নিন্দা জানায়।
১৯২৭ সালের জুলাইতে গান্ধী লিখেছিলেন, ‘সব ভারতীয় ভাষার একটি লিপি হওয়া উচিত এবং কেবল দেবনাগরীই হতে পারে সেই লিপি।’ গান্ধী বলেছেন, ‘হিন্দু-মুসলিম উন্মত্ততার জন্য সম্পূর্ণ সংস্কারের পক্ষে বাধা আছে। তবে এর পূর্বে হিন্দু ভারতকে বুঝতে হবে যে, যেসব ভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত তাদের লিপিগুলো, যেমন বাংলা, গুরুমুখী, সিন্ধি, ওড়িয়া, গুজরাটি, তেলেগু, তামিল, কন্নড়, মালয়ালম ইত্যাদি ভাষার লিপিকে বর্জন করে সে স্থলে থাকবে শুধুই দেবনাগরী লিপি। এর ফলে হিন্দু ভারত সংহত ও বলিষ্ঠ হবে।’ গান্ধী নিজেই স্বীকার করেছেন পাঞ্জাবে হিন্দু-মুসলমান এবং অন্য সবাই উর্দু জানে (উর্দুভাষার লিপি ফার্সি)। ধর্মের ভিত্তিতে ভাষার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন গান্ধী। পাঞ্জাবি হিন্দুরা দেবনাগরী লিপি গ্রহণ করবে এবং মুসলিমরা ফার্সি লিপি। একইভাবে বাঙালি হিন্দুর লিপি হবে দেবনাগরী এবং বাঙালি মুসলমানের লিপি হবে বাংলা অথবা ফার্সি। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরোধকে ভাষা ও লিপির ভেতরে টেনে আনেন স্বয়ং গান্ধী। ব্রিটিশদের বিভক্তিকরণের চক্রান্তের নীতি অনুসরণ কি ভাষার প্রশ্নে গান্ধী করেননি? হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভক্তি ব্রিটিশরা করেছিল তাদের শোষণ প্রক্রিয়া এবং দখলদারিত্ব স্থায়ী করার লক্ষ্যে। গান্ধীও হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপির পক্ষে সম্প্রদায়গত বিভাজনের নীতি অনুসরণ করে সেই বিভাজনকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়