৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে জাতীয় পার্টি : গাইবান্ধায় জি এম কাদের

আগের সংবাদ

শারদীয় দুর্গোৎসব : শুভ চেতনা সঞ্চারিত হোক সবার মনে

পরের সংবাদ

হামাসকে সন্ত্রাসী বলেও ভারতের অবস্থান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলার পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ উল্লেখ করে নিঃশর্তভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ৬ দিনের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা বিবৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে ভারত ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থনের প্রশ্নে একেবারেই উল্টো অবস্থান নিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত দেশ ফিলিস্তিনের দাবির প্রতি ভারত সমর্থন জানাচ্ছে। ভারতের এই নীতি দীর্ঘদিন ধরে আছে। ভারত এমন এক পরিস্থিতি চায়, ফিলিস্তিনিরা ‘যেখানে নির্দিষ্ট এবং সুরক্ষিত সীমান্তের ভেতরে’ ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারবে। একটি সার্বভৌম, স্বাধীন এবং কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভারত বরাবরই তাদের মত ব্যক্ত করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য দুটি দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। কিন্তু হঠাৎ কেন এই বৈপরীত্য?
হামাসের হঠাৎ হামলা পৃথিবীর যুদ্ধবিরোধী কোনো দেশ বা মানুষ পছন্দ করেনি। বিনা প্ররোচনায় গত ৭ অক্টোবরের রকেট হানায় (যা ইতোমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছে টেন-সেভেন নামে) হতাহত হাজারেরও বেশি ইহুদি সামরিক এবং অসামরিক নাগরিক। এই ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়েছে পৃথিবীর শান্তিপ্রিয়-যুদ্ধবিরোধী মানুষ। তার অভিঘাতে সম্ভবত ভারতের নরেন্দ্র মোদি টুইটারে তার মত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল গঠিত হওয়ার পর থেকে ভারত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে সরব হয়েছে বারবার। এমনকি ভারতের বর্তমান শাসক দলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি পর্যন্ত। তাই ১৯৫০ সালে ভারত ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তার আগে নয়। প্রথম দিকে ফিলিস্তিনকে ভেঙে ইসরায়েল নামে ইহুদিদের নতুন রাষ্ট্র গঠনে ভারতের সমর্থন ছিল না। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাই করেছিল সদ্য স্বাধীন ভারতের সরকার। ভারত কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ইসরায়েলের সঙ্গে রাখেনি ১৯৯২ সাল অবধি।
এই বিতর্কে তাদের অবস্থান বরাবর ছিল নিরপেক্ষ। পশ্চিম এশিয়ায় আরবীয় মালভূমির অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য ওই দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল ভারত। বিশেষত ইরান। ভারতে একটা বড় অংশের মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। পশ্চিম এশিয়ার একমাত্র ইহুদি দেশকে সমর্থন করে ভারতীয় মুসলিমদের এতদিন চটাতে চায়নি নয়াদিল্লি। কিন্তু এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) বার্তা দিয়েছেন- কঠিন সময়ে ভারত ইসরায়েলের পাশে আছে। মোদির এই অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রশ্ন উঠছে যে প্রধানমন্ত্রীর হঠাৎ এই মতপ্রকাশ কেন?
ভারত ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকলেও ১৯৮৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করা হামাস সংগঠনের (পুরো নাম, ‘হারকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া’ অর্থাৎ ‘ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন’) বিবৃতি তারা কখনই সমর্থন করেনি। ১৯৮৮ সালে হামাসের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক মঞ্চ ‘পলিটিক্যাল ব্যুরো’র বৈঠকে গৃহীত হয় ‘হামাস চার্টার’। সেখানে ‘অধিকৃত আরব ভূখণ্ড’ থেকে ইসরায়েলি দখলদারি পুরোপুরি উৎখাতের ডাক দেয়া হয়েছিল। বরং তাদের সমর্থন ছিল ইয়াসির আরাফাতের ফিলিস্তিন লিবারেশন অরগানাইজেশনের প্রতি। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্যে আমেরিকার মধ্যস্থতায় অসলো-১ চুক্তি সই করেন আরাফাত। শান্তিকামী ভারত এই শান্তির উদ্যোগ সমর্থন করে। কিন্তু এই শান্তিচুক্তি পছন্দ করেনি অধিকাংশ ফিলিস্তিনি জনতা। তারা পিএলওর ওপর আস্থা হারায়। দ্রুত জনপ্রিয়তা বাড়ে শান্তিপ্রক্রিয়ার বিরোধী কট্টরপন্থি হামাসের। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। ২০০৫-এ সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হয় এবং ২০০৬ সালে নির্বাচন হয়। কিন্তু শুধু গাজা ভূখণ্ড পেয়ে সন্তুষ্ট হয়নি ফিলিস্তিন বা গাজার জনতা। ২০০৬ সালে ১৩২ আসনের ‘ফিলিস্তিন লেজিসলেটিভ কাউন্সিল’-এর ভোটে ৭৪টিতে জিতে গরিষ্ঠতা পায় হামাস। ২০০৭ সালের মে মাসে মাত্র ৫ দিনের লড়াইয়ে ‘ ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ’র নিরাপত্তা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে গাজার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ পায় হামাস বাহিনী। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল জেরুজালেম। কারণ খ্রিস্ট, ইহুদি এবং ইসলাম- তিন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ওই শহর। তারা সমর্থন পায় লেবাননের রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও সিরিয়ার জঙ্গিদের। ফলে এতদিন টুকটাক ঝামেলা চলছিল। এবারে ২০ মিনিটের মধ্যে সফলভাবে ৫ হাজার রকেট ছুড়ে ইসরায়েলের একাধিক জনপদ বিধ্বস্ত করে দিয়েছে হামাস।
কিন্তু কেন এই আক্রমণ? ২০২১ সালের মে মাসে ১৫ দিনের যুদ্ধে প্রায় ৩০০ ফিলিস্তিনির মৃত্যুর পরই প্রত্যাঘাতের পরিকল্পনা করতে শুরু করেছিল। ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকে বোকা বানিয়ে এতদিনে আক্রমণ হলো। সবচেয়ে বড় কথা, ইসরায়েলি নিরীহ নিরপরাধ নাগরিক ও বেশকিছু বিদেশিকে পণবন্দি করে নিয়ে যাওয়া কেউই সমর্থন করেনি। এমনকি ভারতের বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন তীব্র নিন্দা করেছে এই উন্মাদনার, এই হত্যালীলার। ‘আল-আকসা লিবারেশন’ নামের হামাসের এই হামলা শুধু ‘আল-আকসা মসজিদ’ উদ্ধারের জন্য এবং তার জন্য নির্বিচারে মানুষ হত্যা বা শিশুদের গলা কেটে ফেলা সমর্থন করেনি ভারতের নাগরিকরা। ক্রমাগত হামাসের আক্রমণে বীভৎস ছবি দেখে ভারতের মুসলমানরাও এই আক্রমণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। যারা এতদিন জেরুজালেমের ওপরে ফিলিস্তিনীয়দের দাবির পক্ষে ছিলেন তারাও এখন তাদের বিরুদ্ধতা প্রকাশ করছেন। যার ফলে হয়তো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে টুইট করেছিলেন।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে আসছে। গত জি-২০ সম্মেলনে ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ একটি অর্থনৈতিক করিডোর হবে কথা হয়েছিল এবং সেই করিডোর ইসরায়েলের হাইফা বন্দর হয়ে যাওয়ার কথা। এটা চীনের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তির কারণ। আমেরিকা, ভারত, সৌদি আরব, ইসরায়েল এরা সবাই চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য খর্ব করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সৌদি আরব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দিলেও আমেরিকা চাইছিল সৌদির সঙ্গে ইসরায়েলের একটা শান্তিচুক্তি হোক। ২০২০ সালে ইসরায়েল সৌদি ও মরক্কো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ নামে একটি চুক্তি সই করে। এতে ইরান খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। কারণ সৌদি ও ইসরায়েল যদি এক কাতারে আসে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের দাপট কমতে বাধ্য এবং তাদের খনিজ তেলের দাম কমে যাবে। কারণ সৌদিও একইরকম তেলসমৃদ্ধ দেশ। এই আক্রমণের পর ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করছে যে কমিউনিস্ট দেশগুলো রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া হামাসকে সমর্থন করছে। চীন নিশ্চুপ থাকলেও তাদের নীরব সমর্থন হামাসের প্রতি। ইতোমধ্যে সৌদির সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি স্থগিত করে দিয়েছে। ফলে যে অর্থনৈতিক করিডোর হলে ভারত দ্রুত অর্থনীতিতে তৃতীয় দেশে পরিণত হত তা বিশ বাঁও জলে। এই সম্ভাবনা আন্দাজ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল ইসরায়েলের পক্ষে।
ভারতের শাসনব্যবস্থার ঐতিহ্য অনুযায়ী শাসক বদল হলেও বৈদেশিক নীতি বদল হয় না। তবে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ যেদিকেই গড়াক না কেন বিশ্ব যে এই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিধাবিভক্ত হতে চলেছে তা স্পষ্ট। তার পেছনে ধর্মীয় অনুভূতির চেয়েও বেশি কাজ করতে চলেছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। রাশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন, ইরান যে হামাসকে সমর্থন করে বসে আছে তার পেছনে যুক্তি খুব একটা না থাকলেও যূথবদ্ধতা পরিলক্ষিত। কিন্তু ইসলামি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো এখনো খুব একটা মন্তব্য করেনি। তারা চাইছে আগে যুদ্ধ বন্ধ হোক। কিন্তু উল্টোদিকে ইসরায়েল ও পশ্চিমী বিশ্ব চাইছে হামাসকে নির্মূল করতে। আমেরিকা অস্ত্রও পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আরব বিশ্বের সঙ্গে ভারত চিরকালই মধুর সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতি। সেজন্যই ভারত হামাসের আক্রমণকে ‘সন্ত্রাসী’ বললেও রাষ্ট্র হিসেবে সমর্থন জারি রাখল ফিলিস্তিনের পক্ষে।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়