বীমা ব্যক্তিত্ব সামাদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আগের সংবাদ

নানা আয়োজনে শেখ রাসেলের জন্মদিন পালন

পরের সংবাদ

শিশুমনে শেখ রাসেল

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের উত্তর-প্রজন্মের চেতনায় শেখ রাসেল কীভাবে বিমূর্ত, সেটি বুঝতে আমাকে বেশ সহায়তা করেছে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত দীপ্ত জয়োল্লাস শীর্ষক বইটি। বইটির সম্পাদনা সহকারী হিসেবে কাজ করার সময় শেখ রাসেলকে নিবেদিত প্রায় দুই শতাধিক ছড়া-কবিতা আমাদের হাতে আসে। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়–য়া শিশু-কিশোরদের লেখা এসব নতুন কবিতা ও ছড়া আমাদের নতুন নতুন ভাবনা ও দর্শনের সঙ্গে সংযুক্ত করে। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত কিছু পথশিশুর রাসেল-ভাবনা আমাদের বিস্মিত করেছে। আমাদের নবপ্রজন্মের কুসুমিত মনস্তত্ত্বে শেখ রাসেলের উদ্দীপক উপস্থিতি যে কতটা প্রগাঢ় ও সুগভীর, তা বোঝা যায় সেসব ছড়া-কবিতার প্রতিটি শব্দ ও পঙ্ক্তিতে। পাশাপাশি শিশু রাসেলকে যারা হত্যা করেছিল, তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধ এবং তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি তীব্র ভর্ৎসনাবাণ ছুটে এসেছে এসব কবিতার আগ্নেয়গিরি থেকে। বাঙালির চিরসম্ভাবনার তথা আমাদের জাতীয় জীবনে চিরশান্তি ও সৌম্যের প্রতীক শেখ রাসেল প্রেরণা ও দ্রোহের উৎসজন হিসেবেও প্রতিটি শিশুমনে কীভাবে সৃজিত সেসব উঠে এসেছে এসব ছড়া-কবিতায়।
শেখ রাসেলের জন্মক্ষণকে চিত্রায়িত করে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া জাহান হিয়া ‘আমার বন্ধু শেখ রাসেল’ কবিতায় লিখেছে- ‘৩২ নম্বর সড়ক, ৬৭৭ নম্বর বাড়ি/১৯৬৪, ১৮ অক্টোবর, খুশির ছড়াছড়ি।/বাংলার বুকে জন্ম নিলো/সিংহ শাবক ছানা/নামটি তোমার শেখ রাসেল/এ কথা সবার জানা।’ সর্বকালের সর্বতেজোদীপ্ত বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তানও যে একজন বীরসন্তান হবে সেটারই একটি আত্মবিশ্বাসী আরোপণ পাওয়া যায় সাদিয়ার ‘সিংহ শাবক’ শব্দযুগল থেকে। অর্থাৎ এ কথা প্রতীয়মান হয়, শেখ রাসেল এই খুদে কবির চৈতন্যে একজন বীরপুত্র হিসেবে অধিষ্ঠিত। অন্যদিকে রাসেলের শৈশবকে একটি সংগ্রাম-উপাখ্যান হিসেবে গ্রহণ করেছে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোছা. বুশরাত জাহান। তাইতো ‘রাসেল’ শীর্ষক কবিতায় তার তীব্র জিজ্ঞাসা- ‘এ কেমন সংগ্রাম বলো?/দেড় বছরেই গোয়েন্দা নজরে!/এ কেমন জীবন বলো?/সাড়ে সাত বছরেই ঘরবন্দি জীবন!/এ কেমন শৈশব বলো?/বাবা, ভাইয়ের চিন্তাভরা/এ কেমন বাড়ি-বন্দি বলো?/খাওয়া, খেলনা, বইপত্র ছাড়া।’ এ কাব্যাংশটুকু পাঠে বলা যায়, শিশু রাসেলের জীবনটাকে বুশরাত অনুভব করেছে একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। তার স্বাধীনচেতা শিশুমন রাসেলের এমন শৈশবদশা দেখে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত। তার কোমল হৃদয় আজ ব্যথিত সেই ছোট্ট রাসেলের জন্য। কারণ প্রতিটি শিশুই চায় একটি কণ্টকমুক্ত শৈশব, নিরাপদ পরিবেশ। তাইতো কারাবন্দি পিতার পিতৃস্নেহ থেকে বিযুক্ত শিশু রাসেলের শৈশবের অপূর্ণতাগুলো আজকে সব শিশুর শৈশব-সচেতনতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। শিশু রাসেলের যা যা প্রাপ্য ছিল সেসবের অধিকারবোধ নবপ্রজন্মের শিশুমনকে আন্দোলিত করেছে তুমুলভাবে।
শিশু রাসেলের ভুবনভোলানো হাসির এক প্রাণোদ্দীপক শক্তি ফুটে উঠেছে আদিবার কথায় ও কলমে। অষ্টম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী ‘তোমার মাঝেই বাংলাদেশ’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছে- ‘রাসেল তোমার শুভ্র হাসি/জাগায় নতুন প্রাণ/তোমার মাঝেই দীপ্ত সবুজ/বাংলাদেশের গান।… তোমার মাঝেই ছড়িয়ে আছে/নিসর্গ আবেশ/সবুজ শ্যামল সোনালি রুপালি/আমার বাংলাদেশ।’ অর্থাৎ রাসেলের মাঝেই সে বাংলাদেশের আবহমান নির্মল রূপকে বিমূর্ত হয়ে উঠতে দেখেছে। রাসেলের মাঝে খুঁজে পেয়েছে বহুবর্ণিল মাতৃভূমিকে। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আফনান সরকার শুদ্ধর ‘গল্পে গল্পে শেখ রাসেল’ শীর্ষক কবিতার দুটো লাইন এমন- ‘আকাশ-গাঙে যখন উড়ে যায় পাখি,/ইচ্ছে করে পাখিটাকে রাসেল নামে ডাকি।’ এ চরাচরে পাখি স্বাধীনতা ও শান্তিকে প্রতীকায়িত করে। অন্যদিকে মানুষ স্বভাবতই স্বাধীনচেতা হলেও সব মানুষ স্বাধীন নয়। তবে শিশু শেখ রাসেল যে আমাদের জাতীয় জীবনে চির-স্বাধীনতার আলোকবর্তিকাবাহক সে কথা খুদে শিক্ষার্থী আফনান বুঝেছে। তাইতো তার ভাবনায় রাসেল ধরা দিয়েছে একটি পাখি হিসেবে।
‘রাসেল আছে’ শীর্ষক ছড়ায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী দ্বিতীয়া বাগচীর দৃঢ় উপস্থাপন- ‘রাসেল আছে বাংলাজুড়ে/রাখালিয়া বাঁশির সুরে।/শিশু মানেই রাসেল সোনা/দেশগঠনের স্বপ্নবোনা। রাসেলের এমন সর্বব্যাপ্ত উপস্থিতি অনুভব করা এবং রাসেল মানেই যে একজন দেশপ্রেমিক সত্তা সে বিশ্বাসগুলোর মধ্য দিয়েই এ দেশে শেখ রাসেলের পুনর্জন্ম হয় প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। সে মিশে আছে মিশে থাকে আমাদের নবপ্রজন্মের স্বদেশিমানসে। আরেকটি ছড়ায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রতিভা বৈরাগী সিঁথী শেখ রাসেলের মানবিক বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলেছে শব্দের রংতুলিতে। ‘মানবিক রাসেল’ শীর্ষক ছড়ায় সিঁথীর তেমনটিই উচ্চারণ- মনটা ছিল আকাশ সমান/জানতো সকল জন,/খুব সহজেই কেড়ে নিতো/গরিব-দুঃখীর মন।… কাজের লোকের সাথে রাসেল/খাবার খেতো রোজ,/ছোট্ট হয়ে নিয়মমতো/রাখতো তাদের খোঁজ। শেখ রাসেলের এই অনন্য বৈশিষ্ট্য আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে মনুষ্যত্ববোধের মৌলিক শিক্ষা দেয়, যে শিক্ষা একটি মানবিক সমাজ গঠনের প্রধানতম সহায় হিসেবে বিবেচিত।
শেখ রাসেল চির-উচ্ছলতা, চির-উদ্দামতার প্রতীক। তার এমন হত্যাকাণ্ডকে কোনো মানুষ মেনে নিতে পারেনি এবং পারে না। আমাদের এই উত্তর-প্রজন্মের চোখে সে দেবশিশু, সে নিষ্পাপ যিশু। তাইতো রাসেলের অকালপ্রয়াণে তাদের হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছে রক্তক্ষরণের অনন্ত স্রোতধারা। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অনন্যা চৌধুরী ‘শেখ রাসেল’ কবিতায় পনেরোই আগস্টের সেই মর্মন্তুদ ঘটনাকে বর্ণনা করেছে এভাবে- ‘পৃথিবীর মতো বিমল কোমল/জলের মতোই সত্য সে/এমন শিশুর প্রাণ নিয়ে গিয়ে/হেসেছিল কিছু দৈত্য যে!’ আর রাসেলকে হারানোর সেই ভয়াবহ মুহূর্তকে কল্পনা করে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরুণিমা দাস তার ‘লাল গোলাপ’ কবিতায় লিখেছে- ‘রাসেল তোমার বক্ষে যখন/বুলেট প্রবেশ করে/আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে আর/চোখ ভেসে যায় জলে।’ শিশু রাসেলের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দ্রোহের বর্ণমালায় একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী অন্তর চন্দ্র তার ‘শেখ রাসেল’ কবিতায় লিখেছে- ‘সেই বিভীষিকার দারুণ রোষে চন্দ্রকলার ক্ষয়/বাঙালির শিশুবুকে আগুনের জন্ম হয়।/শিশুহত্যার তীব্র রোষে মায়ের হাতে খড়্গ ওঠে/সকল শিশুর অন্তরে শেখ রাসেল জেগে থাকে!’
নতুন প্রজন্মের শিশুদের বহুমাত্রিক রাসেল-ভাবনা জেনে আজ মনে হচ্ছে ঘৃণ্য খুনিরা সেদিন শেখ রাসেলকে হত্যা করতে পারেনি। পৃথিবীর সুন্দরতম এই শিশুটিকে হত্যা করার মতো বুলেট, বোমা, কামান কিংবা অন্য কোনো মারণাস্ত্র তৈরি হয়নি আজো। শেখ রাসেল অনন্তজীবী। সে আমাদের নবপ্রজন্মের মাঝে জাতিস্মর হয়ে বেঁচে আছে, থাকবে। তাইতো একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্ণব দাস তার ‘মেঘের ওপারে’ কবিতায় রাসেলের চিরবর্তমানতাকে চিত্রায়িত করেছে এভাবে- ‘তুমি আজ আছো বাংলার আকাশে-বাতাসে/শিশুর হাসিতে/মানুষের হৃদয়ে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।/তুমি থাকবে-/যতদিন শারদ শশী, গ্রীষ্ম রবি আলো দেবে/এই বাংলায়।’ পাশাপাশি শেখ রাসেলকে আত্মশক্তির উৎস হিসেবে ধারণ করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নীলাদ্রি বিশ্বাস ‘রাসেল নামের সেই ছেলেটি’ কবিতায় লিখেছে- ‘তোমার রুধির শোণিত ধারায় বাংলা মায়ের কোল/প্রতিটি শিশু গর্জে উঠে ছড়াবে তার বোল/জয় বাংলার বজ্রকণ্ঠে জাগবে সবুজ প্রাণ/এই মাটির গন্ধ শুধায় তুমি চির মহীয়ান।’ এছাড়া অষ্টম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী নাজিফা হাসান তার ‘ধ্রæবতারা’ কবিতায় শেখ রাসেলের চির-অস্তিত্বকে যে পঙ্ক্তিমালায় গেঁথেছে তা হলো- ‘উজ্জ্বল তুমি চিরঞ্জীব তুমি থেকো ধ্রæবতারা/তোমার নামে স্বপ্ন ফোটে, চন্দ্র আত্মহারা।/ছিলে তুমি, আছো তুমি, রবে মনের আঙিনায়/অমর হয়ে থেকো বেঁচে লাল-সবুজের বাংলায়।’ এই যে পূর্বপ্রজন্ম অর্থাৎ শেখ রাসেলের সঙ্গে উত্তর-প্রজন্মের প্রতিনিধি নাজিফা হাসানের অনুভবজাত বিনিসুতার বন্ধন এটি অকৃত্রিম, এটি বর্ণনাতীত। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট যে শেখ রাসেলকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, তার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে আদর্শিক শেখ রাসেলের এই পরাক্রমশালী প্রত্যাবর্তন।
আমরা দেখেছি, আমাদের নবপ্রজন্ম শেখ রাসেলকে ‘বঙ্গপুত্র’, ‘শান্তিপুত্র’, ‘সদ্য ফোটা ফুল’ এমন নানা অবিধায় রূপায়ণ করেছে। তবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইসাবা ইলমি প্রিয়তি তার ‘দ্বিতীয় মুজিব’ ছড়ায় শেখ রাসেলকে যেভাবে অনুভব করেছে সেটি একটি সুগভীর দর্শন। আবেগ, চেতনা, অনুভব আর বিশ্বাসের সমন্বয় ঘটিয়ে এই খুদে ছড়াকার লিখেছে- মারলো তাকে পশুর দল/শেখ মুজিবের মতো/এই ছেলেটি থাকলে বেঁচে/দ্বিতীয় মুজিব হতো। অসামান্য অভিব্যক্তি! অনবদ্য রাসেল-দর্শন! এভাবেই শেখ রাসেল অনতিক্রম্য আদর্শ-শিশু হিসেবে আমাদের প্রজন্মের হৃদয়ে ও চৈতন্যে বেঁচে আছে পরম মমতা ও যতনে। যারা ছোট্ট রাসেলের মধ্যেই এক পরিপূর্ণ শেখ রাসেলকে দেখতে পায় এবং তার হাত ধরেই বাংলাদেশ কোথায় পৌঁছাতে পারত সেটি উপলব্ধি করতে পারে, তারাই তো আগামী দিনের প্রমিত প্রজন্ম। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমাদের আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের অনুভূতিতে রাসেলের যে সরব উপস্থিতি এসব ছড়া-কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে আমরা একটি স্বপ্নের সোনার প্রজন্ম পেতে চলেছি। যাদের হাতে রচিত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। যাদের কর্ম ও প্রচেষ্টায় পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ চলবে সসৌরভে, সগৌরবে।

শেখ ফয়সল আমীন : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়