বীমা ব্যক্তিত্ব সামাদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আগের সংবাদ

নানা আয়োজনে শেখ রাসেলের জন্মদিন পালন

পরের সংবাদ

অপেক্ষার দুর্গা, উৎসবের দুর্গা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে দুর্গাপূজার এ বিশেষ সময়ে প্রতি বছরই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। মন্দিরে হামলা হয়, প্রতিমা ভাঙচুর হয়, হিন্দুদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়। এবার পরিস্থিতি আরো একটু জটিল। কেননা দুর্গাপূজার পর আগামী জানুয়ারির (২০২৪) প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মনে করে- হিন্দুদের ভোট তাদের বাক্সে পড়ে না। এবার তাই তাদের কাছ থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি হবে। কারণ এরপরই নির্বাচন। হিন্দুদের পূজার সময় ভয় দেখাতে পারলে তারা নির্বাচনে ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে নাও আসতে পারে- এমন চিন্তা থাকবে তাদের মাথায়। রাজনৈতিক সমীকরণে বাংলাদেশের বিশেষ কয়েকটি স্থানে হিন্দু ভোটারের গুরুত্ব অনেকটাই প্রণিধানযোগ্য। কারণ চট্টগ্রাম বিভাগে ১৬ দশমিক ৬৫, সিলেট বিভাগে ১৩ দশমিক ৫, রংপুর বিভাগে ১২ দশমিক ৯৮ এবং খুলনা বিভাগে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বসবাস। ঢাকা বিভাগ ও রাজশাহী বিভাগে তাদের বসবাস কম। ঢাকা বিভাগে ৪ দশমিক ৭৯ এবং রাজশাহী বিভাগে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
দুর্গাপূজার কথা মনে হলেই বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সূচনার কথা মনে পড়ে। রাজা কংসনারায়ণের হাত ধরে ৫৪০ বছর আগে বাংলায় দুর্গাপূজার শুরু হয়েছিল। অবিভক্ত বরেন্দ্র উত্তরাঞ্চলের শহর রাজশাহীর তাহেরপুরের সামন্তরাজা ছিলেন কংসনারায়ণ। মোগল শাসক থেকে তিনি রাজা উপাধি প্রাপ্তি উপলক্ষে বিরাট দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন। আজ থেকে ৫৪০ বছর আগে এখান থেকে সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু বলে ধারণা করা হয়। সেই সময়ে রাজা হংসনারায়ণ রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা খরচ করে রাজবাড়ীতে পূজার আয়োজন করেছিলেন। কংসনারায়ণ এমন কিছু করতে চাইলেন, যার জন্য হিন্দুসমাজ তাকে আজীবন মনে রাখবে। রাজা পণ্ডিতদের ডাকলেন রাজসভায়। জানালেন, তিনি আয়োজন করতে চান অশ্বমেধ যজ্ঞ। পণ্ডিতরা রাজার এ ইচ্ছা নাকচ করে দিলেন। তারা বললেন, কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞের বিধান শাস্ত্রে নেই। পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী রাজাকে বিকল্প হিসেবে দেবী দুর্গতিনাশিনীর পূজা করার পরামর্শ দিলেন। এরপর মহাসমারোহে হলো দুর্গোৎসব। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী এখনো রাজশাহীর তাহেরপুরের দুর্গাপূজা হয়। এখানে মাটির প্রতিমায় দুর্গাপূজা হয় না; প্রতিমা বিসর্জনও হয় না। অষ্টধাতু দিয়ে প্রতিমা তৈরি হয় এখানে। ২০১৮ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য এনামুল হকের উদ্যোগে ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থায়ীভাবে অষ্টধাতুর প্রতিমা বানিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজবংশের পরবর্তী বংশধর ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর দেবীবিগ্রহসহ ভারতের জলপাইগুড়ি চলে যান।
বাঙালি অপেক্ষায় বেঁচে থাকে। তার জাতিগত অস্তিত্বের একটা মূল সুর হলো অপেক্ষা। তা সে স্বাধীনতার জন্যই হোক- কী অধিকারের জন্য, প্রেম-ভালোবাসার জন্য বা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। অপেক্ষার মধ্যে সে যেন দেখতে পায় তার তপস্যার ছায়া। তেড়েফুঁড়ে সে কিছু করতে পারে না; পিঠ ঠেকে না যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। এমন হাল ছেড়ে দেয়া নিয়তিবাদ থেকে আশাবাদের জীবনদর্শনকেই সামনে নিয়ে আসে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। তাদের সে অপেক্ষা দুর্গাপূজার জন্য। বছরের চারটি দিনের জন্য আকুলভাবে চেয়ে থাকা। অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপূজার ১০৮টি প্রদীপে কারো আগ্রহ থাকুক বা না-থাকুক- আলো-মেলা-মাইক, নতুন জামা, খাওয়া-দাওয়া, প্রতিমা দেখার ভিড়-হুল্লোড়- এসবের জন্য বাঙালি হিন্দুদের অপেক্ষাটা চোখে পড়ার মতো। এ যেন এক অন্য স্তরের অপেক্ষা। এ মূলত দশভুজাকে স্রেফ পূজা করব, তার অপেক্ষা নয়- পূজাকে বাঙালি হিন্দুরা মিলিয়েছে সামাজিকতার সঙ্গে। তাই তাদের এমন অনুষ্ঠানে অন্তত পশ্চিমবঙ্গের তথা কলকাতার মুসলমান, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদেরও পাশাপাশি অবস্থান। চার দিন ধরেই কারো ঘরে উনুন জ্বলে না। রাস্তার ধারের প্রতিমা দেখে ফেরার পথে রাস্তার দোকানেই খেয়ে নেয় তারা সকাল-দুপুর ও রাতের খাওয়া। সম্পূর্ণ অচেনা একদল একা মানুষ দলবেঁধে পূজায় বেরিয়ে পড়ে ঠাকুর দেখার নামে সাময়িক ও কৃত্রিম এক যৌথতার নির্মাণে।
শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই শেষে মা এ চার দিন মর্ত্যরে মণ্ডপে মণ্ডপে। তার আগমনে আনন্দ যেন আর ধরে না। কিন্তু তার আগমনের পূর্বেই এবার ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে গাজার বধ্যভূমিতে। নীতি বনাম দুর্নীতি, সন্ত্রাস বনাম আইনের শাসন, বঞ্চনা বনাম ন্যায়ের উচ্চকিত আস্ফালনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারসাম্য রক্ষার লড়াই যেন চলছেই। একটা যুদ্ধ চলছে প্রায় দুই বছর ধরে। অন্যটির বয়স মাত্র কয়েকদিন। সম্ভবত টুইন টাওয়ারে লাদেনের অতর্কিত হামলার পর এত বড় উগ্রপন্থি হানা বিশ্বমঞ্চ আর দেখেনি। এটা সত্যি জঙ্গি হামলা, না মুক্তি সংগ্রাম- তা নিয়ে বিভক্ত সারা পৃথিবী। ইউক্রেন ও গাজা- দুই ধ্বংস-বিধ্বস্ত যুদ্ধক্ষেত্রের দূরত্ব ২ হাজার কিলোমিটার। দুক্ষেত্রেই হানাহানির অভিঘাত ভয়ংকর।
খাদ্য নেই, আলো নেই, পানীয়জল নেই, মানবাধিকারের বালাই নেই দশকের পর দশক। মুহুর্মুহু ধেয়ে আসছে রকেট আর বিধ্বংসী বোমা। পেটে খাবার নেই, মাথায় বোমা। হামাসের আক্রমণের বদলা নিয়েই ছাড়বে সত্তরোর্ধ্ব নেতানিয়াহুর জেদি, একরোখা ইসরায়েল। ভারসাম্য রক্ষার তাগিদ নেই কোনো পক্ষেরই। ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাতের ইতিহাস মোটেই আজকের নয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের গোড়ার দিন থেকেই এ লড়াই চলছে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সাড়ে তিন দশক পেরিয়ে আজো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বৈরিতা যে কত তীব্র, তা টের পাওয়া গেছে গত কয়েক সপ্তাহে। প্রাণ হারিয়েছে নিরীহ মানুষ, যার সিংহভাগই শিশু ও মহিলা। নারকীয় অত্যাচারের পরপর ভিডিওই বলে দেয় সভ্যতার সব সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে।
মা, তুমি দেখা দাও। অপেক্ষায় আছি গত একটি বছর ধরে। মহৈশ্বর্যময়ী ঈশ্বরী সামনে এসে না দাঁড়ালেও অপেক্ষার দেবী কি অলক্ষ্যে থেকেও রক্ষা করতে পারছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন আর গাজার এ অসহায় মানুষগুলোকে? কোন রচয়িতা কবে এমন গান লিখবে- যেখানে শক্তিময়ী দশভুজা সামনে এসে দাঁড়ান ঘরের অতি সাধারণ মেয়েটি হয়ে? দশপ্রহরধারিণী, দশহাতি দুর্গা নন- বিয়ে হয়ে স্বামীগৃহে সংসার করতে যাওয়া গৌরী কিংবা সালেহা। মহিষমর্দিনী নন, বাপের বাড়ি আসতে না পেরে গুমরে-মরা উমা। ‘পুজো আসছে, পুজো আসছে’- এ অপেক্ষার গানের সঙ্গে সেই গানও একদিন হবে সমাজের মূল গান, অপেক্ষার গান। ঘরের মেয়েটিকে বিয়ে দিতেই হবে; এমনকি নেশাখোর, বাউন্ডুলে অপাত্র-কুপাত্র হলেও সমাজের ভয়ে না দিয়ে গতি নেই; আর একবার স্বামীগৃহে চলে গেলে কবে সে বাড়ি আসবে, তারও নিশ্চয়তা নেই- এই পুরুষতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও তথাকথিত আর্থসামাজিক শেকলের বন্ধন থেকে মুক্তি দেয়ার অপেক্ষার গান।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়