হেরোইন উদ্ধার মামলা : পাকিস্তানি নাগরিকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

আগের সংবাদ

রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষণ নেই, নির্বাচনের প্রস্তুতি ইসির : ডিসি এসপিদের নিয়ে ইসির বৈঠক > ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় মাঠ প্রশাসন

পরের সংবাদ

ফজলে হাসান আবেদের পর্যবেক্ষণ নুরুল ইসলামের জবাব

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২০১৪-তে স্বল্পকালীন সফরে অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ঢাকা এসেছিলেন। তখনকার একটি ঘটনা ইংরেজিতে লিখিত আত্মজীবনী অ্যান অডেসি : জার্নি অব মাই লাইফ-এ তিনিই উল্লেখ করেছেন : ‘সম্প্রতি ২০১৪-র নভেম্বরে ঢাকায় একটি ডিনারে ফজলে হাসান আবেদ আমাকে বলেছেন, ১৯৭২ সালের জাতীয়করণ নীতিমালা যদি করা না হতো বাংলাদেশ এতদিনে হরেক রকম বৃহদায়তন উৎপাদন কারখানা ও শিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হতে পারত। তার এই অভিমত শুনে আমি বিস্মিত হই। তখন মনে করা হয়েছে আমার নেতৃত্বে পরিকল্পনা কমিশন জাতীয়করণ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে এবং বঙ্গবন্ধু আমাদের সুপারিশমালা গ্রন্থ ও অনুমোদন করেছেন। আমি বিস্মিত হই তিনি (ফজলে হাসান আবেদ) কেন এটা জানতেন না কিংবা তিনি কেন ১৯৫৪ সালের ২১ দফা থেকে শুরু করে ষাটের দশকের শেষার্ধের ১১ দফা এবং শাসক দলের ১৯৭০ সালের নির্বাচন মেনিফেস্টোর প্রতি মনোযোগী হননি। আমার গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ : মেকিং অব অ্যা নেশন’ গ্রন্থে আমি এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছি।
জনাকীর্ণ একটি ডিনার পার্টি এ বিষয়ে আলোচনার জন্য উপযুক্ত স্থান নয়। প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের কাল স্বল্পসময়ের ১৯৭০ দশকের প্রথম দিকে। ক্রমান্বয়ে এ সীমাবদ্ধতা অপসারণ করা হয় (যা অবশ্যই নুরুল ইসলামের সুপারিশে অপসৃত হয়নি) এবং ১৯৮০’র দশক নাগাদ তা সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ পরিচালনার জন্য ময়দান মুক্ত করে দেয়া হয়। এসব ঘটেছে ৪০ বছর আগে। এটা বহুল জ্ঞাত যে বহু ধরনের বিষয় যেমন জ¦ালানি অবকাঠামো সুশাসনের ঘাটতি ইত্যাদি দেশে শিল্পায়নের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ বিষয়গুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ফোরামে প্রায়ই বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
ফজলে হাসান আবেদের এই বিবৃতির পেছনে কী রয়েছে? বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন আয়োজনে তার সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে কিন্তু তিনি এ বিষয়টি কখনো উল্লেখ করেননি। তিনি সামাজিক এবং পেশাগতভাবে রেহমান সোবহানের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। রেহমান সোবহান পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। জাতীয়করণকৃত শিল্পের দায়িত্বে ছিলেন তিনি এবং এই সেক্টরে সরকারি নীতি বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। রেহমান পরে আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে ফজলে হাসান আবেদ কখনোই কোনো উপলক্ষে বিষয়টি তার কাছে উত্থাপন করেননি।
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ধারণাগত প্রকৃত ও কল্পিত ব্যর্থতা সম্পর্কে আমার সহযোদ্ধাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছি কি না মনে নেই। অথবা এমনও তো হতে পারে এই মন্তব্যটি সিরিয়াস কিছু নয়, এমনকি বলার জন্য বলা- ডিনার পার্টিতে একটা কিছু বলে আলাপ শুরু করার অজুহাত। আমি বিশ্বাস করতে চাই, এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই ঘটেছে। (এটাই অপেশাদারিত্বের মনোভাব, একটি বাস্তব মন্তব্যকে অধ্যাপক ইসলাম আলাপ শুরু করার অজুহাত বিবেচনা করে সঠিক জবাব এড়াতে চাইছেন)।

এবার মওদুদ আহমদ
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালেই অধ্যাপক নুরুল ইসলাম টেলিভিশনে দেখলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। দু-একদিনের মধ্যে ওয়াশিংটন থেকে ভারতে এলেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি এন ধর তাকে বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যেন সাক্ষাৎ করেন, তাকে প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজন হবে (এই কথাটা পি এন ধরকে বলতে হলো, তিনি নিজে বোঝেননি)। তিনি কলকাতায় এসে বাংলাদেশ দূতাবাসে তিনজনকে পেলেন- একজন তার বয়োজ্যেষ্ঠ কিন্তু দীর্ঘদিনের বন্ধু পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের সদস্য মাহবুব আলম চাষী, বাকি দুজনের একজন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, একাত্তরের এপ্রিলে তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে আর অন্যজন মওদুদ আহমদ, তার সঙ্গে এটাই প্রথম দেখা। নুরুল ইসলাম তার অডেসিতে লিখেছেন : ১৯৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন সরকারে মওদুদ আহমদ বহুরকম ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একজন ব্যারিস্টার, ১৯৭২-৭৫-এ তিনি শাসক দল ও সরকারের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তবে তার কোনো দাপ্তরিক পদ ছিল না। আমি যখন সরকারে ছিলাম তখন তার সঙ্গে আমার সামাজিক যোগাযোগ ছিল। তিনি দুটো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতা ছিলেন : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জাতীয় পার্টি। তিনি উভয় দলেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যখন প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন সে সময় তার সঙ্গে আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতের কথা মনে পড়ছে। তিনি তখন ওয়াশিংটন সফর করছিলেন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য। তিনি ব্যক্তি খাতের আমেরিকান উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেখানকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় একটি ডিনার পার্টিতে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউএস এজেন্সি চিফের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় আমার সম্পর্কে বললেন : ‘ইনিই সেই ব্যক্তি বাংলাদেশে নিম্নমাত্রায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের জন্য যিনি দায়ী।’ কারণ ১৯৭২ সালে ব্যক্তি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম, আর এই নীতিই দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করেছে।
আমি তখন এই বলে সাড়া দিলাম, যেহেতু মওদুদ আহমদ অনেকবার তার দলীয় আনুগত্য বদলেছেন, আমি কখনো জানতে পারিনি যে ১৯৭২ সালের জাতীয়করণ নীতিমালা তিনি অনুমোদন করতেন না। এটাই মনে হয়েছে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আদর্শগতভাবে তিনি তাদের সঙ্গী হয়ে উঠেছেন।
মওদুদ আহমদের উসকে দেয়া মন্তব্য অধ্যাপক ইসলামকে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট করেছে। ফজলে হাসান আবেদ বা মওদুদ আহমদের মন্তব্য ঘটনা-উত্তর কালের। কিন্তু ঘটনাকালীন ১৯৭২-৭৪ কেমন কেটেছে তার?
তারই রচনা থেকে আংশিক অনূদিত : ১৯৭৪-এর শেষের দিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন ক্রমোবনতি ঘটছে এমন এক সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত আদ্রেই ফোমিন একবার আমার অফিসে এসে একটি কৌতূলোদ্দীপক আলোচনার সূত্রপাত করলেন এবং যে পরামর্শ দিলেন তাও বেশ কৌতূহল জাগানো। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে সময়ের যে চ্যালেঞ্জ তা মোকাবিলা করতে শাসন পদ্ধতির উন্নয়ন কেমন করে হবে তা আলোচনা করছিলেন। তিনি মনে করেন সময়ের দাবি একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব। শেখ মুজিব খুব বেশি রকমের উদার এবং দুর্বল, তিনি প্রায়ই সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমান হয়ে পড়েন। কাজেই এই জটিল সন্ধিক্ষণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপর, দৃঢ়প্রত্যয়ী এবং উচ্চমাত্রার নেতৃত্বগুণসম্পন্ন একজনকে বসাতে হবে।
তার মতে প্রয়োজনীয় গুণাবলিসহ এ কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন শেখ মণি (শেখ ফজলুল হক মণি শেখ মুজিবের ভাগ্নে)। অতএব শেখ মুজিবের উচিত তাকে মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত করা এবং দৈনন্দিন রাষ্ট্রীয় প্রশাসন চালানোর জন্য তাকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য পরবর্তী ব্যক্তি হিসেবে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করা। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রশাসনের গুণগত মান বেড়ে যাবে। তিনি অনুভব করেন যেহেতু আমি পরিকল্পনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত, দেশের সুশাসনের স্বার্থে তার প্রস্তাবকে আমার স্বাগত জানানো উচিত। রাষ্ট্রদূত ধরে নিয়েছেন যেহেতু আমি অরাজনৈতিক ব্যক্তি শেখ মণির এই উত্থানে ঈর্ষাকাতর হবো না, এত জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দকে ডিঙ্গিয়ে তার এই ক্ষমতা প্রয়োগ আমার উদ্বেগের কারণ হবে না। সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত খুব রাখঢাক করে আমাকে আস্থায় নিয়ে সঙ্গোপনে এই পরামর্শ দিয়েছেন এমন নয়। বরং শেখ মণির ক্রমোবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাবের গুজব ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল। রাষ্ট্রদূতের পরামর্শে মনে হলো সেসব গুজবের যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে।
সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত যখন আমার কাছে শেখ মণির বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করছিলেন ১৯৭৪-এর মাঝামাঝি একটি সময়ের কথা আমার মনে হলো। শেখ মণি সম্পাদিত বাংলার বাণী পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠি (অধ্যাপক ইসলাম এখানে ইনট্রিগড শব্দটি ব্যবহার করলেও তার লেখায় প্রতীয়মান হয়েছে বাস্তবে তিনি হয়ে উঠেন ডিস্টার্বড বা বিচলিত)। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমোবনতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি অর্থ খাতের অপব্যবস্থাপনাকে দায়ী করলেন এবং কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন- বাজে পরিকল্পনা। শেখ মণির মতে পরিকল্পনার দায়িত্ব ভুল হাতে ন্যস্ত- ভুল হাত মানে পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড পাস করা ছাত্রদের হাতে। এই পরিকল্পনাকারীরা যে শিক্ষা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তা দেশীয় পরিস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এবং তা কোনো কাজে আসার নয়। বহুমুখী সমস্যার বাংলাদেশ অর্থনীতির মোকাবিলা করার মতো জ্ঞান ও বোঝাপড়া তাদের হয়নি। তিনি ঠাট্টার স্বরে বলেছেন বাংলাদেশের জন্য দরকার দেশি হাকিমি কিংবা আয়ুর্বেদিক ডাক্তার- যারা দেশীয় রোগবালাই সারাতে জানেন। পরিকল্পনা কমিশনে যারা বসে আছেন তাদের মতো পশ্চিমে শিক্ষিত ডক্টর (পিএচডি) আমাদের প্রয়োজন নেই, তারা কেবল পশ্চিমা অসুখ নিরাময়ের জন্য প্রশিক্ষিত।
বিশ্বাস করা হতো মণি শেখ মুজিবের খুব ঘনিষ্ঠজন এবং মুজিবের ওপর তার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আমার সঙ্গে তার সরাসরি পরিচয় না থাকলেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আমি শুনেছি। তিনি লিখেছেন, এটাও বিশ্বাস করা হতো ভারতে প্রবাসী সরকার চালনার সময় তাজউদ্দীনের সঙ্গে মণির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এবং শেখ মুজিব ও তার মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টিতে তার ভূমিকা রয়েছে মনে করা হয়েছে। রাজনৈতিক সার্কেলে এই বাজার গুজব বেশ বহাল ছিল। অবশ্য তাজউদ্দীনের কাছ থেকে এমন কোনো কিছু শুনিনি বা শোনার সম্ভাবনাও ছিল না। পরিকল্পনা কমিশনে আমরা রাজনৈতিক ডান ও বাম উভয় দিক থেকেই আমাদের নীতিমালা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রায়ই সমালোচনার শিকার হতাম।
আমরা গণবিতর্ক এড়িয়ে চলেছি এবং এসবের জবাবও দিইনি। এ ঘটনায় বাংলার বাণীর সম্পাদকীয়তে কোনো নীতির সমালোচনা না করে বরং পরিকল্পনা কমিশনের পেশাদার নেতৃত্বে সক্ষমতা ও উপযুক্ততার প্রশ্ন তুলে বড় ধরনের আঘাত করা হয়েছে। শেখ মুজিবই তো ব্যক্তিগতভাবে কমিশন নেতৃত্ব বেছে নিয়েছেন। তিনি নিজে এর প্রধান বা চেয়ারম্যান। যদিও আমার ধারণা ভুল প্রতিপন্ন হয়েছে, আমি ধরে নিয়েছিলাম তার ভাগ্নের এ ধরনের তিক্ত আক্রমণ শেখ মুজিবের বড় কোনো অসন্তোষের কারণ হবে না কিংবা এর জোরালো অননুমোদন তিনি করবেন না।
১৯৭৪ সালে আমাদের অসন্তোষের গ্রীষ্মে আমি নাখোশ হয়ে সম্পাদকীয় একটি কপি শেখ মুজিবের কাছে নিয়ে যাই। মণির এই কর্মে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তিনি তা আগে দেখেননি এবং এখন দেখে খুব বিরক্ত হয়েছেন। মণি সম্পাদকীয়তে কী লিখেছে সে দিকে মনোযোগ না দেয়ার পরামর্শ তিনি দেন।
শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন কিন্তু সম্পাদকীয়তে তিনি কী লিখেছেন তা খণ্ডাতে চেষ্টা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ নিয়ে হাজির হওয়া যে পরিকল্পনা কমিশনে মন্ত্রীর মর্যাদার ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলামের জন্য মানানসই হয়নি, সম্ভবত ৩০ বছর গ্রন্থ প্রকাশ করার সময়ও তিনি তা অনুধাবন করতে পারেননি।
ম্যাকিং অব দ্য নেশন বাংলাদেশ বইটিতে তার নেতৃত্বে পরিকল্পনা কমিশন কোন উত্তম কর্মটি করেছে যার জন্য প্রথম পরিকল্পনা কমিশন সদা নমস্য হয়ে থাকবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো বিবরণ নেই। পরিকল্পনা কমিশন অধ্যায়ে যাই লেখা হয়েছে তার প্রায় সবই প্রতিক্রিয়া- কমিশনের ক্রিয়া কোনটি তা অস্পষ্ট।
অধ্যাপক ইসলাম নিজের বেশভুষণ ও আচরণে যে বর্ণনা তার ‘অডেসি’তে দিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করলে মনে করার যৌক্তিকতা মিলবে যে শেখ মণি খুব ভুল কিছু বলেননি। ‘সে সময় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে আমি স্যুট ও টাই পরে আসতাম, এটা খুব স্বাভাবিক দৃশ্য নয়, কারণ সে সময় অধিকাংশ শিক্ষকই পাঞ্জাবি এবং পাজামা কিংবা শার্ট ও ট্রাউজার পরে আসতেন। তার আংশিক কারণ আমার ৪ বছরের প্রবাস জীবনে অনেক স্যুট জমে গিয়েছিল। অধিকন্তু আমি আরো অস্বাভাবিক একটা কাজ করতাম। সেইসব দিকে আমি বো-টাই পরতাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেলায় কদাচিৎ দেখা যেত। আমি মনে করতাম বো-টাই পরলে আমাকে খুব ফ্যাশনদুরন্ত দেখাত। অ্যান অডেসি : জার্নি অব মাই লাইফ-এ নুরুল ইসলাম অকপটে তার পোশাকপ্রীতি এবং ফ্যাশন সচেতনতার কথা লিখেছেন। তারও পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে প্রথম গাড়ি কেনার কথাও বলেছেন। ১৯৭০ পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারের পুরোটাই ধনবাদী অর্জনের সফলতার গল্প। অবশ্যই তিনি মেধাবী ছিলেন, অবশ্যই তিনি উত্তম মানের শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন এবং জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিশ্রæতি জীবনে সমাজতন্ত্র প্রচার প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত ছিলেন তিনি দাবিও করেননি এবং তা মনে করারও কারণ নেই। অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের নির্দেশনা দেয়ার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছিলেন। তবুও বৈষম্যের অর্থনীতি ধরিয়ে দেয়া পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম জ্যেষ্ঠ হিসেবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্ব তাকেই দিতে হয়েছে, যার অন্যতম কাজ ছিল সংবিধানে প্রতিশ্রæত চার স্তম্ভের অন্যতম সমাজতন্ত্রের জন্য অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনা প্রণয়ন কাঠামো বিনির্মাণ করা।
কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি যে তখন বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে বিদায় নিতে শুরু করেছে অধ্যাপক ইসলাম ও তার টিম সম্ভবত তা টের পায়নি। সমাজতান্ত্রিক দেশের লেখক মিলান কুন্ডেরার উপন্যাস ‘দ্যা জোক’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৭) সম্ভবত অর্থনীতিবিদরা ১৯৭২-এও পড়েননি।
লক্ষ্য সমাজতন্ত্রই হোক কি পুঁজিতন্ত্র, মর্যাদা নিয়ে অতি সচেতন এবং এক পা আমেরিকায় রাখা ডেপুটি চেয়ারম্যান ও তার কমিশন যে দেশটাকে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি, ফজলে হাসান আবেদ, মওদুদ আহমদ কিংবা শেখ ফজলুল হক মণির মন্তব্য যত তিতকুটেই হোক, সত্যটা সেখানেই নিহিত।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়