ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ১৩ জনের মৃত্যু আক্রান্ত ২৪২৫

আগের সংবাদ

আওয়ামী লীগের নতুন কর্মসূচি : রাজপথ পাহারা দেয়া, দল চাঙ্গা রাখার লক্ষ্য

পরের সংবাদ

বাজারের পারদ চড়ছেই : নির্ধারিত দামের ধারেকাছেও নেই তিন পণ্য, আমদানির ডিম দেশে আসেনি এখনো

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : প্রায় এক মাস আগে ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও তার প্রভাব একদিনের জন্যও বাজারে পড়েনি। সরকারি সংস্থা সারাদেশে কাঁচাবাজারগুলোতে অভিযান চালিয়েছে। ফলে ২-১ দিন কিছুটা স্থিতিশীল থেকে আবার বাড়তে শুরু করেছে এ তিনটি পণ্যসহ অন্যান্য প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম। আর এ পরিস্থিতির ভুক্তভোগী হচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষ, যারা জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পণ্য কিনতে ব্যয় বেশি হওয়ায় তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যে তা বিক্রি করতে পারছেন না। পাইকারি বিক্রেতাদের ভাষ্য, উৎপাদন খরচ না কমায় তারাও দাম কমাতে পারছেন না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমাদের পলিসিগত সমস্যার কারণে বাজারের অস্থিতিশীল অবস্থা আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তাদের মতে, ব্যবসায়ীরা সুযোগ সন্ধানী, বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়ায়। আবার সমস্যা সৃষ্টির অনেক পরে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান হচ্ছে প্রতিযোগিতা বাড়ানো। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না বাড়ানো পর্যন্ত দাম নির্ধারণ করলে তা কখনই কার্যকর হবে না।
যদিও অসাধু সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মনিটরিং কমিটির সঙ্গে পুলিশও যুক্ত থাকবে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে মাঠে নামানো আত্মঘাতী হতে পারে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় এক মাস আগে ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম নির্ধারণ করে দিলেও একদিনের জন্যও তা কার্যকর হয়নি। সরকার ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি পিস খুচরা দাম ১২ টাকা, দেশি পেঁয়াজের কেজি ৬৪-৬৫ টাকা ও আলুর কেজি ৩৫-৩৬ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ওইদিন রাজধানীতে ডিম ১৩ টাকা ২৫ পয়সা, আলু ৪২ থেকে ৫৫ টাকা ও দেশি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজারে দেখা গেছে, ডিম পিসপ্রতি ১৩ টাকা থেকে ১৪ টাকা এবং পেঁয়াজ ৮০ থেকে ১০০ টাকা ও আলু ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। ডিমের পাইকারি দাম ১০ টাকা ৫০ পয়সা, পেঁয়াজ ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা ও আলু ২৬ থেকে ২৭ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। দাম নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে সরকার ইতোমধ্যে ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিন দফায় ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত একটা ডিমও দেশে ঢুকেনি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এলসি খোলা নিয়ে জটিলতার কারণে বিলম্ব হচ্ছে বলে দাবি তাদের। এ সুযোগে ডিমের ‘সিন্ডিকেট’ আবারো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে এ পণ্যটি। আবার কবে ডিম আসবে তাও সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না। এ সুযোগে বেঁধে দেয়া দাম থেকে বেশি টাকায় বিক্রি হচ্ছে ডিম। তবে ব্যবসায়ীরা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আশা করছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে ডিম আসতে শুরু করবে। জানা গেছে, গত সপ্তাহের শেষে ১০ প্রতিষ্ঠানকে আইপি দিয়েছে আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। তাই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির ঋণপত্র খুলতে শুরু করেছে। আমদানির অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই ভারত থেকে ডিম আমদানি হবে। তবে বাজারে আসতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমাদের পলিসির সমস্যা রয়েছে। সম্প্রতি বাজার নিয়ন্ত্রণে ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত হলো। খুবই সীমিত আকারে অল্প কয়েকজনকে এ অনুমতি দেয়া হলো। আবার সেটা পারমিশন নিতেই লেগে যাচ্ছে অনেকদিন। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। টাকার অবমূল্যানের প্রভাবও বাজারে পড়ছে। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনার কারণেও মূল্যস্ফিতি বেড়ে যাচ্ছে। কারণ ডিমের বাজারে অস্থিরতার অনেক পড়ে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এখন আবার তা দ্রুত আনতেও পারছে না। অর্থাৎ বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বাজারে অস্থির পরিস্থিতিকে আরো দীর্ঘায়িত করছে।
এদিকে, ইউক্রেইন রাশিয়া যুদ্ধ পরবর্তী অস্থির নিত্যপণ্যের বাজারে এখনো স্থিরতা ফেরেনি। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে যুদ্ধ। তবে এ যুদ্ধে বাজারে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা। অবশ্য দীর্ঘায়িত হলে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। যদিও বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ২০ মাস আগে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব যখন ভুগছে, তখন ফিলিস্তিনে নতুন করে যুদ্ধ বেধে যাওয়া পুরো বিশ্বকেই বেকায়দায় ফেলে দেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। তবে পুরো বিষয় নির্ভর করছে যুদ্ধ কতটা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং কতটা ছড়িয়ে পড়ে তার ওপর।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, ইউক্রেইন রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাত দিয়ে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে যাচাই করা যৌক্তিক হবে না। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী আমাদের পলিসি ম্যানেজমেন্ট। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, নতুন করে ফিলিস্তিনের এ যুদ্ধ বিশ্ববাজারকে অস্থির করতে পারে। যদিও ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ যেভাবে বাণিজ্য যোগাযোগ ব্যাহত করেছিল- সেটা হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু যুদ্ধ তো যুদ্ধই। যুদ্ধ হলেই বাজার অস্থির হয়, অনিশ্চয়তা বেড়ে যায় এবং সেটার একটি প্রভাব সব ক্ষেত্রেই পড়ে। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আামদের দেশে ব্যবসায়ীদের মধ্যে সুযোগসন্ধানীর সংখ্যা বেশি। তাই তারা অজুহাত পেলেই বাজার অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনও মাঠে থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি মনে করি বাজারকে পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, বাজারকে বাজারের মতো ছেড়ে না দিলে সেটা আর বাজার বলে কিছু থাকে না। পুলিশ গিয়ে খুচরা বিক্রেতাকে পেটাবে। কাজেই পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যে জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন সেখানে করতে পারছি না। আমি মনে করি, সমস্যা খুচরা বিক্রেতার পর্যায়ে না। কারসাজির মাধ্যমে অযৌক্তিক মূল্যায়িত করা আড়তদার, পাইকারিতে, করপোরেট ব্যবসায়ীর মধ্যে আছে। এছাড়া যে ধরনের প্রশাসনিক সক্ষমতা প্রয়োজন সেটা তো আপনার নেই। আর যে সক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যেও তো পচন বা দুর্নীতি রয়েছে। কাজেই বাজার নিয়ন্ত্রণে নতুন খেলোয়ারদের বাজারে প্রবেশের পথে যে বাধাগুলো আছে সেগুলো ঠিক করে দিতে হবে। কাজেই দীর্ঘমেয়াদি টেকশই সমাধান হচ্ছে প্রতিযোগিতা বাড়ানো।
নতুন যুদ্ধ বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন করে আরেকটি যুদ্ধ বাজার পরিস্থিতিকে আরো অস্থির করে তুলতে পারে। তাই আমাদের সাবধান থাকতে হবে, যেন খাদ্যপণ্য মজুত থাকে। জ¦ালানির বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের দেশে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে সরকার। তাই এ বিষয়গুলোতে সজাগ থাকতে হবে।
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি কোনোভাবেই সরকার সামাল দিতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা সুযোগ সন্ধানি। তাই তারা সামান্য অজুহাত পেলেই দাম বাড়াচ্ছে। সামনে নির্বাচন আসছে। যে কোনো নির্বাচনের আগেই বাজারে টাকার ছড়াছড়ি হয়। ফলে নিত্যপণ্যের দাম আরো বেড়ে যায়। এ বিষয়ে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।
১০০ টাকার নিচে সবজি মিলছে না : সাধারণত অক্টোবর নভেম্বর মাস থেকেই বাজারে নতুন সবজি উঠতে শুরু করে। ফলে দামও একটু একটু করে কমতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দল, পটল, কচুর লতি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চিচিঙ্গা- শরতের সবজিগুলোই এখন বাজারে দেখা যাচ্ছে। তবে একশ টাকার নিচে বাজারে কোনো সবজি বিক্রি হচ্ছে না বললেই চলে।
ঢাকার সবজি ব্যবসায়ীদের তথ্য বলছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের ভারি বর্ষণের পর থেকেই সবজির দাম ব্যাপকভাবে চড়েছে। লম্বা বেগুনের দাম ৬০-৭০ টাকা থেকে এই কদিনে বেড়ে এক লাফে একশ টাকা ছুঁয়েছে। গোলাকৃতির বেগুন কিনলে কেজি প্রতি আরো ২০-৪০ টাকা বাড়তি খরচ করতে হবে। করলা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১০০-১২০ টাকা, ধুন্দল, ঝিঙা, চিচিঙ্গা এমনকি কচুর লতিরও একই অবস্থা। ছোট আকারের লাউ কিনলে অবশ্য ৭০-৮০ টাকায় মিলছে। ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পটল। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে সবচেয়ে সস্তা সবজির তালিকায় থাকা প্রতি কেজি পেঁপের দাম ছিল ২০-২৫ টাকা। এই সবজিটির দামও এখন ৪০ টাকা। ১২-১৫ টাকার একমুঠো শাকও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়।
মতিঝিল কলোনীর বাজারে সবজি কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী আবদুর রব জানান, সবজি খাওয়াটাও এখন সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। একশ টাকার নিচে সবজি পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। এদিকে সরকার ডিম, আলু, পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। উল্টো ৮০-৮৫ টাকা থেকে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়ে আবারো ১০০ টাকায় উঠেছে। ব্রয়লার মুরগির ডিমের ডজন ১৪৫-১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫০-১৫৫ টাকায় উঠেছে। আলু ৫০ টাকার নিচে নেই। লাল আলু আবার ৬০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের সবজির পাইকারী বিক্রেতা আলী আজম বলেন, সবজির সরবরাহ কমে গেছে। ভারি বৃষ্টির পর অনেকেই পুরনো সবজির ক্ষেত ভেঙ্গে শীতের সবজি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ কারণে দাম বেশি। এদিকে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকেই সবজির ফলন তুলে আমন চাষ করেছে। আবার অনেকেই শীতকালীন সবজির প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে কারণে সবজির সরবরাহ কিছুটা কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, গ্রীষ্মে এমনিতেই সবজির উৎপাদন কম। শীতকালে যেখানে প্রায় ৩৪ দশমিক ৫৭ লাখ টন সবজি উৎপাদন হয়, সেখানে গ্রীষ্মে সবজি উৎপাদন ১৫ লাখ টনের কম। শরতের এই সবজির উৎপাদনও গ্রীষ্মের উৎপাদনে যোগ করা হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়