মানবতাবিরোধী অপরাধ : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি খান রোকনুজ্জামান গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

ঝুঁকি প্রবল, প্রস্তুতি কম > বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা > মৃত্যুকূপ হবে রাজধানী > দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা নিয়ে সংশয়

পরের সংবাদ

গান্ধীজি সর্বোত্তম মানুষের এক পথিকৃৎ

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে লিখতে বসলে কিছুটা দোনোমোনোর মধ্যে পড়তে হয়। কারণ তাকে নিয়ে লেখার সময় অনেক বিষয় সামনে আসে। তার কোন বিষয়টি নিয়ে লিখব, আবার কোন বিষয়টি বাদ দেব, এ নিয়ে ভাবতে হয়।
তাকে নিয়ে লিখতে বসে যেমন এখন মনে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম মোহসীনের কথা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে অবসর নেয়ার পর ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন তার সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হতো এবং কথা হতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। একদিন ’৪৭-এর দেশ ভাগ সম্পর্কে কথা উঠলে তিনি চমকে দেয়ার মতো একটি তথ্য দিলেন। সেটা হলো পাকিস্তানের স্বাধীনতার জনক কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একদিনের জন্য জেলে যাননি। সে মুহূর্তে মনে পড়ছিল অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ‘গান্ধী’ বইটির কথা। এ বইয়ে কয়েক জায়গায় তিনি গান্ধীজির সঙ্গে জিন্নাহর তুলনা করেছেন। গান্ধীজি একজন অহিংসবাদী সত্যাগ্রহী ছিলেন। আর জিন্নাহ ছিলেন একজন চৌকস, চতুর ও ধুরন্ধর টাইপের মানুষ। এ কারণে তাকে ব্রিটিশদের জেলে যেতে হয়নি। তিনি ধর্মকর্মহীন ও শূকরের মাংস ভক্ষণকারী হয়েও মুসলমানদের নেতা হতে পেরেছিলেন। গান্ধীজি কতবার জেলে গিয়েছিলেন, কত বছর জেলে কাটিয়ে দিয়েছেন এর হিসাব কষতে যাব না। তবে এটি উল্লেখ করতে হয়, গান্ধীজির স্ত্রী কস্তুরবা মুম্বাই জেলে ১৯৪৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি স্বামীর কোলে মাথা রেখে চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
ভারতের স্বাধীনতার জন্য কত মানুষ জেল খেটেছেন এর হিসাব দেয়া সম্ভব নয়। জেল খেটেছেন এমন দুজন মানুষের নাম সামনে আছে। তারা হলেন- মতিলাল নেহরু ও তার পুত্র স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ইংরেজ শাসনের প্রতিবাদ ও ভারতের স্বাধীনতার জন্য মতিলাল নেহরু, তার স্ত্রী, কন্যা, পুত্র ও পুত্রবধূকে জেলে যেতে হয়েছে। মতিলাল নেহরু জেলখানা থেকে এলাহাবাদ আদালতে হাজিরা দেয়ার সময় তার কোলে ছিল প্রিয় নাতনি ইন্দিরা গান্ধী। নেহরু পরিবারে সবাই যখন জেলে, তখন কিশোরী ইন্দিরা এলাহাবাদ থেকে গিয়েছিলেন আহমেদাবাদে সবরমতী আশ্রমে। জওহরলাল নেহরুর জীবনের বড় একটি অংশ এলাহাবাদ, লক্ষেèৗ ও আলমোড়া জেলে কেটেছে। এর বিস্তারিত তথ্য মেলে পরিমল গোস্বামীর লেখা ‘প্রয়াগ থেকে শান্তিবন’ গ্রন্থে।
গান্ধীজিকে লিখতে নিয়ে আর একটি কথা মনে পড়ছে। সেটা হলো লন্ডন শহরে গান্ধী ও বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকারের মধ্যে দেখা এবং তাদের মধ্যে কথোপকথন। এ বিষয়টি গান্ধীজির আত্মজীবনীতে আসেনি। তবে জর্জ বার্নার্ড শর জীবনীতে এসেছে। ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ দুজনের মধ্যে লন্ডনের ইস্টএন্ডে গরিব পাড়ায় কিংসলে হলে দেখা হয়েছিল। এ কথা অন্নদাশঙ্করের বইয়ে লেখা আছে। বার্নার্ড শ প্রথমে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করেতে চাননি। পরে তার স্ত্রী শার্লোটের বারবার অনুরোধে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি কেন গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে চাননি। এগুলো লেখা আছে জর্জ বার্নার্ড শর জীবনীতে। গতকাল ২ অক্টোবর ছিল গান্ধীজির জন্মদিন। ১৯৩৩ সালের ২ অক্টোবর গান্ধীজির জন্মদিনে পালিত হয় অস্পৃশ্য দিবস হিসেবে। এ কথাটি স্মরণ রেখে গান্ধীজির সম্পর্কে আরো কিছু কথা লিখতে হচ্ছে। তিনি সমগ্র ভারতের অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য ও দলিত শ্রেণির মানুষের প্রতি যে মমত্ব দেখিয়েছেন, তা বিশ্বে বিরল। এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে উদাহরণ দিচ্ছি।
২০১৬ সালে মার্চ মাসে ট্রেনে সপরিবারে রামেশ্বরম থেকে মাদুরাই আসছি। ট্রেনে এক তরুণের সঙ্গে অনেক কথা হয়। আমাদের মাদুরাই যাওয়ার কথা শুনে সে মীনাক্ষী মন্দিরে কথা তোলে। মাদুরাইর মীনাক্ষী মন্দিরের স্থাপত্য বিশ্বনন্দিত। সে মন্দির সম্পর্কে বলতে গিয়ে গান্ধীজির কথা তোলে। সে জানায়, গান্ধীজি তিনবার মাদুরাইতে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি জগদ্বিখ্যাত মীনাক্ষী মন্দিরে প্রবেশ করেননি। তার এ বিষয়টি অনেক ভারতবাসীর কাছে অবাক করার মতো ঘটনা ছিল। কারণ এ মন্দিরের অনেক বিশেষত্ব রয়েছে। কিংবদন্তি যে, এ মন্দিরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্র এ মন্দিরের সরোবর পরিদর্শন করেন। অতীতে এ সরোবরের জলে সাহিত্যের মূল্য বিচার করা হতো। যেমন মূল্যহীন সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি জলে রাখলে ভারী পাথরের মতো ডুবে যেত। যার সাহিত্য মূল্য আছে, তা ভেসে থাকত এবং স্বীকৃতি পেত। গান্ধীর মতো একজন মহান মানুষ সে মন্দিরে প্রবেশ করছেন না, এ নিয়ে মন্দির পরিচালনা কমিটির গাত্রদাহ দেখা দেয়। তারা গান্ধীজির শরণাপন্ন হন। গান্ধীজি মন্দিরে প্রবেশ করবেন। শর্তটা কী? শর্তে তিনি বলে দেন, অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্যদের মীনাক্ষী মন্দিরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলে তিনি মন্দিরে যাবেন। মন্দির পরিচালনা পর্ষদ অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্যদের মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দিতে রাজি হন। এরপর গান্ধীজি মীনাক্ষী মন্দিরে প্রবেশ করেন। আমি এ কাহিনি কোনো বইয়ে বা প্রবন্ধ-নিবন্ধে পাইনি। এ কাহিনি ট্রেনে ওই তরুণের কাছ থেকে শুনেছি।
গান্ধীজি দলিত ও অস্পৃশ্যর সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছিলেন, তা নানাভাবে আলোচিত এবং প্রমাণিত। এ নিয়ে একটি চমকপ্রদ কাহিনি রয়েছে। ১৯৪৬ সালের ১৫ মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি হাউস অব কমন্সে বলেন, আমরা আর ভারত শাসন করতে চাই না। আমরা ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ মার্চ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, লর্ড পেথিক লরেন্স ও এ.ভি আলেকজান্ডার- এই তিন সদস্যবিশিষ্ট ক্যাবিনেট মিশন দিল্লিতে আসেন। ভারতে রাজনৈতিক দফারফা করতে হলে আগে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে হবে। এটা তারা ভালোভাবে জানেন। কিন্তু তারা গান্ধীজিকে পাবেন কোথায়? তিনি তো অবস্থান করছেন ঝাড়–দারদের বাল্মিকী কলোনিতে। নিরুপায় হয়ে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ও লর্ড পেথিক লরেন্স সরকারি আদব-কায়দা উপেক্ষা করে বাল্মিকী কলোনিতে গিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করেন। গান্ধীজির প্রার্থনা সভাগুলোতে তারা যোগ দেন। এ জন্য এ দুজনের ওপর ভাইসরয় জেনারেল ওয়াভেল বিরক্ত হয়েছিলেন।
হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য ও দলিত শব্দের অর্থ হলো ভগ্ন বা ছিন্নভিন্ন। এদের বেশির ভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এছাড়া তারা বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্ট এবং বিভিন্ন লোকধর্মসহ নানা ধর্ম বিশ্বাস করে। ভারতের এদের সংখ্যা ১৬ থেকে ২০ কোটি। পুনে প্যাক্টের পর ১৯৩৩ সালে গান্ধীজি সমাজের দলিত বা অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত করা লোকদের হরিজন নামে নামকরণ করেন। হরিজন অর্থ হচ্ছে হরি বা ভগবানের লোক।
১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার অস্পৃশ্য হিন্দুদের জন্য সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করে। এ ঘোষণায় অস্পৃশ্য হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এ সময় তখন অস্পৃশ্য হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবির নেতৃত্ব দিয়েছিলে ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। গান্ধীজি সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিরোধিতা করেন। তার মতে, হিন্দু সমাজকে বর্ণ হিন্দু ও তফসিলভুক্ত হিন্দু এই দুভাগে বিভক্ত করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, স্বতন্ত্র নির্বাচন মানে হলো অস্পৃশ্যদের হিন্দু সমাজ থেকে পৃথক করে দেয়া। এটা তিনি চাননি। অস্পৃশ্যরা বিশাল মানব গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে একত্রিত হয়ে বসবাস করবে। অস্পৃশ্যতার নাগপাশ থেকে তারা মুক্ত হয়ে সর্বমানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে। এটাই তিনি কামনা করেছেন।
গান্ধীজি সংকল্প করলেন, তিনি ব্রিটিশ সরকারের দেয়া সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিরুদ্ধে আমরণ অনশন করবেন। অনশনের একদিন আগে ১৯ সেপ্টেম্বর তার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। তিনি তারবার্তায় বলেন, ‘ভারতের সংহতি ও ঐক্যের জন্য জীবন বিসর্জন দেয়া এক গৌরবজনক কাজ। যদিও আমরা বলতে পারব না, আমাদের শাসকদের ওপর এটি কী প্রভাব পড়বে। কারণ তারা জানে না, আমাদের জনগণের কাছে কী রকম এটির গুরুত্ব।’
গান্ধীজি ৫ দিন একাধারে অনশন করায় দেশবাসীর সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথকে উৎকণ্ঠিত করেছিল। গান্ধীজির পাশে থাকবেন বলে ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি পুনার পথে রওনা দিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন তার সেক্রেটারি কবি অমীয় চক্রবর্তী এবং সুরেন্দ্রনাথ কর। কবি ২৬ সেপ্টেম্বর পুনার যারবেদায় পৌঁছেন। তার আগের দিন অনশনের ষষ্ঠ দিবসে বর্ণহিন্দু ও অনুন্নত জাতির নেতাদের মধ্যে এক আপসমূলক চুক্তি হয়, যা ইতিহাসে ‘পুনা প্যাক্ট’ বলে পরিচিত। গান্ধীজি স্ত্রী কস্তুরবার হাত থেকে কমলালেবুর রস পান করে অনশন ভঙ্গ করেন। রবীন্দ্রনাথ তার কাছে গেলে গান্ধীজির অনুরোধে তিনি গান গেয়ে ছিলেন, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো’।
পুনা প্যাক্টের পর অনুন্নত বর্ণের লোকরা গান্ধীজি কর্তৃক ‘হরিজন’ আখ্যায়িত হয়। চুক্তিতে বাধা প্রদান করেছিলেন অনুন্নত, দলিত ও অস্পৃশ্য মানুষের নেতা আম্বেদকর। তিনি একজন অন্ত্যজ শ্রেণির লোক হলেও উচ্চ শিক্ষিত ও মানবতাবাদী। ভীমরাও রামজি আম্বেদকরকে দলিত ও অস্পৃশ্যরা বাবা সাহেব বলে। (তিনি ভারতের সংবিধানের স্থপতি এবং প্রথম আইনমন্ত্রী। তিনি সরকারিভাবে মান মর্যাদার দিকে ওপরে অবস্থান করলেও সামাজিকভাবে হতাশায় ভুগেছিলেন। কারণ তিনি অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ। তাকে পরতে পরতে টোকা খেতে হয়। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৬ সালে তার ৫ লাখ অনুসারী নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন) গান্ধীজি তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছেন, তিনি শুধু অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক আসন মেনে নিচ্ছেন না। একই সঙ্গে জনসংখ্যা নিরিখে যত আসন দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তিনি তার দ্বিগুণ আসন দেবেন। সে সময় কংগ্রেস পার্টি থেকে গ্রামগঞ্জে, শহরে-নগরে, সভা-সমাবেশে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। চুক্তির পর অস্পৃশ্যদের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেয়া হয়েছিল। গ্রামের কুয়ার জল হরিজনদের জন্য নিষিদ্ধ রইল না। সর্বোপরি জওহরলাল নেহরুর মা স্বরূপরানী নেহরু জানালেন, তিনি হরিজন পাচকের হাতের রান্না নিয়মিত আহার করছেন। ১৯৩৩ সালের ২ অক্টোবর গান্ধীজির জন্মদিনে পালিত হলো অস্পৃশ্য দিবস হিসেবে।
তার আত্মজীবনীতে দেখা গেছে, তিনি ঘুরেফিরে সমাজের দলিত, অস্পৃশ্য, অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছেছেন এবং তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। অনেকক্ষেত্রে তাদের কাছে গিয়ে তিনি স্বস্তি খুঁজে পেয়েছেন। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ১ মে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি বৈঠক বসতে চলেছে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে। কংগ্রেস দেশ ভাগ মেনে নেবে কিনা, এ নিয়ে মূলত বৈঠক। ওয়ার্কিং কমিটি অনেক আলোচনার পর দেশ ভাগের ভিত্তিতে স্বাধীনতা মেনে নেয়। গান্ধীজির কাছে মনে হয়েছে, যদি দেশ ভাগ হয়ে যায় সেটা হবে ‘আত্মিক ট্র্যাজেডি’। গান্ধীজি ৭ মে প্রার্থনা সভায় দেশ ভাগের বিরোধিতা করলেন। তিনি তখন দিল্লির ভাঙ্গি (মেথর) কলোনিতে তার ঠিকানা করে নিলেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আগুনের স্ফুলিংয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে কলকাতা, দিল্লি ও পাঞ্জাবে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। তিনি তখন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। দাঙ্গা প্রতিরোধ কল্পে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের লোকদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতা চষে বেড়ান। অনশনেও বসেন। যার অনশন নিয়ে সব ধর্মের মধ্যে চলে উত্তেজনা। সবাই চেষ্টা করেন যাতে গান্ধীজি অনশন ভাঙেন। সবাই তার জন্য প্রতিশ্রæতি দেন, তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখবেন। সাম্প্রদায়িকতার দাউ দাউ করে জ¦লে ওঠা অগ্নিশিখা স্তিমিত হওয়ায় তিনি দিল্লি হয়ে পাঞ্জাবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কলকাতা থেকে বিদায় নেয়ার আগে তার প্রেরণায় কলকাতায় গঠন করা হয়েছিল ‘শান্তিসেনা’। শান্তিসেনার সদস্যরা দাঙ্গা প্রতিরোধ করবে। তিনি প্রথমে ট্রেনে কলকাতা হয়ে দিল্লি যাবেন। এরপর যাবেন পাঞ্জাবে। দিল্লি যাওয়ার উদ্দেশে গান্ধীজি ট্রেনে উঠলেন।
এর আগে শান্তিরক্ষার লক্ষ্যে দিল্লিতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। দিল্লিতে ট্রেন পৌঁছাবার আগেই কংগ্রেসের নেতারা শাহদারা স্টেশন থেকে গান্ধীজিকে নামিয়ে নিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল স্বয়ং এসে জানালেন, এ অশান্তিময় পরিবেশে তার আগের থাকার জায়গা মেথর কলোনিতে যাওয়া সম্ভব নয়। তার নিরাপত্তার জন্য তাকে বিড়লা হাউসে যেতে হবে। বিড়লা হাউসে যাওয়ার কথা শুনে তিনি অনেকটা হতাশ হয়েছিলেন। কারণ তার কাছে বিড়লা হাউস মানে প্রাসাদ। তিনি প্রাসাদের চেয়ে মেথর কলোনিতে থাকা উত্তম মনে করেন।
১৯২০ সালে নবজীবন পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই অস্পৃশ্যদের ত্যাগ করবেন না। এমনকি তাদের জন্য স্বরাজ (স্বাধীনতা) ত্যাগ করতেও রাজি। আহমেদাবাদে এক প্রার্থনা সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি প্রার্থনা জানাই, যদি আমার পুনর্জন্ম হয় তাহলে আমি যেন অস্পৃশ্য হয়ে জন্মাই।’ জীবনের শেষদিকে নিজেকে তিনি মেথর হিসেবে পরিচয় দিতেন। বলতেন, ‘ম্যায় ভাঙ্গি হুঁ। একজন সর্বোত্তম মানুষের পক্ষে এসব বলা এবং করা সম্ভব।

মতিয়ার রহমান পাটোয়ারী : সাংবাদিক ও লেখক
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়