জন্মদিনের শুভেচ্ছাপত্র

আগের সংবাদ

অদ্ভুদ আবাস!

পরের সংবাদ

শিশু পর্নোগ্রাফি ও সাইবার বুলিং : নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শিশু পর্নোগ্রাফি বলতে ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুকে ব্যবহার করে অশ্লীল ছবি থেকে শুরু করে অডিও-ভিডিও তৈরি করাসহ প্রচার ও সংরক্ষণ করা বা এ জাতীয় কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াকে বোঝায়। এর ফলে একজন শিশু বিশেষ করে কন্যাশিশুরা পিছিয়ে পড়ে। ছেলেদের ক্ষেত্রেও অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে প্রায়ই ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সঙ্গে সংগতি রেখে চলতে পারে না। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ তাদের কাছে স্বপ্নলোকের মতো হয়ে দেখা দেয়। তাদের জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় এক অন্ধকার।
সাইবার বুলিং হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিভিন্ন ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটসহ যে কোনো ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহার করে কাউকে উৎপীড়ন করা, ভয় দেখানো, লজ্জা দেয়া বা উদ্বুদ্ধ করা। এ ধরনের কর্মকাণ্ড কন্যাশিশু এবং নারীদের প্রতি বারবার সংঘটিত হয়ে থাকে। সাইবার বুলিংয়ের ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ নারী, যার অধিকাংশই স্কুল, কলেজে পড়–য়া শিক্ষার্থী। পর্নোগ্রাফি বা সাইবার বুলিংয়ের মতো কলুষতার শিকার শিশুরা শুধু শিক্ষা কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অধিকার হারায় তা-ই নয়, একই সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। বাধা পড়ে পুষ্টিহীনতার চক্রে। অনেক সময় শিশুকে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখায়, কখনো কখনো প্রেমের ফাঁদে ফেলে, পণ্য কেনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো স্থানে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। কন্যাশিশুরা বুঝতে পারে না। সহজ-সরল বিশ্বাসে তারা এসব পথে পা বাড়ায়। এরপরই শুরু হয় তাদের জীবনের অন্য জগতের ছোঁয়া।

কেস স্টাডি-১
প্রথম ঘটনাটি রাজধানী ঢাকার আদাবরে বাস করা ১৫ বছর বয়সি সুজানা। তার বান্ধবীর বড় ভাই ফয়সালের সঙ্গে তার প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা একসময় শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। সুজানার সরলতা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাসকে পুঁজি করে ফয়সল তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় এবং পুরো বিষয়টির ভিডিও ধারণ করে সুজানার অজান্তেই। এরপর শুরু হয় ফয়সালের ‘ব্ল্যাকমেইলিং’ খেলা। ৫০ হাজার টাকা না দিলে ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয় ফয়সল। কিশোরীর চোখে সর্ষে ফুল। সে দিশাহারা, সমাধান কী? আত্মীয়-স্বজন থেকে টাকা ধার নেয়া থেকে শুরু করে মায়ের আংটি পর্যন্ত চুরি করে ৪০ হাজার টাকা দিলেও ফয়সল তাকে নিষ্কৃতি দেয়নি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে সুজানাকে চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে পাওনাদাররা। ফলস্বরূপ আস্তে আস্তে সে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করে এবং একটা সময় গিয়ে যখন সবকিছু স্পষ্ট হয়, ততদিনে সুজানা মানসিক রোগী। এই যে মোবাইল ফোনে অনিচ্ছাকৃতভাবে ধারণ করা সুজানার ওই ভিডিওটি, তার শিক্ষা, তার স্বাস্থ্য সর্বোপরি তার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যে অবনতি ঘটিয়েছে তা চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু এর দায় নেবে কে?
কেস স্টাডি-২
দ্বিতীয় ঘটনাটি মেঘলার। সে অল্প বয়সে বাবাকে হারায়। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আর এগোতে পারেনি মেঘলা। একদিকে আর্থিক দৈন্যতা, অন্যদিকে সাংসারিক দায়িত্ব। ১৬ বছর বয়সি এক কিশোরী- যার হেসে খেলে শৈশব কাটানোর কথা ছিল। এর পরিবর্তে মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতনে অফিস সহকারীর চাকরি মেলে বেসরকারি একটি সংস্থায়। সেখানেই সহকর্মী মেজবার সঙ্গে তার সখ্য থেকে প্রেম, তারপর শারীরিক সম্পর্ক এবং যথারীতি ভিডিও চিত্র ধারণ। একটা পর্যায়ে মেজবা মেঘলার ছোট বোনের দিকে হাত বাড়ায়। মেঘলা ঘটনাটি জানতে পারে এবং এর প্রতিবাদ করে। মেজবা এবার বীভৎস খেলায় মত্ত হয়ে উঠে। সে মেঘলার কিছু বিকৃত ছবি এলাকায় ছড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি ভয় দেখায় ১ লাখ টাকা না দিলে এটি সর্বমহলে ছড়িয়ে দেবে। মেঘলা লজ্জা আর দ্বিধায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়। নিজের মান-সম্মান ও পারিবারিক ভয় ইত্যাদি মিলিয়ে এবার সে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে। মেঘলা আমার কাছে ছুটে এসেছিল। আমি থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছিলেন জিডি করতে। কিন্তু সমস্যা হলো- প্রথমত, যে ছবিগুলো বেনামে ছাপিয়ে এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তা বন্ধ করা যাবে কীভাবে? দ্বিতীয়ত, ওরা কীভাবে মান-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে? তৃতীয়ত, মেজবার চাচা একজন রাজনীতিবিদ। তার সাহায্যও চেয়েছিলাম। উল্টো অঙ্গুলি নির্দেশ প্রদান করে বলা হয়েছে- বাঁচতে চাইলে মেঘলাদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে, নইলে উল্টো কেস দেয়া হবে। থানা থেকে জানানো হয়, এসব বিষয় আলোচনার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি করতে, তা না হলে অনেক দিন পর্যন্ত এর মূল্য দিতে হবে মেয়ের পরিবারকেই।
উপরোল্লিখিত প্রত্যেকটি কেস নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে এর নেপথ্যের কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। তা হলো : এরা সবাই কিশোরী। তাদের স্বপ্নগুলো ছিল একটি স্বপ্নীল ভবিষ্যৎকে ঘিরে। আরেকটি বিষয় ছিল চরম দারিদ্র্য ও অল্প শিক্ষা, অন্যকে সহজে বিশ্বাস করা এবং বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে অবলম্বন খোঁজার চেষ্টা। সর্বোপরি তিনজনই জীবনসঙ্গী কর্তৃক প্রতারিত হয়েছেন। তাদের স্থিরচিত্র ও ভিডিওচিত্রকে বিকৃত করে পুরুষসঙ্গী কর্তৃক প্রচার করার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করা এবং ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে অর্থ উপার্জনের একটি ক্ষেত্র তৈরি করার প্রচেষ্টা ছিল তাদের। সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ আইনটির ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কোনো তথ্য প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক কিংবা এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করেন, যা কোনো ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে, বা কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কোনো তথ্য উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন তাহলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং এর সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। এ ছাড়া ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোনো মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন (দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী কোন অপরাধ করেন) তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। (উল্লেখ্য, দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানি সম্পর্কিত বিধানের উল্লেখ রয়েছে।)
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এতসব আইন থাকার পরও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা ও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে পর্নোগ্রাফি ও সাইবার বুলিংসহ কন্যাশিশু ও নারীদের প্রতি নির্যাতন রোধ করা যাচ্ছে না।
শিশু পর্নোগ্রাফি ও সাইবার রোধে শিশুদের আরো বেশি সচেতন করতে হবে। নিরাপদ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা। অনলাইনে অপরিচিত কারো সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়া। নিজের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র শেয়ার করার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া। অনলাইনে কেউ উত্ত্যক্ত করলে, সন্তোষজনক আচরণ করলে তা মা-বাবা বা অভিভাবকদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য শিশুকে উদ্বুদ্ধ করা। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আইনি কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের জন্য আমাদের নজর দিতে হবে। সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধগুলোও ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিকদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে, তৎপর হতে হবে।

নাছিমা আক্তার জলি : উন্নয়নকর্মী ও সম্পাদক, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়