জন্মদিনের শুভেচ্ছাপত্র

আগের সংবাদ

অদ্ভুদ আবাস!

পরের সংবাদ

আমলা ও অর্থনীতিবিদের বিরোধ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৫৫ ব্যাচের সিএসপি সুলতান-উজ জামান খান ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত, কিন্তু তার দলের প্রতিশ্রæত সমাজতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে তিনি তার ‘স্মৃতির সাতকাহন : এক আমলার আত্মকথা’ (২০০৭) গ্রন্থে একাধিকবার প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আন্তরিকতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে পরিকল্পনা কমিশনকে তিনি ছাড় দেননি। তার লেখা থেকে উদ্ধৃত : বাংলাদেশের ‘সমাজতন্ত্র’ সম্বন্ধে স্মৃতিমন্থন করতে গিয়ে সে সময়কার উচ্চদর্শী (যরময ঢ়ৎড়ভরষব) পরিকল্পনা কমিশনের ভূমিকাও অবধারিতরূপে আলোচনায় এসে পড়ে। এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, দেশের প্রায় তিন দশকের ইতিহাসে (গ্রন্থের রচনাকাল থেকে) ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রথম পরিকল্পনা কমিশনটি জাতীয় এবং স্বাধীনতার আদর্শবাদে বিশেষ উদ্বুদ্ধ ও উচ্চ ক্ষমতাশীল। কমিশনের দায়িত্বভার নিয়েছিলেন দেশের কয়েকজন সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ। কমিশন প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত ড. নুরুল ইসলাম এবং সদস্যত্রয় অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. মুশাররফ হোসেন ও ড. আনিসুর রহমান পণ্ডিতব্যক্তি হিসেবে সুবিদিত (বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রথমদিকে কমিশনের উচ্চতম পর্যায়ে অর্থনীতিবিদ ব্যতীত অন্য কোনো বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুবই সীমিত ছিল)।
আমার জানামতে, গোটা কমিশন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, বিশেষ করে রেহমান সোবহান সমাজতন্ত্রের নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, এ কথা সর্বমহলে শোনা যেত। তবে বাংলাদেশের তথাকথিত ‘সমাজতন্ত্রের’ নমুনা (এবং অভিজ্ঞতা) বিচার করলে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক আমাদের রাজনীতিবিদদের মতো তারাও কতখানি আন্তরিক ছিলেন।
সমাজতন্ত্রের অলীক স্বপ্ন
সুলতান-উজ জামান খান মনে করেছেন সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি তাদের অনুরাগ খাঁটি হয়ে থাকলেও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন ছিল কমিশনের জন্য একটি অলীক স্বপ্ন মাত্র! তিনি তখন পাট বিপণন সংস্থায় কাজ করছেন (তখন পাট মন্ত্রণালয় স্থাপিত হয়নি), নির্বাচনের ইশতেহার অনুযায়ী অর্থনীতির প্রধান খাতগুলো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় স্থানান্তর করা প্রতিশ্রæতি রয়েছে। জাতীয়করণের প্রথম ভিকটিম পাটশিল্প। সে সময় সরকার ছাড়া পাট উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন, শিল্পে ব্যবহার সব খাতের এমনকি বিদেশি ক্রেতাও এই জাতীয়করণের বিরোধিতা করে। তিনি উল্লেখ করেছেন :
ইউরোপে আমাদের বৃহৎ পাট ক্রয়কারীদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছিল এই সরকারি পদক্ষেপ রুখতে। পাট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনাকালে তাদের মুখপাত্র এক তেজীয়ান ফরাসি মহিলা জানালেন, তারা দীর্ঘকাল ধরে তাদের সুপরিচিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে পাট কিনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে যে পারস্পরিক আস্থার ভিত্তি এতটা যুগ ধরে গড়ে উঠেছে রাতারাতি কোনো অপরিচিত অনামি আমলার কাছে তা সঁপে দিতে তারা আদৌ ইচ্ছুক নন।
পাট বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বাংলাদেশ সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন প্রস্তুতিবিহীন জাতীয়করণের এই তড়িঘড়ি পদক্ষেপ হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু আমলাকে যেহেতু রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত করতে হয়, লুৎফর রহমান বিদেশি ক্রেতাদের জাতীয়করণের যৌক্তিকতা বোঝাতে গিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত ও অপদস্ত হলেন। ‘যেসব দুরূহ পরিস্থিতিতে আমলার নিজস্ব বিবেক বা বিচারবুদ্ধির বিরুদ্ধে সরকারি কর্তব্যপালন করতে গিয়ে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হন, এই পাট জাতীয়করণ প্রক্রিয়া ছিল তারই এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।’
রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। আর তারা যদি এ কথা ভেবে থাকেন যে কোনো মতে ব্যক্তিমালিকানাধীন কলকারখানা সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করে নিলেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল, সেটাও তাদের রাজনৈতিক হঠকারিতার প্রমাণ বৈ কিছু নয়।
তিনি আরো বলেছেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে যেসব তথাকথিত স্বায়ত্তশাসিত করপোরেশন সেকালে গঠন করা হয়েছিল সেগুলোর অদক্ষ, অপচয়মূলক ও আমলাতান্ত্রিক পরিচালনা ছিল ব্যবসায়িক রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি। কালক্রমে এগুলো প্রশাসনিক দুর্নীতি ও কিছু লোভী রাজনীতিবিদের লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয় এবং আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে বিশাল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
আমলা নয়, মন্ত্রীর সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের বিরোধ
নৌপরিবহন ও বিমান চলাচল মন্ত্রী (তখন দুটি পরিবহনের একটি মন্ত্রণালয়ই ছিল) ছিলেন এম এ জি ওসমানী। ৫০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ (১৯৭৩ সালের ৫০ কোটি!) ভরাট ও মৃতপ্রায় নদ-নদীর পুনরুজ্জীবন প্রকল্প প্রণয়ন করা। তিনি নিজেই ছিলেন উদ্যোগী। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট সদস্য রেহমান সোবহান প্রকল্প সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করলে তিনি তা আপত্তিকর বলে বিবেচনা করেন এবং ক্ষুব্ধ হন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তীব্র মতবিরোধী সৃষ্টি হলে বিষয়টি মন্ত্রিসভা পর্যন্ত গড়ায়। মন্ত্রিসভার সংশ্লিষ্ট বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। ওসমানী সাহেব পরিকল্পনা কমিশনের ভূমিকাকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে প্রশ্ন রাখেন : ‘তাহলে আমরা কি কতিপয় খুদে কিসিঞ্জার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি? (ঞযবৎব ধৎব বি ফবংঃরহবফ ঃড় নব মঁরফবফ নু ধ নঁহপয ড়ভ ষরঃঃষব করংংরহমবৎং?) আমার আজো মনে আছে কমিশনের প্রধান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এর যে জবাব দেন, সেটা তাদের আত্মরক্ষার ক্ষীণ প্রচেষ্টা মাত্র ছিল।’
সিএসপি ড. আব্দুস সাত্তার পরিকল্পনা কমিশনের সচিব হিসেবে যোগ দেয়ার পরপর তার মনোভাব যখন কমিশনের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলো না প্রধানমন্ত্রীকে বলে তাকে প্রত্যাহার করানো হলো। কিন্তু অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে বিস্মিত করে তিনি হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। ১৯৫৮ ব্যাচের এই সিএসপি সম্পর্কে তার তিন ব্যাচ সিনিয়র সুলতান-উজ জামান খান লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে তার কর্তব্যাদি সম্পর্কে অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না।
‘ফ্রম হর্সেস মাউথ’ হাসনাত আবদুল হাইয়ের আমলা জীবনের স্মৃতিকথা। একাত্তর-পূর্ব বছর পাঁচেক পাকিস্তান আমলের, বাকিটা বাংলাদেশের। গ্রন্থে পরিকল্পনা কমিশন নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায় রয়েছে, এর মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কিছু অমধুর স্মৃতি পাশ কাটিয়ে দাপ্তরিক বিষয়গুলো কিছুটা সংক্ষেপে লেখকের জবানীতে উপস্থাপন করছি :
স্পষ্টতই অনিবার্য সিদ্ধান্ত হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের মতো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন- অর্থনীতির পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য তাই প্রয়োজন। আর পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশন লাগবে। প্রশাসনিক পদ্ধতি পুনর্গঠিত হওয়ার আগেই কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন, তিনি অধ্যাপক এন আই (কী কারণে লেখক নুরুল ইসলাম লিখেননি, তা পাঠক হিসেবে আমার কাছে অস্পষ্ট)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সের পরিচালক। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবির পক্ষে যে যৌক্তিকতা তিনি তার সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তিনি কমিশনের সব সদস্য, বিভাগ ও শাখার প্রধান পছন্দ করে নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের সবারই পেশাদার অর্থনীতিবিদ। এটা তখন সুবিদিত ছিল যে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের অঙ্গ সংস্থা হিসেবে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সের পরিচালককে কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এম এম আহমেদ লালন করার মতো স্মৃতিসমৃদ্ধ করে যাননি। এম এ আহমেদের কক্ষে ঢুকতে অপেক্ষার যন্ত্রণা যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করত তা তো ভোলার নয়। হয়তো আরো কিছু অভিজ্ঞতা তার হয়ে থাকতে পারে যা অধ্যাপক এন আইকে তিক্ততায় ভরে রেখেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে যাতে এসবের পুনরাবৃত্তি না ঘটে এ জন্য তিনি নিশ্চয়ই প্রতিশ্রæতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি কেবল নিজের জন্য পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা এবং সদস্যদের জন্য প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেননি, ডিভিশন চিফ এবং সেকশনে চিফ সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন দক্ষতার পেশাকে অর্থনীতিবিদ নিয়োগ করে সচিবালয়ের পদের বিভিন্ন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। তার উদ্যোগে ডিভিশনে চিফকে সচিব এবং সেকশন চিফকে যুগ্ম সচিবের মর্যাদা দেয়া হয়। পরিকল্পনা কমিশনের সচিব নিয়োগ করা হয়েছে সিভিল সার্ভিস থেকে যাতে সদস্যদের উচ্চ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও সচিবের মর্যাদা তখন ডিভিশন চিফের সমমানের। এটা প্রফেসর এন আইয়ের মহাপরিকল্পনাপ্রসূত। অন্য সদস্যরা কেউ তার মতো আমলাতন্ত্রবিরোধী ভাবাপন্ন ছিলেন।
হাসনাত আবদুল হাই লিখেছেন : একদিন প্রফেসর এন আই আমাকে ফোন করলেন এবং পরিকল্পনা কমিশনে ডেপুটি চিফ কিংবা ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দিতে বললেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে অসম্মতি জানালাম। কারণ সেখানে যোগ দিলে দেখা যাবে কমিশনের জয়েন্ট চিফদেরও কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জুনিয়র। তিনি আমার সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে আমাকে সম্মত করাতে সফল না হয়ে বললেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে কুড়ি মিনিট ধরে কথা বলছি। কোনো মন্ত্রী কি ডেপুটি সেক্রেটারির সঙ্গে কখনো দশ মিনিটের বেশি সময় কথা বলেন?’ আমাদের কথোপকথনের সেখানেই সমাপ্তি, আমি হতভম্ব ও স্তম্ভিত হয়ে পড়ি।
ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে অধ্যাপক এন আইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি কোনো রকম রাখডাক না করেই লিখে গেছেন। তিনি অধ্যাপক এন আইয়ের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যানের মর্যাদা সচেতনতার কথা তুলে ধরেন : ‘এলিট’ সার্ভিসকে ভেঙে দেয়ার জন্য তিনি কমিশনে প্রাপ্ত ক্ষমতা ডিঙ্গিয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন। এলিট সার্ভিস থাকবে কি থাকবে না তা রাজনৈতিক সরকারের বিবেচ্য, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত অর্থনীতিবিদদের নেয়ার কথা নয়, কেউ কেউ আবার তাদের পুরনো ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করেন। আমি যখন কমিশনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের এমন তীব্র অনুভূতি আঁচ করিনি। … ট্র্যাজেডি হচ্ছে তার মতো একজন মানুষ যখন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হন তখন পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিশেষ করে তার সঙ্গে সিভিল সার্ভেন্টদের সম্পর্ক বিনষ্ট হতে বাকি থাকার কথা নয়। অধ্যাপক এন আই তার গ্রন্থে সিভিল সার্ভেন্টদের বিরুদ্ধে প্রচার বিষোদগার করেছেন, কিন্তু তিনি নিজে কোন ভুলগুলো করছেন তা অনুধাবনই করতে পারেননি। তার বইয়ে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে তার হীন ধারণা প্রকাশ পেয়েছে। বাস্তবায়ন পর্যায়ে পরিকল্পনার ব্যর্থতার দায় তিনি তাদের ওপর অর্পণ করেছেন। কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য কিংবা ডিভিশন চিফদের কেউই কমিশনে থেকে গিয়ে তাদের প্রণীত পরিকল্পনার কী পরিণতি ঘটেছে তা আর দেখার সুযোগ গ্রহণ করেননি। ব্যাপারটা এমন যেন পরামর্শকের কাজ করার জন্য তাদের চুক্তি করে আনা হয়েছে এবং কাজটা সেরে তারা উড়ে চলে গেছেন। কমিশন প্রণীত পরিকল্পনার স্বত্ব মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেনি, কারণ প্রণয়ন পর্যায়ে তাদের সংযুক্ত করা হয়নি। ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পনা চর্চায় মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। যেহেতু মন্ত্রণালয় উপেক্ষিত হয়েছে এ পরিকল্পনা দলিলের প্রতি তাদের কোনো প্রতিশ্রæতি দেখা যায়নি, কিন্তু পরিকল্পনাকারী ও সাধারণ প্রশাসনের ঐক্য রক্ষিত থাকলে ওই প্রতিশ্রæতি বিদ্যমান থাকত। যেসব পরিকল্পনাকারী দলিল প্রণয়ন করলেন তারা কাজটিকে মনে করলেন কেবল পেশাজীবী টেকনোক্র্যাটদের করণীয়। এমনকি রাজনৈতিক মন্ত্রীদেরও তারা নিজেদের ভুবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন।
পরিকল্পনার সাফল্য পরীক্ষার একটি অধ্যায় হচ্ছে শিল্পের জাতীয়করণ বাস্তবায়ন। অর্থনীতির কমান্ডিং হাইটসের ওপর সরকারি খাতে একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক মোচড়ে সমাজতান্ত্রিক মডেলের এটাই অপরিহার্য উপাদান। সরকারি খাতের শিল্প প্রশাসনের কোনো নীল নকশা তৈরি করা হয়নি। শিল্পের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো প্রতিশ্রæত ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়নি। এই ব্যর্থতার একটি মাত্র ব্যাখ্যা অধ্যাপক এন আই দিয়েছেন :
জাতীয়করণকৃত খাত লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে এবং অতি সামান্য লাভ করেছে, আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির সৃষ্টি করা স্তব্ধকরণ সেই সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও সংগঠনগত ঘাটতির ফাঁদে পড়ে এই পরিণতি বরণ করেছে…
এই ব্যাখ্যার পর জবাব দাবি করা যায় : জাতীয়করণকৃত শিল্পের পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা কমিশন কী সুপারিশ করেছিল? ধরে নেয়া যাক এই দানবাকৃতির সরকারি খাতের জন্য কোনো রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক প্রতিশ্রæতি নেই, সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক অচলবস্থা বা আমলাতান্ত্রিক বাধা সামলাতে তারা কোন ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ সুপারিশ করেছিলেন? পরিকল্পনা দলিল এই প্রশ্নে একেবারে নীরব।
যেভাবে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে, এটাই অনিবার্য হয়ে উঠেছে যে এর বাস্তবায়ন মোটেও সহজসাধ্য হবে না। পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আনুভূমিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিকল্পনা প্রক্রিয়া অঙ্গীভূত না করায় কমিশন পুরোপুরি সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে না। বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিকল্পনাকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঠিকভাবে যুক্ত করা হয়নি। ব্যর্থতার যে দায়ের কথাই বলা হোন না কেন হাসনাত আবদুল হাই মনে করেন, ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এন আইয়ের মানসিকতাই এই ব্যর্থতার মূল কারণ।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়