গণপিটুনি থেকে বাঁচতে ৯৯৯-এ চোরের কল

আগের সংবাদ

পরিবারের আড়ালে তৎপর দল > খালেদার বিদেশযাত্রা : আলোচনায় জার্মানি > আশাবাদী দল ও পরিবার > অল্প সময়ে সিদ্ধান্ত

পরের সংবাদ

ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের রূপকার তুমি, তুমিই বাংলাদেশ!

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১, ২০২৩ , ৩:০৩ অপরাহ্ণ

১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, জ্যৈষ্ঠ মাসের কোনো এক পড়ন্ত বিকাল! পশ্চিমাকাশে অস্তগামী সূর্যটা ঘন কালো মেঘে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির সামনে অগণিত মানুষের ভিড়। মানুষের ভিড়ে রাস্তায় পা ফেলার সুযোগ নেই। তেত্রিশ বছর বয়সি এক নারীকে কেন্দ্র করেই বৃষ্টিতে কাকভেজা মানুষের ভিড়। দমকা ঝোড়ো হাওয়া কিংবা মুষলধারায় বৃষ্টি কোনো কিছুই জনস্রোতকে একবিন্দুও টলাতে পারছে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনস্রোত ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এত এত মানুষের ভিড় তারপরও কোথাও কোনো কোলাহল নেই। কোলাহলহীন, সুনসান নীরবতা ছাপিয়ে মাঝে মাঝেই কানে আসে কুরআনের ধ্বনি। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় বসে নারীটি কুরআন তেলাওয়াত করছেন করুণ সুরে। তেলাওয়াত বাধাগ্রস্ত হয় কান্নায়। তিনি অঝোরে কাঁদছেন আর কুরআন তেলাওয়াত করছেন। চোখের পানিতে পবিত্র কুরআনের পাতা ভিজে যায়। ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট হয়ে আসে কুরআনের আয়াত। নিজেকে সামলে নেন তিনি, আবারো তেলাওয়াত শুরু করেন। বকুল ফুলের তীব্র গন্ধে পরিবেশটা আরো মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে। ধানমন্ডি লেকের বৃক্ষরাজিও তার কান্নায় থমকে যায়। উত্তর-পশ্চিম আকাশে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। প্রকৃতি যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরে বলে ওঠে, ‘মা তোমার ভয় নেই। কে বলেছে তোমার কেউ নেই? কান্না থামাও। মাথা উঁচু করো। চেয়ে দেখো, লক্ষ-কোটি জনতা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা সবাই আছি তোমার পাশে।’ প্রকৃতির কথায় তিনিও সাড়া দেন। শোকে মুহ্যমান নারীটি এবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াল বাংলাদেশ! দীপ্ত পায়ে এগিয়ে যান রাজপথ ধরে, পেছনে তখন লক্ষ-কোটি জনতার মিছিল। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সেদিনের সেই নারী আর কেউ নন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! ঝড়-বৃষ্টির আকাশ কাঁপিয়ে সেদিন শেখ হাসিনার চারপাশে স্লোগান উঠেছিল-
‘পিতৃ হত্যার বদলা নিতে- লক্ষ ভাই বেঁচে আছে;
শেখ হাসিনার ভয় নাই রাজপথ ছাড়ি নাই।’

১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে না দেয়ায় বাড়ির সামনের চত্বরে তিনি মিলাদ পড়তে বাধ্য হন। বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে কুরআন তেলাওয়াত করেন। প্রতিদিনই তিনি রাস্তায় বসে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তাতেও এতটুকু মায়া হয়নি তৎকালীন সামরিক শাসকের মনে, খোলেনি বাড়ির দরজা। জানা যায়, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ঋণে নির্মিত ভবনটির ওই সময়ের প্রায় ১২ হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় বাড়িটি নিলামে চড়ানো হয়েছিল! অতপর ১৯৮১ সালের ১২ জুন বাড়িটি বুঝে নেয়ার পর দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘোষণা করেছিলেন, ঐতিহাসিক এই বাড়িটি হবে জনগণের। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে শুভ উদ্বোধন করা হয়। ৩২ নম্বরের বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি দেখাশোনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি ছিল রবিবার, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দের ৩ জ্যৈষ্ঠ। সেদিন আকাশে ছিল কালো মেঘ, মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। দমকা ঝোড়ো হাওয়া বিরতিহীন বৃষ্টি সেদিন যেন জাতির পিতা হত্যার জমাটবাঁধা কালো পাপ আর কলঙ্কের দাগ ধুয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরছেন- এ বিষয়ক সংবাদ বেশ কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় ঘটা করে প্রকাশ পেতে থাকে। সংবাদটি প্রকাশের পর থেকেই তাকে একনজর দেখার জন্য দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বৃষ্টিময় এক বিকালে বিমান থেকে নামেন শেখ হাসিনা। জাতির পিতাবিহীন বাংলাদেশে দীর্ঘ ৬ বছর পর তার পদার্পণ। বাংলার মমতাময়ী প্রকৃতি সেদিন শোকের চাদর গায়ে অশ্রুময় মলিন নয়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানায়। সেদিন পুরো ঢাকা শহর বৃষ্টির ঢলে নয়, মানুষের ঢলে ভেসে উঠেছিল। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে শেখ হাসিনাকে একনজর দেখার জন্য সেদিন কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে লাখ লাখ মানুষের ঢল নামে। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধু ভক্তের অন্তর-ছেঁড়া স্লোগানের মাঝে শেখ হাসিনা খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। হৃদয়ের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘আমার হারাবার কিছু নাই, চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই, আমি কেবল বাঙালি জাতির মুক্তি চাই, আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই।’ তার সে চিৎকার বৃষ্টিময় আকাশে মেঘের গর্জনে প্রকম্পিত হয়ে গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। পাহাড় সমান শোক পরিণত হয় শক্তিতে। শোকে মুহ্যমান বাঙালি জাতি আবারো জেগে ওঠে বঙ্গবন্ধুকন্যার জাদুতে।
’৭৫-এর অব্যবহিত পরে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতে অবস্থান করলেও তিনি জানতেন দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মৃতিতে ধরে রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া রাষ্ট্রটি যে ভয়ংকর দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হচ্ছে এবং পতিত হয়েছে দুঃশাসনের চক্রাবর্তে, সেই জায়গায় তাকেই রুখে দাঁড়াতে হবে এবং সে জন্য স্বদেশ প্রত্যাবর্তনই তার একমাত্র লক্ষ্য। তিনি দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিলেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধা এলো। এমনকি নানা চক্রান্তে জীবননাশের উপক্রমও হলো। এ অবস্থায় তার দেশে ফেরা নিয়ে ১৯৮১ সালের ৫ মে বিখ্যাত নিউজ উইক সাময়িকী এক সাক্ষাৎকারে তাকে বলেছিল, প্রবল স্বৈরাচারী শাসকের বিরোধিতার মুখে আপনার দেশে ফেরা কি ঝুঁকিপুর্ণ হবে না? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সাহসিকতা এবং ঝুঁকি এই দুই-ই জীবনের কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিকল্পহীন শর্ত। প্রকৃতপক্ষে জীবনে ঝুঁকি নিতে না পারলে এবং মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত বঞ্চিত হয়।’
তিনি জানতেন দেশে ফেরা এবং দেশকে নতুন করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় রূপ দেয়া সহজ হবে না। তবু তাকেই তো এ কাজের কঠিন দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ তিনি যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির রক্তের উত্তরাধিকার বহন করছেন। তাকেই তো হতে হবে পিতার মতো অসম সাহসী, দৃঢ় অঙ্গীকারদীপ্ত এবং লক্ষ্যভেদী দেশপ্রেমিক নেতা। তিনি এও জানতেন, দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর মতো তাকেও ভালোবাসে। তিনি শক্ত হাতে নেতৃত্ব দিতে পারলে গোটা দেশবাসী তার পেছনে কাতারবন্দি হবে। সত্যিই হয়েছে তাই। ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি দলের ৩ দিনের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হলে ওই বছরের ১৭ মে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিন তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করলে এতদিনে দেশ পুরোপুরি পাকিস্তানের মতো স্বৈরসামরিক ও ধর্মপ্রবণ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধুকন্যা অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন এবং বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটিয়ে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের ধারায় অভীষ্ট লক্ষ্যে ফিরিয়ে এনেছেন- এ তার এক অনবদ্য গৌরবগাথা।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তার জন্ম। তার জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু কলকাতায় ভারত ভাগের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং লেখাপড়া নিয়ে মহাব্যস্ত। দাদা-দাদির স্নেহ-আশীর্বাদ নিয়ে তার জীবন শুরু হয়। দাদা শেখ লুৎফর রহমান তার নাম রাখেন ‘হাসিনা’। বঙ্গবন্ধু ডাকতেন ‘হাচুমনি’। বঙ্গবন্ধুর সেই আদরের নয়নমনি ছোট্ট ‘হাচুমনি’ একদিন বড় হয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় নেত্রী হয়ে উঠলেন এবং ধীরে ধীরে বিশ্বনেত্রীর মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
নদী-নালা-খাল-বিলের স্রোতের শব্দ এবং সবুজ প্রকৃতির গন্ধ মেখে তার বেড়ে ওঠা। শৈশব কাটে গ্রামে। শিক্ষাজীবন শুরু সেখানেই। মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ছায়াসঙ্গী হয়ে পিতার রাজনৈতিক জীবনকে খুব নিবিড়ভাবে দেখেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত পিতাকে খুব একটা কাছে না পেলেও শৈশব-কৈশোর গ্রামবাংলার ধুলামাটি আর সাধারণ মানুষের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। তাই গ্রামবাংলার সঙ্গে তার নাড়ির টান।
শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এরপর তিনি ঢাকা শহরে টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দিরে ভর্তি হন। বর্তমানে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শেরেবাংলা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে খ্যাত। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। শেখ হাসিনা ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে গভ. ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ওই বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
স্কুল জীবনেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ১৯৬২ সালে স্কুলের ছাত্রী হয়েও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে তার নেতৃত্বে মিছিল গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঢাকা গভ. ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে কলেজ ইউনিয়নের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। অতপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হন। ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনা গৃহবন্দি অবস্থায় প্রথম সন্তান ‘জয়’-এর মা হন। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর কন্যাসন্তান পুতুলের জন্ম হয়।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ শেখ হাসিনা ইউরোপ যান। নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থানকালে তিনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর পান। তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ফেরার কোনো পরিবেশ না থাকায় তিনি ইউরোপ ছেড়ে স্বামী-সন্তানসহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। তার স্বামী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়া ৯ মে ২০০৯ তারিখে ইন্তেকাল করেন। রত্নগর্ভা শেখ হাসিনার জ্যেষ্ঠ পুত্র সজীব ওয়াজেদ একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশারদ। তার একমাত্র কন্যা সায়মা ওয়াজেদ একজন মনোবিজ্ঞানী এবং তিনি অটিস্টিক শিশুদের উন্নয়নে কাজ করছেন।
’৭৫-এর পর ভারতে ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে শেখ হাসিনা ’৮১-এর ১৭ মে দেশে ফেরেন আওয়ামী লীগের নতুন নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে। সেদিন থেকে বাংলাদেশ যেন নির্বাসন থেকে অস্তিত্বে ফিরল। ’৯১-এর নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর শেখ হাসিনা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের মনের কথা উচ্চারিত হয়েছিল জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামালের কণ্ঠে। বেগম সুফিয়া কামাল তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘তোমাকে থাকতে হবে এবং বাংলাদেশকে বাঁচাতে হবে’। জনগণের প্রতি সম্মান রেখে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল এবং বাংলাদেশের অর্জন এখন পুরো দুনিয়ার নজরকাড়া। নজর কেড়েছেন তিনিও।
প্রধানমন্ত্রী বাঙালি জাতির কাণ্ডারী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন তার মেধা, সাহস, সম্মোহনী নেতৃত্ব, সৃজনশীলতা, মানবিকতা ও সততার জন্য। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত জ্ঞান আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হচ্ছে- এটা আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। বাঙালি হিসেবে একজন নারী হয়েও বিশ্বে তিনি আমাদের মাথা উঁচু করেছেন, যা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বর্তমান বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক বলা হয় তাকে।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ, যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। তার সাহসী এবং গতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঠামোগত রূপান্তর এবং উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি, সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তি, দীর্ঘদিনের স্থল সীমানাসংক্রান্ত জটিলতার সমাধান, ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে ছিটমহলবাসীর দুর্ভোগ লাঘব করা, আইসিটির ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন ইত্যাদি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যেমন তাকে অবিস্মরণীয় নেতায় পরিণত করেছে, ঠিক তেমনি বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আচরণ ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণ বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতির বিশ্লেষকদের কাছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাদীপ্ত করে তুলেছে।
স্বাস্থ্য খাতে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে (১৬১ জন প্রতি লাখে)। শিশু মৃত্যুহার কমেছে (২১ জন প্রতি হাজারে)। বিপুল জনগোষ্ঠী ও সীমিত সম্পদ নিয়ে এ অর্জন যে প্রশংসনীয় ব্যাপার, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবাই স্বীকার করেন। স্বাস্থ্য খাতের এই অসাধারণ অর্জনের জন্য ৩টি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, এমডিজি অ্যাওয়ার্ড এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য খাতে অন্যতম পদক্ষেপ হলো কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে এই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পটি শেখ হাসিনা সরকার গ্রহণ করে এবং প্রায় ১০,৭২৩টি ক্লিনিক স্থাপন করেছিল। ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৪,৯৮৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইন জরিপ এবং বিবিএসের তথ্য অনুসারে কমিউনিটি ক্লিনিকের ৯০ শতাংশের বেশি গ্রাহক তাদের পরিষেবার ক্ষেত্রে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। দেশের মধ্যে জনপ্রিয়তা ছাড়াও ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রধানমন্ত্রীর এই যুগান্তকারী উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। ‘কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা : সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি’ শিরোনামের ঐতিহাসিক রেজুলেশনটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে¦ বাংলাদেশ কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃক প্রস্তাবিত রেজুলেশনটিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগের ব্যাপক স্বীকৃতি দিয়ে এই উদ্যোগকে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করে। এটি জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবায় সাম্য আনয়নে বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিশ্রæতিকে প্রতিফলিত করে।
উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধা। বর্তমানে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৬৪,৫৪৬; যা ২০০৬ সালের তৎকালীন সরকারের আমল থেকে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সারাদেশে স্থাপন করা হয়েছে হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, নিউরো, চক্ষু, বার্ন, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। অব্যাহত নার্সের চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট। বর্তমানে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭টি (২০০৬ সালে যার সংখ্যা ছিল ১২টি), বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৭১টি (২০০৬ সালে ছিল ২৪টি)। বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করার কাজ চলছে।
দেশে বর্তমানে বিশেষায়িত হাসপাতালের সংখ্যা ১৫টি (২০০৬ সালে ছিল ৮টি), উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালের সংখ্যা ৪৩১টি (২০০৬ সালে ছিল ২০৮টি)। দেশে সরকারি ডাক্তারের সংখ্যা ৩০,১৫২ জন (২০০৬ সালে ছিল ৯,৩৩৮ জন), সরকারি নার্সের সংখ্যা ৪০,০১৫ জন (২০০৬ সালে ছিল ১৩,৬০২ জন), মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংখ্যা ৫,৬৬৬ জন (২০০৬ সালে ছিল ১,৯৮৮ জন)। বর্তমানে দেশে নার্সিং কলেজ অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৯৯টি (২০০৬ সালে ছিল ৩১টি)।
শিশুদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রায় বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের উন্নয়ন স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করছে প্রতিনিয়ত। সব হাসপাতালে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ই-গভর্ন্যান্স ও ই-টেন্ডারিং চালু করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলমান। গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অনলাইন সেবা কার্যক্রম চালু করতে ‘ভিশন সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যুরোধে এখন পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিনামূল্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে, যা দেশের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হবে।
কোভিড-১৯ মহামারি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন-জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃতে¦ বাংলাদেশ এ অবস্থা সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। জাপানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘নিকেই-এশিয়া’ প্রকাশিত ‘নিকেই কোভিড-১৯ রিকোভারি সূচক’র তথ্যমতে করোনা মহামারি সামলে ওঠার ক্ষেত্রে বিশ্বের যে দেশগুলো সবচেয়ে ভালো করেছে, সেই তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও সময়োপযোগী হস্তক্ষেপের ফলেই এ সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। এ মহামারির সময়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ছিল ইতিবাচক।
দুই বছর আগেই আমরা মুজিব জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে চিকিৎসা চাহিদা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকসমূহের ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে বহুদূর।
প্রধানমন্ত্রী দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছানোর পাশাপাশি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। খাদ্য ঘাটতির দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। দেশে বর্তমানে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ (২০০৬ সালে যা ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ)। মাথাপিছু আয় বর্তমানে ২৭৯৩ মার্কিন ডলার, যা ২০০৬ সালের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বেশি। দারিদ্র্যের হার কমে বর্তমানে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ (২০০৬ সালে যা ছিল ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ)। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট, যা ২০০৬ সালের তুলনায় ৮ গুণ বেশি। দেশের সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ (২০০৬ সালে যা ছিল ৪৫ শতাংশ)। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৭৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন (২০০৬ সালে যা ছিল শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী)। দেশের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। দেশের রিজার্ভকে সর্বকালের রিজার্ভে উন্নত করে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব অনন্য ও অতুলনীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে নানা চড়াই-উতরাই ও স্বজন হারানোর বেদনার দীর্ঘ সংগ্রামের সাহসী জীবন।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানোসহ কমপক্ষে ২০ বার তাকে হত্যা করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করবেন বলেই হয়তো মহান আল্লাহ তায়ালা শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র এখনো তার পিছু ছাড়েনি। অদম্য সাহস, দৃঢ় মনোবল, সততা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, প্রজ্ঞা ও দক্ষতার বলেই তিনি আজ সফল রাষ্ট্রনায়ক থেকে হয়েছেন বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা।
ব্যক্তি জীবনে আমি খুব সৌভাগ্যবান! কারণ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী খুব সহজ নিরাভরণ জীবনযাপন করেন। সাধারণ খাবার খান। নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন তিনি। ভোরে কুরআন তেলাওয়াত করা তার প্রাত্যহিক রুটিন। তিনি নিজে ধর্মের অনুশাসন মানেন, ধর্মীয় বিধান পালন করেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ এমন বাংলাদেশ চান, যেখানে অসাম্প্রদায়িকতার বন্ধনে জীবনের জয়গান গাইবে মানুষ। গণমানুষের প্রতি তার ভালোবাসা অপরিসীম। একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘গ্রামে গিয়ে গরিব মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিও। সেবা দিলে সাধারণ মানুষের উপকার হবে।’ তারপর থেকে প্রতি শুক্রবার নিজ জন্মভূমি গফরগাঁওয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষের জন্য কাজ করা- এসব কিছু নতুন করে শিখেছি তার কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর মতোই তার ব্যক্তিত্বে ধারণ করেন দুস্থ মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা। ‘মানবতার জননী’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক গুণাবলি পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে তার পিতার কাছ থেকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারই একটি মানবিক দৃষ্টিসম্পন্ন পরিবার, যারা সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন এ জাতিকে। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, অসহায়ের প্রতি সংবেদনশীলতা বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঐতিহ্য।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে সাধারণ মানুষের আবেদনগুলো পড়ার সৌভাগ্য মাঝেমধ্যেই হয়। সেগুলো সুপারিশ আকারে তার কাছে পাঠালে তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক সহায়তা অনুমোদন করেন। ছোট ছোট বিষয়ও তার দৃষ্টির বাইরে থাকে না। বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত দরিদ্র মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী সমীপে আবেদন করলেই তিনি সাড়া দেন। অনেক ভাগ্যহত মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল তিনি অকাতরে সাহায্য করেন। দলমত, ধর্ম-বর্ণ কোনোকিছু বাছ-বিচার না করে তিনি সহায়তা দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কোনোদিন তার কাছ থেকে খালি হাতে ফেরেনি। একবার এক স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। চলচ্চিত্র পরিচালকের সন্তানরা এলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে, চাইলেন আর্থিক সহায়তা। তিনি কোন দলের সমর্থক তা চিন্তা না করেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলেন প্রধানমন্ত্রী। এমনই মানবিক আমাদের প্রধানমন্ত্রী। পত্রিকা মারফত খোঁজ পেলেন বিখ্যাত সুরকার, গীতিকার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল অসুস্থ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক ডা. জুলফিকার লেলিন ভাইকে বললেন, ‘তার কাছে যাও। সে খুব অভিমানী। তার চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা নেবা। টাকা পয়সার চিন্তা করতে বুলবুলকে নিষেধ করবা।’ সেই সুবাধে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের আফতাব নগরের বাসায় কয়েকবার গিয়েছিলাম লেলিন ভাইয়ের সঙ্গে। তার চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন প্রধানমন্ত্রী। এমনই মাতৃত্ববোধ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর। কাঙালিনী সুফিয়া অসুস্থ। ভর্তি আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। খবর পেলেন প্রধানমন্ত্রী। দায়িত্ব নিলেন এবং লেলিন ভাইকে বললেন খোঁজ নিতে। আবারো লেলিন ভাইয়ের সঙ্গী হয়ে গেলাম বিএসএমএমইউতে। প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা হলো কাঙালিনী সুফিয়াকে। আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্না শুরু করলেন সুফিয়া। অসুস্থ শরীর নিয়ে ধরলেন গান! প্রধানমন্ত্রীকে নিবেদন করে গাওয়া সেই গানের সুর আজো আমার কানে বেজে ওঠে, হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দেয়। প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় সুস্থ হয়ে ওঠেন কাঙালিনী সুফিয়া। ফিরে আসেন আবারো সংগীত ভুবনে। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে, যা প্রধানমন্ত্রীর মানবিক গুণাবলিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। জাতির পিতার কন্যা হিসেবে তিনি সাধারণ মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন নিরলসভাবে। শেখ হাসিনা কেবল একজন রাষ্ট্রনায়ক কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী নন, তিনি বাংলার মানুষের কাছে একটি অনুভূতির নাম।
একটি কথা বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচলিত। সবাই বলে এবং বিশ্বাস করে বাংলাদেশে সবকিছু কেনা যায় শুধু শেখ হাসিনাকে ছাড়া। কথাটির যৌক্তিকতা খুঁজে পাই সাবেক সচিব এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সম্মানিত কিউরেটর মো. নজরুল ইসলাম স্যারের স্মৃতিচারণায়। ঘটনাটি সুধা সদনের। প্রধানমন্ত্রী তখন সবে বিরোধীদলীয় নেত্রী। একটি প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূত এসেছেন দেখা করতে। কথোপকথনের মাঝে খনি বিষয়ের কথা এসে গেল। রাষ্ট্রদূত যা বললেন তার অর্থ হলো যদি খনির ব্যাপারে সায় না দেন, তবে ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। শেখ হাসিনা যা বললেন তার বাংলা অর্থ- ‘আমার বাপ বেইমানি করে যাননি, আমিও বেইমানি করতে পারব না’। এই কথা বলে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন আর ফিরলেন না। ওই রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আর কখনোই দেখা করেননি। এমনকি রাষ্ট্রদূতের বিদায়ী সাক্ষাৎকারেও না। সততার এমন পরাকাষ্ঠা আমাদের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম আর সততার আদলে গড়ে ওঠা আমাদের প্রধানমন্ত্রী। দেশের জনগণকে ভালোবাসা তিনি শিখেছেন তার পিতার কাছ থেকে। প্রধানমন্ত্রীর কথায় এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) নেই। কিন্তু আমি তো আছি। যে দেশের জন্য, যে জাতির জন্য ৫৪ বছরের ২৫টি বছর তিনি অন্ধ কারাকক্ষের কড়িকাঠ গুনে গুনে অতিক্রম করে গেছেন প্রচণ্ড যৌবন কারাগারের উঁচু প্রাচীরের সীমানার মধ্যে। ফাঁসির রুজ্জুকে যিনি উন্নত মস্তকে ধারণ করতে এগিয়ে গেছেন বহুবার, শুধু এই জাতির জন্য। এ দেশের মানুষের জন্য! সেই মহান মানুষের ভালোবাসার জাতি আর মানুষই আমার কাছে তার বড় আমানত। আর সেই আমানতকে শিরোধার্য করেই আমি জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত থাকতে চাই সোচ্চার, এ দেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে, তাদের স্বার্থের প্রশ্নে।’
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর নেয়া পদক্ষেপ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট যখন রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল, ঠিক তখনই শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষায় সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের ১৬ কোটি মানুষকে যদি খাওয়াতে পারি, তাহলে এদেরও খাওয়াতে পারব।’ তাই তো আজ বিশ্ব বিবেক শেখ হাসিনাকে বলে ‘মানবতার জননী, স্টার অব দ্য ইস্ট’। তিনি এখন বিশ্বনেত্রী। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিত। দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যেতে ইতোমধ্যে তিনি ‘রূপকল্প ২০৪১’ ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ড. কিসিঞ্জার বলেছিলেন, দেশটি তলাবিহীন ঝুড়ি হবে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জাতীয় গড় প্রবৃদ্ধি সাতের ওপর হয়ে যাওয়ায় ড. হেনরি কিসিঞ্জার হয়তো লজ্জা পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর, ’৭৬-এ দুজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ জায়াস্ট ফারল্যান্ড ও জে আর পার্কিনসন বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনটি তির্যক মন্তব্য করেছিলেন-
এক. বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বের কঠিনতম সমস্যা।
দুই. বাংলাদেশের উন্নয়ন হলে সব দেশেরই উন্নয়ন হবে।
তিন. বাংলাদেশের উন্নয়ন হলেও অন্তত ২০০ বছর লাগবে। কিন্তু ২০১৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে তকমা দেয়। শেখ হাসিনা তাই বিশ্বের কাছে ‘রোল মডেল’। শেখ হাসিনা! এখন আর শুধু কোনো নাম নয়- এক বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাহসিকতা, সততা, সৃজনশীলতা, মানবিকতা, আত্মত্যাগ, দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। ১৭ কোটি মানুষ এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তার হাতেই রয়েছে বাঙালি জাতির উন্নয়নের শিখরে পৌঁছার চাবিকাঠি। প্রধানমন্ত্রীর ৭৭তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রধান কাণ্ডারি তিনি। বর্তমানে বাঙালির শেষ আশ্রয়ের নাম শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্মদিনে সর্বান্তকরণে তার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু
জয়তু শেখ হাসিনা।

ডা. মুহাম্মদ সারোয়ার হোসেন : জ্যেষ্ঠ চিকিৎসা কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়