রাজধানীর ওয়ারীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে শ্রমিকের মৃত্যু

আগের সংবাদ

মুখে স্বস্তির ভাব, মনে উদ্বেগ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড়

পরের সংবাদ

ডিভাইস আসক্তি দূরীকরণের বিকল্প উদ্যোগ হোক বই পড়া

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান সময়ের একটা আলোচিত ইস্যু হলো শিশুদের ডিভাইস আসক্তি। এ নিয়ে অভিভাবক সমাজ, সচেতনমহল খুবই উদ্বিগ্ন। সবার মধ্যে এক ধরনের গেল গেল চিৎকার। এ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা চলছে। এ ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই। আরো হতে পারে আলোচনা, গবেষণা। ডিভাইস আসক্তি থেকে শিশুদের মুক্ত করতে নানা রকমের পরামর্শও দিচ্ছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এসব পড়তে-পড়তে আর শুনতে-শুনতে আমার মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে- শুধু কি শিশুরাই এখন ডিভাইস আসক্তিতে ভুগছে? আমরা যারা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি, তারা কি নয়? তারা কি সত্যিকারার্থে এই আসক্তি থেকে দূরে আছি। পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বরাও যদি আসক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই কেন? যারা পরিণত প্রজন্মের তাদের আসক্তিও এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে আমি বিগত কিছুদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রশিক্ষণ, কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। এ সময় দেখেছি অংশগ্রহণকারীদের ডিভাইস থেকে বিরত রাখতে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হচ্ছে। এমনকি কটু কথা বলতেও দেখেছি প্রশিক্ষকদের। অংশগ্রহণকারীরা সবাই ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। কিংবা মানুষ গড়ার কারিগরদের তত্ত্বাবধায়ক। ক্রমাগতভাবে এমন পরিস্থিতি দেখতে দেখতে নিজের মনের মধ্যে উল্লেখিত প্রশ্নের উদয় হয়েছে, শুধু কি শিশুরাই এখন ডিভাইস আসক্তিতে ভুগছে? আমরা যারা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি, তারা কি নয়? প্রযুক্তি পরিচর্যা সংস্থা অ্যাসুরিয়ন পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ‘অংশগ্রহণকারীরা দিনে গড়ে ৯৬ বার তাদের ফোন চেক করেন, যা প্রতি ১০ মিনিটে একবার।’ (দ্য ডেইলি স্টার : বাংলা, ৩ আগস্ট ২০২২)। তবে আমার পর্যবেক্ষণ বলছে, এটা আরো বেশি। একটানা ইউটিউব কিংবা ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও। শিক্ষা তাদের পেশা হলেও শিক্ষাগত আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ অনেক কিংবা আগ্রহ অনেক কম।
আমরা সমালোচনার ঝড় তুলছি ঠিকই, কিন্তু বিকল্প উদ্যোগ তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ডিভাইস আসক্তি থেকে বের করে আনতে যে সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন, তা করা হচ্ছে না। কারণ আমরা যারা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি, তারা সে উদ্যোগের অংশীজন হচ্ছি না। বই পড়া হতে পারে সে বিকল্প উদ্যোগের একটি। কিন্তু আমরা যারা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করি, তারা কি বই পড়ি। গাইড বই ছাড়া অন্য কোনো বই শিক্ষকদের হাতে দেখা যায় না। একই কথা অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যাই বলি না কেন, কারো হাতে বই দেখা যায় না। তাহলে শিশুদের হাতে বই দেখা যাবে কী করে? এ জন্য আমরা সমকালের প্রযুক্তি বিপ্লবকে দায়ী করছি। প্রকৃতপক্ষে প্রযুক্তি এর জন্য দায়ী হতে পারে না। তাহলে করোনাকালে ইউরোপে মুদ্রিত বই বিক্রি বাড়ত না।
‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী পাবলিশার্স উইকলিতে চলতি বছরের (২০২২ সালের) জানুয়ারি মাসে এ বিষয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিতে ছাপা বইয়ের বিক্রির হার বেড়েছে। নিয়েলসেন বুকস্ক্যানের তথ্য উদ্ধৃত করে পাবলিশার্স উইকলি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর যুক্তরাজ্যে বই বিক্রি ৩ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় ২১২ মিলিয়নেরও বেশি ছাপা বই বিক্রি হয়েছে এবং মোট বিক্রির পরিমাণ ১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন পাউন্ড, যা বুকস্ক্যানের মাধ্যমে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান। ফ্রান্সের পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিন্ডিকেট ন্যাশনাল দে এল এডিশন, এসএনই) সভাপতি ভিনসেন্ট মন্টেন বলেছেন, বই বিক্রি থেকে আয় ২০২০ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ এবং ২০১৯ সালের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
এসব দেশেও বই বিক্রি এমনি এমনি বাড়েনি। ফ্রান্স সরকার বেশ কয়েকটি প্রশংসনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করাতে এ সুফল পাওয়া গেছে। ‘পাবলিশার্স উইকলি বলছে, ২০২১ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত বেশ কয়েকটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে ফরাসি বই বিক্রেতাদের সহায়তা করা হয়। যেমন- বই পড়া এবং সংস্কৃতি সচেতনতা বাড়াতে প্রচারাভিযান চালানো। এর মধ্যে আছে সারাদেশে ১৮ বছর বয়সিদের সাংস্কৃতিক পণ্য কিনতে ৩০০ ইউরো সহায়তা এবং সেগুলোর মধ্যে বই অন্যতম। এর ফলে প্রায় ৩ হাজার অংশগ্রহণকারী বইয়ের দোকানে প্রায় ৪ লাখ ২৬ হাজার বই বিক্রি হয়। এই কার্যক্রম ২০২২ সালে ১৫-১৭ বছর বয়সিদের জন্য প্রসারিত করা হচ্ছে, যা প্রকাশনা শিল্পকে আরো এগিয়ে নেবে। জার্মান প্রকাশকরা বলছেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সামগ্রিকভাবে প্রায় ৩ শতাংশ এবং ২০১৯ সালের তুলনায় এক শতাংশ বই বিক্রি বেড়েছে। মিডিয়া কন্ট্রোলের ২০২১ সালের বাজার প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে পাবলিশার্স উইকলি।’ এসব উন্নত দেশে পাঠক সংখ্যা বাড়তে পারে এবং পাঠক বাড়ানোর জন্য সরকারি কর্মসূচি থাকতে পারে, তবে আমাদের দেশে নয় কেন?
পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধি হোক কিংবা শিশু হোক, এদের ডিভাইস আসক্তি কমাতে হলে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। এ অভ্যাস গড়ে তুলতে হলে, যারা এ অভ্যাস গড়ার কাজ করবেন, তাদের আগে অভ্যস্থ হতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে বই পড়ার মাধ্যমে মেধা ও মননের বিকাশ ঘটে। জ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত হয়। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে যেসব বই দেয়া হচ্ছে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকের বা শিক্ষকদের রুমে শোভা পায়। শিক্ষার্থী পর্যন্ত এখনো পৌঁছাচ্ছে না। ফলে বই প্রদানের কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বেশিসংখ্যক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানেও না, তাদের পড়ার জন্য কোন ধরনের বই আছে। বুক কর্নারের কোনো নীতিমালা আছে বলে মনে হয় না। নীতিমালা যদি থেকেও থাকে এর কোনো প্রতিফলন স্কুল পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয় না। বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বই পড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট হতে পারে। শিশুদের বই পড়ায় উৎসাহী করে তুলতে শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা কার্যক্রমের পাশাপাশি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ‘পড়ালেখা প্রতিযোগিতা’সহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। এর মাধ্যমে শিশুরা আরো বেশি বই পড়ায় উৎসাহী হয়ে উঠবে। তাদের স্বাধীন পাঠক হিসেবে গড়ে তোলার পথ সুগম হবে। পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই, আমাদের সন্তানরা বই পড়ায় অনেক বেশি সময় ব্যয় করুক। পড়া কার্যক্রমে শিশুদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হলে শিশুদের পড়ার দক্ষতা ও আনন্দের সঙ্গে পড়তে পারা উদযাপন করতে হবে এবং তা অভিভাবক ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে অবহিত করতে হবে। শিশুদের স্বাধীন পাঠক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষক-অভিভাবকের ভূমিকাকেও উৎসাহিত করতে হবে।

কুমার প্রীতীশ বল : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়