সম্পাদক পরিষদ : সাংবাদিক নির্যাতনের হাতিয়ার সাইবার নিরাপত্তা আইন

আগের সংবাদ

বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র : সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পরের সংবাদ

দাম চড়া, সরবরাহেও টান : কয়েকটি পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও তা কার্যকর হয়নি, আরো ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে এক সপ্তাহ আগে কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলো বাজারে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ গতকাল বৃহস্পতিবারও দেখা গেছে- খুচরা পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামে ডিম, আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে না। বিপরীতে আলুর বাজারে সরবরাহ কম, অভিযানের আতঙ্ক ও লোকসানের ভয়ে নতুন করে দোকানে আলু ও পেঁয়াজ তুলতে চাইছেন না বলে জানিয়েছেন খুচরা বিক্রেতারা। এছাড়া অনেক আগেই নির্ধারণ করে দেয়া দামের ধারেকাছে নেই ভোজ্যতেল ও চিনি।
দাম কার্যকর না হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন- বড় কোম্পানি, উৎপাদক অথবা আমদানি পর্যায়ে দর কার্যকর করতে না পারা; পাইকারি বাজার ও খুচরা পর্যায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি না থাকা; চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা এবং পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তদারকি না করা। অর্থনীতিবিদদের মতে, পাইকারি বাজারে দাম না কমার পাশাপাশি বাজারে সরবরাহ না বাড়ায় পণ্যগুলোর দাম কমছে না। তাদের মতে, শুধু অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। অর্থনীতিবিদদের মতে, যারা ভ্যালু চেইনে আছেন, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
এদিকে বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে আরো ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হায়দার আলী জানান, নতুন করে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে এক কোটি করে ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। ডিম আমদানির অনুমতি পাওয়া নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- চিস গ্যালারি, পপুলার ট্রেড সিন্ডিকেট, মেসার্স রিপা এন্টারপ্রাইজ, এস এম করপোরেশন, বিডিএস করপোরেশন ও মেসার্স জুনুর ট্রেডার্স। এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর চার প্রতিষ্ঠানকে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়।
গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে

মুজেরী বলেন, পণ্যের দাম সরকারের নির্ধারণ করে দেয়া উচিত নয়; বরং পণ্যের সরবরাহসংক্রান্ত বাধাগুলো দূর করতে হবে; যাতে বাজার নিজস্ব গতিতে চলতে পারে। কোনো বিশেষ গোষ্ঠী যেন বাজারকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, বাজার অর্থনীতিতে সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলে তা সাধারণত কার্যকর হয় না। তাছাড়া চাহিদা ও সরবরাহভিত্তিক দাম নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি সমস্যা সৃষ্টি করে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। তাই ডলারের বিপরীতে টাকার উল্লেখযোগ্য অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যদি টাকার দাম আরো কমে যায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। তিনি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচককে শক্তিশালী করতে সহায়ক নীতি গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ড. মুজেরী আরো বলেন, শুধু চাহিদার কারণেই দাম বাড়ে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয় মূলত সরবরাহে বাধার কারণে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ায়। বাজারের এ দুর্বলতা দূর করতে হবে।
খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর সরকার ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেয়। এ ঘোষণার পর থেকেই সরকারি সংস্থাগুলো অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে একটি ডিম খুচরা ১৫ টাকায় বিক্রি হওয়ায় সরকার তা ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। গত মাসে ভারত পেঁয়াজের ওপর ৪০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর সরকার প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। প্রতি কেজি আলুর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫-৩৬ টাকা। রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট বাজারের খুচরা বিক্রেতা ইয়াজ উদ্দিন জানান, তিনি প্রতি ডজন ডিমের সাইজ অনুযায়ী ১৫০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। এছাড়া প্রতি কেজি আলু ৫০ টাকা ও দেশি পেঁয়াজ ৮৫ টাকায় বিক্রি করছেন। তিনি আরো জানান, তিনি ৪৩ টাকা কেজি দরে আলু, ৭২ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ ও ১৪৪ টাকায় এক ডজন ডিম কিনেছেন। ইয়াজউদ্দিন বলেন, সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেই হবে না। আমি বেশি দামে পণ্য কিনেছি, তাই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারছি না।
তবে রাজধানীর কমলাপুর বাজাররোড এলাকার ডিমের পাইকারি বিক্রেতা সালাম সিকদার বলেন, সরকার ভারত থেকে ডিম আমদানির ঘোষণা দেয়ার পর থেকে বাজারে ডিমের দাম কমতে শুরু করেছে। তিনি জানান, গত বুধবার তিনি ১০০ ডিম ১ হাজার ১৬০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এক সপ্তাহ আগেও একইসংখ্যক ডিমের দাম ছিল এক হাজার ১৮০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। তিনি মনে করেন, সরকারের বর্তমান উদ্যোগগুলো স্বল্পমেয়াদে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে তা কার্যকর নয়।
রাজধানীর শ্যামবাজারে পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মাজেদ বলেন, পেঁয়াজের মতো পচনশীল পণ্যের দাম নির্ধারণ করে কতটুকু সাফল্য অর্জন করা যাবে তা বলতে পারছি না।
তবে বাজারে এসব পণ্যের দাম কমেছে বলে দাবি করেছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার তদারকি করছি। দেশব্যাপী অভিযান চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকায় চলে এসেছে। এছাড়া আলুর দামও কমেছে। বেশির ভাগ বাজারে দাম কমেনি জানালে তিনি বলেন, ফরমাল বাজারগুলোতে কমেছে। তবে গলির ভেতরের দোকানগুলো তদারকি করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, আলুর দাম ৫-৬ টাকা কমে এসেছে। আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যেই আলু ৪০ টাকার নিচে চলে আসবে। মুন্সীগঞ্জে মাইকিং করে ৩৫-৩৬ টাকা দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। শফিকুজ্জামান আরো বলেন, ভোক্তা অধিকারের প্রতিটি কর্মকর্তা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাজার স্বাভাবিক করতে। কৃষি বিপননের কাজ এটা। তারা কতটুকু মনিটরিং করছে সে বিষয়েও জানতে হবে।
বাজারে পণ্যের বাড়তি দামের বিষয়ে কথা হয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) এবং পরিচালক, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড উইং ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হকের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বাজারে সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে। এর মধ্যে ডিম সবার প্রিয় বলে এর প্রতি নজর বেশি। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন খরা ছিল, এখন বর্ষা চলছে। নিয়ম অনুযায়ী, নতুন সবজি বাজারে চলে আসার কথা। কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ আচরণের প্রভাবে বাজারে সবজি নেই। এক কেজি করলার দাম ১২০ টাকা। সুতরাং কোনটার দামই কম নেই। তিনি আরো বলেন, এ পরিস্থিতি একেবারেই সাময়িক। এখান থেকে লুট করছে বা কারসাজি করছে- বিষয়টি এমন নয়। খুব শিগগিরই এটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তার মতে, কারসাজি নয়, বাজারে কিছুটা হিড়িক বা অস্থিরতা আছে। তিনি বলেন, আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত তদারকি ততো দুর্বল নয় যে, কারসাজি করে পার পেয়ে যাবে। এ কর্মকর্তা বলেন, বাজারের ওপর জবরদস্তি চলে না, তবে নিয়ন্ত্রণ চলে। সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়া ডিম, আলু, পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য। সুতরাং কারসাজির সুযোগ নেই; বরং যারা ব্যবসা করছে তাদের প্রতি ইনজাস্টিস হচ্ছে কিনা সেগুলোও দেখার বিষয়। করপোরেটদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা বেশি টাকা ইনভেস্ট করেছে। তারা ব্যবসার জন্য এসেছে। তাদের কথায় কথায় হেয় করব, তা হবে না। আমরা তাদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করছি। তারাও জবাবদিহি করছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান : গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ৫৮টি বাজারে ১০৮টি প্রতিষ্ঠানকে এ জরিমানা করা হয়। ভোক্তা অধিদপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ঢাকা মহানগরসহ দেশের সব বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ৩টি টিম বাজার অভিযান পরিচালনা করে। এছাড়া অন্যান্য বিভাগীয় শহরসহ দেশের সর্বমোট ৪২টি জেলায় একযোগে এ অভিযান পরিচালিত হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়