গ্রেপ্তার ৩ : মাদকের টাকা যোগাড় করতে চুরি

আগের সংবাদ

সাহারার সেকাল একাল

পরের সংবাদ

ডলারের সংকট না কাটলে জীবনযাত্রায় স্বস্তি আসবে না

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নিষ্পেষিত। গড়পড়তায় মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ অতিক্রম করেছে, যা মোটেও কাক্সিক্ষত নয়। বছর দেড়েকের অধিক সময় ধরে মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জুঝছে। সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নেই, অবসরভোগীদের অবস্থাও খারাপ। বলতে গেলে দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর সর্বাংশ তীব্র অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা করছে। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা অনেকের। করোনা ভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র মূল্যস্ফীতি হানা দেয়। পাশের দেশ ভারতসহ অনেক দেশ এরই মধ্যে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমরা পারছি না। পাগলা ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। নীতি প্রণেতাদের এ নিয়ে খুব জোরদার প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। অর্থনীতিবিদদের দাবি সত্ত্বেও সময়মতো আর্থিক ও রাজস্ব নীতির সঠিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়নি। ফলে অবস্থা গুরুতর হয়েছে, নিষ্কৃতি মেলেনি।
বড় সমস্যা এখন পুষ্টির জোগান নিয়ে। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ পুষ্টির উৎস। আকাশছোঁয়া দামের কারণে এসব পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে। মাংস ও ডিমের দাম আকাশচুম্বী। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে খামারিদের স্বার্থ রক্ষা কিংবা সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। সিন্ডিকেটের দোহাই যখন সরকারের খোদ মন্ত্রীরা দেন, তখন লজ্জায় মাথা নত করা ছাড়া উপায় থাকে না। সিন্ডিকেট দমনের ক্ষেত্রে সরকারের হাত এত দুর্বল, ভাবতেও অবাক লাগে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থাকার তাহলে কী মানে? খামারিদের সুরক্ষা সবাই চায়, তবে সব দায় ভোক্তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নয়, সরকারকেও দায়ভারের অংশীদার হতে হবে। ভাদ্র-আশ্বিন মাস মাছের মৌসুম। এই মৌসুমে গ্রামাঞ্চলেও মাছ মিলছে না, অল্পস্বল্প যা মিলে তার দাম অত্যাধিক, গরিব মানুষের সাধ্যে কুলানোর মতো নয়। ইলিশেরও মৌসুম এ সময়ে, বাজারে তার দেখা মিললেও দাম রেকর্ড ভঙ্গ করছে। নিম্নবিত্তের মানুষতো বটেই, মধ্যবিত্তেরও এই দামে তা কেনার সাধ্য নেই।
পোলট্রিসহ গবাদি পশুর খামার যারা করেছেন, তাদের এ মুহূর্তে প্রধান সমস্যা খাদ্যের (পশু খাদ্য) অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। আমদানি করা খাদ্যের ওপর নির্ভর করে খামারিরা খামার চালান। স্থানীয়ভাবে খাদ্য সংগ্রহের সুযোগ নেই। নেই দেশে চারণভূমিও। আমদানিকৃত খাদ্যের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় তাদের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে, স্বভাবতই দাম বাড়ছে উৎপাদিত পণ্যের। সরকারি সহায়তা ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না। সেই সহায়তার স্বরূপ হতে পারে গবাদি পশুর খাদ্য উপকরণের আমদানি নিষ্কণ্টক করা, প্রয়োজনে ভর্তুকি প্রদান ও করছাড়। পাশাপাশি নজরদারি জোরদার করা, যাতে সিন্ডিকেট গড়ার সুযোগ না থাকে। মনে রাখা দরকার, পুষ্টির জোগান সাধ্যাতীত হলে গড় আয়ু বৃদ্ধির তিলক খসে পড়তে সময় লাগবে না।
বস্তুত টাকার বিপরীতে ডলারের মান বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে প্রায় সর্বত্র। আমাদের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের অধিকাংশ কোনো না কোনোভাবে আমদানির সঙ্গে যুক্ত। শিল্পের মেশিনারি-কাঁচামাল থেকে শুরু করে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের উপকরণাদির প্রায় সবই বিদেশ থেকে আনতে হয়। তাতে আগের তুলনায় খরচ পড়ছে বেশি। স্বভাবতই এর প্রভাব পড়েছে বাজারে, দ্রব্যাদির মূল্য বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানিও অবাধ হচ্ছে না, যার দরুণ সরবরাহ বিঘিœত হয়ে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই মূল্যস্তর ঊর্ধ্বমুখী থাকছে। সরকারি সহায়তা ছাড়া এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় নেই।

দুই
মোটাদাগে বলতে গেলে দেশের অর্থনীতি বিপাকে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের সংকট। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশে ডলারের মজুত পর্যাপ্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। ছিলও পর্যাপ্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ধস নামে রিজার্ভে। আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তির প্রাপ্তি, শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ধার ফেরত পাওয়া ও আমদানি ব্যয় কমিয়েও রিজার্ভের নিম্নমুখী প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না। সমস্যা হলো, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত সীমিত। পোশাকশিল্পের রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের ওপর নির্ভরশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বিগত বছরের এই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেলেও প্রবাসী আয় কমেছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত বছর (আগস্ট-২০২২) প্রবাসী আয় যেখানে ছিল ২০৪ কোটি মার্কিন ডলার। এ বছরের আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি ডলার। আগের চেয়ে সম্প্রতি ঋণপত্র খোলা বেড়েছে, ফলে আমদানি দায় মেটাতে ভবিষ্যতে আরো বেশি ডলারের প্রয়োজন হবে। আবার সামনে সরকারি-বেসরকারি ঋণ পরিশোধও বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে রিজার্ভের নিম্নগতি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও প্রবাসী আয় সেই তুলনায় বাড়ছে না। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে থাকা পুরনো কর্মীদের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন লাখো কর্মী। গত ১ বছর ৯ মাসে গড়ে প্রতি মাসে লক্ষাধিক কর্মী গেছেন বিদেশে। এর মধ্যে শুধু মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারেই রেকর্ড ৩ লাখ কর্মী গেছেন গত ১ বছরে। অথচ প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) তেমন বাড়ছে না।
হুন্ডির প্রকোপ বৃদ্ধি এর মূল কারণ বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান। গত আগস্ট মাসে ব্যাংকের মাধ্যমে আসা প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা প্রদান করা হয়েছে। আড়াই শতাংশ সরকারি প্রণোদনা ধরলে হিসাব দাঁড়ায় ১১১ টাকা ৭২ পয়সা। বাজারসংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ সময় হুন্ডিতে ডলারপ্রতি দাম ধরা হয়েছে ১১৭-১১৮ টাকা। (সূত্র : প্রথম আলো, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩) দুইয়ের মধ্যে এত ফারাক থাকলে হুন্ডি রোধ করা সত্যিই কঠিন। বিশ্লেষকদের অনেকেই তাই দাবি তুলছেন ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার। সরকার এখনো সে পথে যাচ্ছে না বোধ করি এই ভেবে, তাতে ডলার আরো শক্তিশালী হয়ে পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়াবে।
হুন্ডির এই দাপটে ব্যাংকগুলোও সমস্যায় পড়ছে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ব্যাংকের মাধ্যমে এলে তার একাংশ আমানত হিসেবে ব্যাংকে থেকে যায়, বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ডলারেরও সংস্থান হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকে এর জন্য (ডলার) ধরনা দিতে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকও বাঁচে ব্যাংকগুলোকে প্রতিনিয়ত ডলার সহায়তা প্রদানের ঝক্কি থেকে। আসলে ডলারের সংকট না কাটাতে পারলে জনজীবনে স্বস্তি আসবে না। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলার সাশ্রয়ের পন্থা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে না; এতে রাষ্ট্রের রাজস্ব আয় কমে যাবে, বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশি দান-অনুদান-ঋণ ও রপ্তানি আয় রিজার্ভ বৃদ্ধির সহায়ক; সেদিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। তবে বেশি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন প্রবাসী আয় বৈধ পথে আনার বিষয়ে। প্রবাসীদের পূর্ণাঙ্গ কোনো ডাটাবেজ সরকারের হাতে আছে কিনা, জানা নেই। না থাকলে সেটি করে প্রয়োজনে ঘরে ঘরে গিয়ে উদ্বুদ্ধ করা যায়, যাতে তাদের রেমিট্যান্স বৈধ পথে আসে। পাশাপাশি অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। প্রবাসীরা বাংলাদেশের বড় সম্পদ। বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রবাসযাত্রায় আগ্রহী। তাদের যাত্রা সহজতর করতে পারলে একদিকে বেকারত্ব কমবে, অন্যদিকে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার অর্জন, যা দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়ক হবে।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়