ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ১৫ দিনে মৃত্যু হয়েছে ১৯৭ জনের

আগের সংবাদ

চিকিৎসার নামে লোক ঠকানো : অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান আজ থেকে > অব্যাহত রাখলে জনগণ উপকৃত হবে

পরের সংবাদ

রহস্যময় কালো সাদা মরুভূমি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লেখা ও ছবি : মাকছুমুল হক

মিশরের দর্শনীয় জায়গাগুলোর যখন তালিকা করছিলাম তখন কিভাবে যেন চোখে পড়ে গেল বাহারিয়া মরুদ্যান এর কালো আর সাদা মরুভূমি। রহস্যময় এবং পরাবাস্তব ভূতাত্মিক অবয়ব ছড়ানো এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। খুঁজতে লাগলাম এর বিস্তারিত – কোথায় অবস্থান, কিভাবে যাব, কোথায় থাকা হবে ইত্যাদি। গিজা থেকে রওনা দিলে দূরত্ব দাঁড়ায় পাঁচশত আট কিলোমিটারের মত। তার মানে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা সম্ভব না। রাত্রিযাপনের যে কয়টি অপশন পেলাম তার মধ্যে সবচাইতে আকর্ষণীয় হল মরুভূমিতে তাবু করে থাকা। মিশরে তখন শীত ভালোই জেঁকে বসেছে। হোটেলে রাতে ঘুমাতে পুরু কম্বল গায়ে টানতে হয়। রাতের তাপমাত্রা দশের কাছাকাছি নেমে আসে। মরুভূমিতে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা বলে শেষ রাতে এই তাপমাত্রার ব্যবধান লোকালয়ের চেয়ে চার-পাঁচ ডিগ্রি কম হবে অর্থাৎ ছয় থেকে আটের কাছাকাছি। বাচ্চাদের নিয়ে এই রিস্ক নিব কিনা যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ ট্রিপএডভাইজর সাইটে দুটা স্থানীয় পর্যটন কোম্পানি পাওয়া গেল যারা ওয়েসটার্ন ডেজার্ট ট্যুর আয়োজন করে। যোগাযোগ করে দীর্ঘ আলাপে ভ্রমণ প্ল্যান চূড়ান্ত করে নিলাম।
ভোর ছটায় যাত্রা শুরু, বারোটায় লাঞ্চ ব্রেক। ক্যাম্পসাইটে পৌঁছাতে বিকেল, সন্ধ্যের আগেই ক্যাম্প স্থাপন করে রাত্রিযাপন, পরদিন সকালে ফিরে আসা। সব কাহিনী জেনেশুনে এই মরুভূমিতে রাত কাটানোর জন্য মন মোটেই সায় দিচ্ছিল না কিন্ত ট্যুরের আয়োজক পূর্ণ আস্থা রাখতে বলল এবং জানালো তারা প্রতিদিনই এই রুটে পর্যটনের আয়োজন করছে।
অবশেষে ভোরে উঠে মালপত্র নামিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে হোস্টেল ম্যনেজার থেকে জানতে পারলাম চাইনিজ ৬/৭ জনের আরেকটি পরিবারসহ গ্রুপও আমাদের হোস্টেল থেকে রওনা দিচ্ছে। ওদের গাড়িতে গিয়ে কথাবার্তা বলে পরিচিত হয়ে এলাম। খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তিনটি গাড়ি একসাথে রওনা দিলাম ওয়েস্টার্ন ডেজার্ট মানে কালো-সাদা মরুভূমির পথে। গাড়ি গিজা ছাড়িয়ে শতেক কিলোমিটার পাড়ি দেয়ার পর মোবাইল নেটওয়ার্ক চলে গেল। এ দীর্ঘপথে সময় কাটানোর জন্য নেটওয়ার্ক খুবই জরুরি। উপায়ান্তর না দেখে ড্রাইভারের কাজকর্ম দেখতে লাগলাম। যাহোক, তাকে জিজ্ঞেস করলাম – তোমার ফোন কাজ করছে কীভাবে? উত্তরে জানলাম, তার সার্ভিস প্রোভাইডার আলাদা। ওই নেটওয়ার্ক এ অঞ্চলে কাজ করে। ওর কাজকর্ম দেখতে দেখতে যখন বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম তখন সে এক ফাঁকে সিডি প্লেয়ার চালিয়ে দিল। ইংরেজি র?্যাপ সঙ্গীত। গাড়িতে চলতি পথে শোনার জন্য র‌্যাপ খারাপ না। গান শোনার পাশাপাশি আমি চারপাশ দেখায় মন দিলাম।

দুপুরের খাবার আরবি মেন্যু – সালাদ, রুটি, ডিম-টমেটো আর সবজির ভাজির মত কিছু একটা। এখান থেকে আমাদের দায়িত্ব বুঝে নিল মোহাম্মদ – স্থানীয় ট্যুর গাইড। চমৎকার ইংরেজি বলে। মালপত্র আগের গাড়ি ছেড়ে ওর গাড়িতে তোলা হল। এটি পুরানো মডেলের টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার যা মরুভূমিতে চলার জন্য কাস্টমাইজ করে তোলা হয়েছে। মোহাম্মদ আগের চালকের একেবারেই বিপরীত। বেশিরভাগ সময় নিজের মনে কোরআন তেলাওয়াত করে। গান শোনে না, সেল ফোনে কোন আগ্রহ নেই। প্রায় ৩০ কিলোমিটার চলার পর প্রথম আমরা হাইওয়ে ছেড়ে ব্ল্যাক ডেজার্টের পথে নামি।

কালো পাথরের আগ্নেয়গিরি আকৃতির অসংখ্য পাহাড়ের সমাহার এই স্থানে। অনেক বছর আগের অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট এই পাহাড়গুলো। বাতাসে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বালু সরে গিয়ে কালো ডলেরাইট পাথর নগ্ন হয়ে এই স্থানটিকে কালো মরুভূমি নাম দিয়েছে। বেছে বেছে চমৎকার একটি পাহাড়ের সামনে মোহাম্মদ গাড়ি থামাল। আমরা নেমে কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর রওনা হলাম ক্রিস্টাল পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। এই পরাবাস্তব পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার একটা সুপ্ত ইচ্ছা জেগে উঠলেও সময় বিবেচনায় আর সেপথে গেলাম না।

আবার ফিরে এলাম মূল রাস্তায়। প্রায় ২০ কিলোমিটার পর আবার মরুভূমিতে ঢুকে পড়লাম। ক্রিস্টাল মাউন্টেন ক্রিস্টাল সদৃশ পাথরে তৈরি। এটি নিকটবর্তী হাইওয়ে নির্মাণ কালে হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়। এর ভূতত্ত্ব পড়তে গিয়ে খুব ভাল বুঝিনি। এটুকু বুঝেছি এটি আগ্নেয়গিরি গঠনের একটি উপস্তর। গাড়ি থেকে নেমে আমরা ক্রিস্টাল সদৃশ পাথর দেখায় মন দিলাম।
ক্রিস্টাল পাহাড়ের পর আমরা হোয়াইট ডেজার্টের পথে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পথ চলার পর আমরা গন্তব্যে পৌঁছালাম- স্থানীয় নাম “সাহরা এল বেইদা”। তুষার শুভ্র থেকে ক্রিম রঙের হাজারো আকৃতির মসৃণ পাথরের সমাহার এখানে। এটা খুবই আশ্চর্য যে, মাত্র শখানেক কিলোমিটার এর মধ্যেই এত ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য। প্রথমে আগ্নেয়গিরি সদৃশ পাহাড়, তারপর বিভিন্ন বেলেমাটির পাহাড়, ক্রিস্টাল পাহাড় আর সবশেষে চকের পাথর। ভূতত্ত্ব সম্পর্কে যাদের আগ্রহ আছে তাদের তো কথাই নেই, যাদের আগ্রহ নেই কিন্ত প্রকৃতি প্রেমিক, তাদেরও এখানে এলে চমৎকৃত না হয়ে উপায় নেই। মোহাম্মদ বলল, “যে পাথরই ভাল লাগবে এবং ছবি তুলতে চাও আমাকে বলো, আমি গাড়ি থামাব।” বলাবাহুল্য এর পরিণামে তাকে অনেকবার গাড়ি থামাতে হয়। আমাদের মুগ্ধতা যখন আর শেষ হচ্ছিল না তখন সে রাশ টানল, ক্যাম্প টানাতে হবে সূর্যাস্তের আগেই। কাজেই আমরা ক্যম্পসাইটে চলে এলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখা গেল আমরা ছাড়া আর তিন চারটি গ্রুপ এসে তাবু গেড়েছে আশেপাশে। সবচে বড় গ্রুপ আমাদের সাথে আসা চাইনিজোরা। এরই মধ্যে তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে। বাচ্চাদের সহ সবাই দ্বিতীয় প্রস্থ কাপড় গায়ে চাপালাম। ক্যাম্পফায়ার তৈরি করে দিল মোহাম্মদ আগুনের আঁচ নেবার জন্য। খাবার প্রস্ততির ফাঁকেই মোহাম্মদ জানাল রাতে গানের আয়োজন আছে। ভরপেট রাতের খাবার সেরে গোল হয়ে সবাই এসে বসেছি গানের আসরে।

ঘন্টাখানেকের মত এই আসর চলে শেষ হবার পর আর করার মত কিছুই থাকল না। আমরা যার যার তাবুতে শুয়ে পড়লাম। স্ত্রী পুত্ররা এক তাবুতে আর আমি একটাতে। শেষ রাতে যথারীতি তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে নেমে এলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধীরে ধীরে পূর্ব দিগন্তে সূর্যের আগমনী ঘটল। পুরো হোয়াইট ডেজার্ট ঘিরে এক অপার্থিব অপূর্ব অবিস্মরণীয় সময়ের অবতারণা হল। সামান্য ডিএসএলআর এর ফ্রেমে কী আর এ সময় ধারণ করা যায়!

সূর্য দিগন্তের উপরে উঠে এলে একে একে সবাই তাবু ছেড়ে বেরিয়ে এল। মোহাম্মদ তার ফজরের নামাজ শেষে নাস্তার আয়োজনে নেমে গ্যাছে সাত সকালেই। স্ত্রী-পুত্ররা সহ সকালের নাস্তা সেরে ফেললে পরে আমি মোহাম্মদের সাথে ক্যাম্প গোছানোতে হাত লাগালাম। এরই মধ্যে অন্য সব গ্রুপ ক্যাম্প গুটিয়ে রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। আমরা খানিকটা দেরি। ফিরতি পথে আরও কিছু আকর্ষণীয় স্পটে থেমে ছবি তুললাম। এরপর মোহাম্মদ আমাদের পৌঁছে দেয় আগের সেই লাঞ্চ স্পটে। মালপত্র তার গাড়ি থেকে পূর্বের গাড়িতে সরিয়ে কায়রোর উদ্দেশ্যে আবার আমরা পথে নেমে পড়ি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়