ডেঙ্গু প্রতিরোধে লিফলেট বিতরণ করবে বিএনপি

আগের সংবাদ

সাইবার নিরাপত্তা বিল পাস : বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার > মিথ্যা মামলায় সমপরিমাণ সাজা > অজামিনযোগ্য ধারা ১৭, ১৯, ২৭, ৩৩

পরের সংবাদ

কাউকে পেছনে ফেলে নয় সবার জন্য উন্নয়ন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ক খ গ ও ঘ চারজনের প্রত্যেকের কাছে ২৫ টাকা করে পুঁজি আছে। ক পরিশ্রম করে সম্পদ সৃষ্টি করে তার পুঁজি ৩৫ টাকায় উন্নীত করল। খ কিছুই না করে তার পুঁজি নিয়ে ঠায় অলস বসে থাকল। সময়ের অবসরে মূল্যস্ফীতির কারণে তার ২৫ টাকার উপযোগিতা কমে ২০ টাকায় দাঁড়াল। সিন্ডিকেট, স্বেচ্ছা-দুর্নীতিবাজ গ সুশাসিত উপার্জনকারী ক, আমজনতার একজন খ এবং স্থির আয়ের ঘ-এর কাছ থেকে মোট ১৫ টাকা ছিনিয়ে নিল। কোনো পরিশ্রম, বিনিয়োগ কিংবা সম্পদ সৃষ্টি ছাড়াই গ-এর পুঁজি ৪০ টাকায় পৌঁছাল। আর বেচারা ক-এর পুঁজি ৩০, খ-এর পুঁজি ১৮ এবং ঘ-এর পুঁজি কমে ১৭ টাকায় গিয়ে ঠেকল। সমান পুঁজিধারী ক খ গ ঘ-এর পুঁজি একটি সময় অন্তে যথাক্রমে ৩০, ১৮, ৪০ এবং ১৭ টাকায় দাঁড়াল। ক পরিশ্রম করে যে সম্পদ তৈরি করল, তা বিনাশ্রমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারী আয় বৈষম্য সৃষ্টিকারী গ বেশি দামে জিনিস কিনে ক, খ ও ঘ-এর জন্য জীবনযাপন কঠিন করে তুলল। গ ক খ ও ঘ কে দিব্যি পেছনে ফেলে দিল। যে অর্থনীতিতে ক নিরাপদ নয়, উপার্জনে গ-এর অত্যাচারে এবং খ ও ঘ-এর ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায়, যে অর্থনীতিতে খ ও ঘ অসহায়ত্বের শিকার, সে অর্থনীতিতে গ-এর দৌরাত্ম্য বাড়া মানে ক-এর টিকে থাকা এবং খ ও ঘ আরো দরিদ্র হওয়া। সবার আয় একসঙ্গে ১০৫ টাকা হওয়ায় চারজনেরই মাথা পিছু আয় দাঁড়ায় ২৬ টাকার একটু উপরে। বেচারা ক গড় আয়ের একটু উপরে থাকলেও গ-এর অবস্থান আকাশচুম্বী এবং খ ও ঘ-এর মাথার পেছন কিংবা সামনে কোথাও নেই। অথচ তাদের টিকে থাকতে সংগ্রাম করতেই হচ্ছে।
অথচ যে কোনো যৌথ সংসারে কিংবা কায়কারবারে সবার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সমান সুযোগ, কর্তব্যপালনে দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পোষণ, উদ্দেশ্য অর্জন তথা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোয় ঐকান্তিক প্রয়াসে সমর্পিতচিত্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস যেমন জরুরি, এ কথা বলাবাহুল্য যে, জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতাও একইভাবে অনস্বীকার্য। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে থাকা চাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান। অপচয় অপব্যয় রোধ, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সবার মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ ও একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলব্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে উঠে যে নিষ্ঠা ও আকাক্সক্ষা, তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন ত্যাগ স্বীকারের। দায়-দায়িত্ব পালন ছাড়া স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতা মাত্র। ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ কথাটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এ জন্য যে উৎপাদনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেই ফসলের ন্যায্য অধিকারপ্রত্যাশী হওয়া স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কর্ম ও ধর্ম নয়। কোনো কিছু অর্জনে বর্জন বা ত্যাগ স্বীকার যেমন জরুরি তেমনি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বাস্তবতা এ জানান দেয় যে, ‘বিনা দুঃখে সুখ লাভ হয় কি মহিতে?’
অর্থনীতি হিসেবে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণে বাংলাদেশের যোগ্যতা অর্জনের ঘোষণা এসেছে জাতিসংঘের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) থেকে। শর্ত হিসেবে সব সূচকেই নির্ধারিত মান অর্জন করতে হবে বাংলাদেশকে। ২০২১ সালে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসক) স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা উত্তরণের সুপারিশ করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদনের জন্য আরো দুই বছর অর্থাৎ ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে। প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের তালিকায় নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছিল বাংলাদেশ। এর ফলে আগামী ৫ বছরে বাজার সুবিধায় তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। ২০২৭ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা থাকবে। ওষুধ শিল্পের মেধাস্বত্ব সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত থাকবে।
শোষণ, বঞ্চনা আর বণ্টন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার বাঙালির ঐতিহাসিক মুক্তির সংগ্রাম এর প্রকৃত অর্জন বা বিজয় বিবেচনার জন্য বিগত পাঁচ দশকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই স্বীকৃতি বা অর্জন একটি প্রত্যয় ও প্রতীতি জাগাতে পারে। প্রথমেই আসে সমন্বিত উদ্যোগের প্রেরণার প্রসঙ্গ, যেমনটি মতবাদ হিসেবে করপোরেট কালচার আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ বিবেচনা ও ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশীদারত্ব হিসেবে শ্রমের মূল্যয়ন সরাসরি স্বীকৃত না হলেও এটি অনিবার্য উপলব্ধিতে পরিণত হয়েছে, কোনো উৎপাদন ও উন্নয়ন উদ্যোগে ভূমি, শ্রম ও পুঁজি ছাড়াও মালিক-শ্রমিক সব পক্ষের সমন্বিত ও পরিশীলিত প্রয়াস, প্রচেষ্টাই সব সাফল্যের চাবিকাঠি। মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের দ্বারা দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়াও সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়াসকে সমাজবিজ্ঞানীরা জাতিগত উন্নয়নে প্রেরণা হিসেবে শনাক্ত করেন। স্থান, কাল, পাত্রের পর্যায় ও অবস্থান ভেদে উন্নয়ন ও উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করার প্রেরণা হিসেবে অনেক উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় নেতৃত্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে একে গোটা দেশবাসীকে ভাববন্ধনে আবদ্ধকরণের চেতনা হিসেবে দেখাতে চাইছেন।
ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত যেমনটি বলেছেন- সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। মানুষই বড় কথা। এই মানুষের দায়িত্ব বোধের দ্বারা কর্তব্য কর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার এই মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে সমাজের সমূহক্ষতি সাধিত হয়। মানবসম্পদ না হয়ে সমস্যায় পরিণত হলে সমাজের অগ্রগতি তো দূরের কথা, সমাজ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি সভ্যতার বিবর্তনে সহায়তা হয়। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ কিংবা মারণাস্ত্রে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। মানবতার জয়গান মানুষই রচনা করে আবার মানবভাগ্যে যত দুর্গতি তার স্রষ্টাও সে। মানুষের সৃজনশীলতা, তার সৌন্দর্যজ্ঞান, পরস্পরকে সম্মান ও সমীহ করার আদর্শ অবলম্বন করে সমাজ এগিয়ে চলে। পরমতসহিঞ্চুতা আর অন্যের অধিকার ও দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মাধ্যমে সমাজে বসবাস করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সুতরাং সবার সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগে সমাজ নিরাপদ বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সমাজবিজ্ঞানীরা তাই মানুষের সার্বিক উন্নয়নকে দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করে থাকেন। সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণ সৃষ্টিতে মানুষের সার্বিক উন্নতি অপরিহার্য শর্ত। আগে সমাজ না মানুষ এ বিতর্ক সার্বজনীন। মানুষ ছাড়া মনুষ্য সমাজের প্রত্যাশা বাতুলতামাত্র। সুতরাং একেকটি মানুষের উন্নতি সবার উন্নতি, সমাজের উন্নতি। একেক মানুষের দায়িত্ববোধ, তার কাণ্ডজ্ঞান, তার বৈধ-অবৈধতার উপলব্ধি এবং ভালো-মন্দ সীমা মেনে চলার চেষ্টা-প্রচেষ্টার মধ্যে পরিশীলিত পরিবেশ গড়ে ওঠা নির্ভর করে। রাষ্ট্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারিত আছে। কিন্তু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা অধিকার আদায়ের সম্ভাবনা ও সুযোগকে নাকচ করে দেয়। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি না হলে চাহিদা অনুযায়ী ভোগের জন্য সম্পদ সরবরাহে ঘাটতি পড়ে। মূল্যস্ফীতি ঘটে সম্পদ প্রাপ্তিতে প্রতিযোগিতা বাড়ে। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি করে যে মানুষ, সে মানুষই ভোক্তার চাহিদা সৃষ্টি করে। উৎপাদনে আত্মনিয়োগের খবর নেই- চাহিদার ক্ষেত্রে ষোলোআনা টানাপড়েন তো সৃষ্টি হবেই। অবস্থা ও সাধ্য অনুযায়ী উৎপাদনে একেকজনের দায়িত্ব ও চাহিদার সীমারেখা বেধে দেয়া আছে কিন্তু এ সীমা অতিক্রম করলে টানাপড়েন সৃষ্টি হবেই। ওভারটেক করার যে পরিণাম দ্রুতগামী বাহনের ক্ষেত্রে, সমাজে সম্পদ অর্জন ও ভোগের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রমণে একই পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সমাজে অস্থিরতা ও নাশকতার যত কারণ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে এই সম্পদ অবৈধ অর্জন, অধিকার বর্জন এবং আত্মত্যাগ স্বীকারে অস্বীকৃতি মুখ্য।
অনেকে মনে করেন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বাজার সুবিধা সংকুচিত হতে পারে। দাতাদের কাছ থেকে কম সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগও কমে যাবে। তাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ বৃদ্ধির দিকেই বেশি মনোযোগী হতে হবে। আবার অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গা করতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আয় বাড়াতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কাটাতে হবে অবকাঠামো দুর্বলতা। জোর দিতে হবে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরিতে। দাতাদের কাছ থেকে যেহেতু রেয়াতি সুদে ঋণ প্রাপ্তি কমে যাবে, তাই বিকল্প অর্থায়নের দিকেও জোর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কর আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে। যেসব দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে, তাদের বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও দায়িত্ব ও সম্ভাবনা বেড়ে গেল। অর্থনীতিতে যে কাঠামোগত দুর্বলতা আছে, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে যে দুর্বলতা আছে, যে দুষ্টক্ষত বিরাজমান তা দূর করতে হবে। কেননা এমন এক সময় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হবে, তখন বৈরী আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হবে। সে সক্ষমতা অর্জনে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে যতœবান ও প্রতিশ্রæতিশীল থাকতে হবে।

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়