বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা : মার্কিন দূতাবাসের ‘তথ্য’ ও ‘পর্যবেক্ষণ’ চেয়ে ডিবির চিঠি

আগের সংবাদ

ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জে দেশের অর্থনীতি : রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনে ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ, মূল্যস্ফিতির চাপ

পরের সংবাদ

বুদ্ধিজীবীর স্বাধীন কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশে একটা ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করে। সেই ভয়টা হলো, আমি যদি আমার মত প্রকাশ করি এবং সেই মত অন্যের কাছে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে আমার বিপদ হতে পারে। নানা রকমের বিপদ হতে পারে। আমার জীবিকার ওপর একটা বিপদ আসতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমার ওপর নজরদারি করতে পারে।
আরেকটা হলো, আমাদের তো গরিব পশ্চাৎপদ সমাজ, এখানে সুবিধার খুব অভাব। কাজেই সুবিধাবাদিতা এসে যায়, একটা সুবিধা পেলাম আর সরকারে যারা আছে তাদের মতকেই সমর্থন করলাম। এটা যখন তিনি করেন তখন আর তিনি বুদ্ধিজীবী থাকেন না। বুদ্ধিজীবীর কাজই হলো পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করা। বিদ্যমানের পক্ষে থাকলে তাকে আমি বুদ্ধিজীবী বলব না।
বুদ্ধিজীবী আসলে বিশেষ কোনো পেশাজীবী নন। বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন সেই রকমের মানুষ, তারা পৃথিবীটাকে বা তাদের জগৎটাকে বুদ্ধির সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এই ব্যাখ্যাকে তারা অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে চান। ব্যাখ্যা করবেন এবং ব্যাখ্যা অন্যের কাছে পৌঁছে দেবেন এবং তার সঙ্গে আরেকটা চেতনা থাকে, তা হলো এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করা। কাজেই বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা তেমন মানুষকেই বোঝাব, যারা বুদ্ধির সাহায্যে পরিবেশ পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেন, সেই ব্যাখ্যাকে অন্যের কাছে নিয়ে যেতে চান এবং ভেতরে আকাক্সক্ষা থাকে অবস্থার একটা পরিবর্তন করা।
যেমন ধরা যাক সক্রেটিস। সক্রেটিস দার্শনিক ছিলেন। তাকে আমরা আদর্শ বুদ্ধিজীবী বলতে পারি। তিনি ব্যাখ্যা করতেন এবং তরুণদের মধ্যে সেই ব্যাখ্যা পৌঁছে দিতে চাইতেন। তার লক্ষ্য ছিল, বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকে বদলাবেন। এভাবেই আমি বুদ্ধিজীবীদের দেখি।
শ্রমজীবীরা পৃথিবীটাকে দেখে, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে কিন্তু তারা ব্যাখ্যা করতে পারে না। ওই ব্যাখ্যা করার জায়গাটাতে বুদ্ধিজীবীরা আছেন। শ্রমজীবী মানুষ অনুভব করে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানে কিন্তু ব্যাখ্যাটা তারা করতে পারে না।
পেশাজীবী আর বুদ্ধিজীবী এক না। এটাকে পার্থক্য করতে হবে। পেশার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন তো অবশ্যই থাকবে। একজন বিজ্ঞানী বা একজন আইনজীবী তিনি তো বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন করেন।
বুদ্ধিজীবী হিসেবে তো তার কোনো আলাদা চিহ্ন নেই। বুদ্ধিজীবী কিন্তু পেশাজীবী হতে পারেন। পেশাজীবী হতে তো কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সব পেশাজীবী মাত্রই বুদ্ধিজীবী না। তারাই বুদ্ধিজীবী, যারা পেশার বাইরে যেতে চান। কিন্তু তিনি তার জীবিকার জন্য পেশার ওপর নির্ভর করবেন। উপার্জনের যে উৎস সেখানে কাজ করবেন। সেগুলো তো তাকে করতে হবে।
বুদ্ধিজীবীরা কারো কাছ থেকে প্রাপ্তির আশা করেন না। তারা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকার কারণে তা থেকে যে আয় উপার্জন হয় সেটার ওপরই নির্ভর করেন। তারা পৃষ্ঠপোষকতা আশা করেন না এবং এটার ওপর নির্ভরও করেন না।
বুদ্ধির চর্চা করলেই বুদ্ধিজীবী হবেন এটা আমার মনে হয় না। বুদ্ধির চর্চা তো ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা করছেন, সাংবাদিকরা করছেন, এমনকি আইনজীবীরাও করছেন। কিন্তু ওই যে আমি বললাম, এটার একটা ব্যাখ্যা করতে হবে। তারা ব্যাখ্যা করবেন এবং সেটা অন্যের কাছে নিয়ে যাবেন তাও সেটা কোনো কিছুর বিনিময়ে না। নিজের ভেতরের অনুপ্রেরণা থেকে এটা করবেন। তার আকাক্সক্ষা থাকবে এই ব্যবস্থাটার বদল করা দরকার। এটা একটা আদর্শ ব্যবস্থা নয়।
কোনো পেশার কাউকেই পেশাগতভাবে বুদ্ধিজীবী বলা যাবে না। বুদ্ধিজীবী হবেন ব্যক্তিগতভাবে। একজন শিক্ষক অবশ্যই বুদ্ধিজীবী হতে পারেন। কিন্তু তিনি শিক্ষক বলেই যে বুদ্ধিজীবী সেটা না। তিনি একটা বিষয় পড়াচ্ছেন, সেই বিষয়ের মধ্যেই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকেন। এমনকি তিনি যদি তার বিষয়ের বাইরে গিয়ে পৃথিবীটাকে ব্যাখ্যাও করতে চান তা হলেও আমি তাকে বুদ্ধিজীবী বলব না। যদি না তিনি তার ব্যাখ্যাকে কথার মধ্য দিয়ে, লেখার মধ্য দিয়ে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে চান বা চেষ্টা করেন। এই ব্যবস্থাটাকে বদলাতে অতি সামান্য হলেও যদি ভূমিকা না রাখেন। বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এখন নানা ধরনের সমালোচনা আছে। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা থাকলেও করেন না। অনেকটা সুবিধাবাদী পরামর্শ দেন। এটা তো অবশ্যই যৌক্তিক না। তিনি যদি সুবিধাবাদী হন এবং সক্রিয় না হন তা হলে আমি তাকে বুদ্ধিজীবী বলব না। বুদ্ধিজীবীকে সক্রিয় হতে হবে। তিনি সুবিধার জন্য কাজ করবেন না। তিনি সক্রিয় না হলে আমরা কী করে বুঝব তিনি পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন।
বুদ্ধিজীবীরা তাদের কাজটা করতে পারছেন না। কারণ বাস্তব অবস্থাটা কিন্তু অনেক শক্তিশালী, ব্যক্তিগত অবস্থানের তুলনায়। বাস্তব অবস্থা মানুষকে আটক করে ফেলে বা সীমিত করে ফেলে। তখন মানুষ আর তার বাইরে যেতে পারে না। বুদ্ধিজীবীরা যদি কথা না বলেন, তাহলে পরিস্থিতি বদলাবে কীভাবে? তাহলে আমরা পরিবর্তন কীভাবে পাব?
বুদ্ধিজীবীরা কি শুধু সরকারের সমালোচনাই করবেন? না কি পরামর্শও দেবেন? পরামর্শ আসলে সমালোচনাই। পরামর্শ হলো, সরকার যে কাজটা করছে, সেটার পক্ষে বলা না। পরামর্শ মানে হলো, আরেকটা কিছু করা। আপনি যেটা করছেন সেটা পূর্ণ হচ্ছে না বা সঙ্গত হচ্ছে না। আসলে পরামর্শ আর সমালোচনার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সমালোচনাও এক ধরনের পরামর্শই বটে।
মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দ্ব›দ্ব ছিল। এখানে বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন। সামনেই ছিলেন। কিন্তু এটাও ঠিক অনেক বুদ্ধিজীবী কিন্তু বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেননি। তাদের অনেকে কিন্তু সরকারের সমর্থকও ছিলেন। যারা সরকারকে সমর্থন করেছিলেন, তাদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমরা গণ্য করব না। তখন তো একটা পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা ছিল। পাকিস্তানি রাষ্ট্র মানুষকে নিপীড়ন করেছে। অধিকার আদায়ের জন্য সব শ্রেণির মানুষই সংগ্রাম করছে। সেই সংগ্রামের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরাও যুক্ত হয়েছেন। আমরা বলতে পারব না, তারা আলাদা করে কোনো ভূমিকা পালন করেছেন। ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ, রাজনৈতিক কর্মীরা বিক্ষুব্ধ, শ্রমিক বিক্ষুব্ধ, কৃষক তার ফসলের মূল্য পাচ্ছেন না, কোনো স্বাধীনতা নেই। এসবের জন্য রাষ্ট্রকে দায়ী করা হচ্ছে। এখন তো সেই বিক্ষোভ নেই। এখন যে রাষ্ট্র, সেটা তো আমাদের নিজেদেরই রাষ্ট্র। তবে মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ আছে। সেটা সংগঠিত আকারে প্রকাশ পাচ্ছে না। সে জন্য বুদ্ধিজীবীরাও তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না।
পরিবর্তনের পক্ষে না হলে একজন মানুষ যতই বুদ্ধির চর্চা করুন না কেন তিনি বুদ্ধিজীবী হবেন না। যদি তিনি সুবিধা নিয়ে কথা বলেন বা বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে বলতে থাকেন, তাহলে তিনি বুদ্ধিজীবীর যে ভূমিকা সেটা পালন করছেন না। বুদ্ধিজীবীকে আমরা সুবিধাবাদী হিসেবে কখনোই দেখব না। সুবিধাবাদী হয়ে গেলে আমরা বলব, তিনি আর বুদ্ধিজীবী নেই। মুখাপেক্ষি হয়ে গেলে মনে করব, তিনি আর বুদ্ধিজীবী নেই। এজন্যই আমরা বলছি, বুদ্ধিজীবীর কাজ হচ্ছে পরিবর্তনের পক্ষে থাকা।
চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনার অভাবে আমাদের রাজনীতি গণতান্ত্রিক স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। সবার সব ধরনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এই রাজনীতি স্বীকার করতে চায় না; অন্যের মতের প্রতি সে চরমভাবে অসহিষ্ণু। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সে ভিন্নমত ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিতে চায়। এ রকম অগণতান্ত্রিক ও অন্যায্য পরিবেশ যখন সৃষ্টি হয়, তখন এর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠস্বর বেজে ওঠার কথা।
বুদ্ধিজীবীর স্বাধীন কণ্ঠস্বর। কিন্তু স্বাধীন বুদ্ধিজীবী কথাটা আমাদের দেশে আজ সোনার পাথরবাটির মতো। এ হয় না। এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের উল্লেখযোগ্য অংশ চিন্তা ও মনন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন কি, তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে ষাষ্টাঙ্গে বশীভূত হয়ে নানা রকমের বৈষয়িক সাধ পূরণের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আইনজীবী ইত্যাদি বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার সমিতি-সংগঠনগুলো দলীয় রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত। তারা বস্তুত রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করে। জনসাধারণের কাছে যে সাংবাদিক সমাজের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি কাম্য, তারাও দলীয় রাজনৈতিক লাইনে বিভক্ত। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বাংলাদেশে বিরল হয়ে উঠেছে। তাই যখন স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল আইন প্রণয়ন করা হয়, তখন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিবাদ এমন প্রবল হয় না, যা সে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া প্রতিহত করতে পারে।
বুদ্ধিজীবীর সেই প্রবল স্বাধীন কণ্ঠস্বর নেই বলে বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্রের এমন রুগ্ণ দশা।

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম : কলাম লেখক, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়