বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা : মার্কিন দূতাবাসের ‘তথ্য’ ও ‘পর্যবেক্ষণ’ চেয়ে ডিবির চিঠি

আগের সংবাদ

ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জে দেশের অর্থনীতি : রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনে ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ, মূল্যস্ফিতির চাপ

পরের সংবাদ

একটি পাসপোর্টের আত্মকথা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ , ২:১৮ পূর্বাহ্ণ

আমার জন্ম ১ জুলাই, ২০১৮ সালে। প্রত্যেক মানুষের যেমন জন্মের পর পর একটা করে নতুন নাম দেয়া হয়, তেমনি আমাদের জন্মের পর একটা স্বতন্ত্র নম্বর দেয়া হয়। সেখানে আমার জন্ম তারিখ আবার মৃত্যুর তারিখও উল্লেখ থাকে। আসলে আমরা প্রাণী নই, তাই আমাদের জন্ম-মৃত্যু থাকার কথা নয়। সেক্ষেত্রে বলা উচিত ছিল ১ জুলাই ২০১৮ সালে আমার সৃষ্টি হয়, আর আমার মেয়াদ শেষ হবে ৩০ জুন, ২০২৩ সালে।
আমি অনেক আধুনিক পাসপোর্ট। মেশিন যেহেতু আমার পাতার লেখা পড়তে পারে, তাই আমাদের প্রজন্মের পাসপোর্টকে বলা হয় মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট। কিন্তু আমি এমন আধুনিক হলেও আজকের এই পথে আসতে, আমাদের লম্বা সময় পার করতে হয়েছে।
আমার মতো পাসপোর্টের অনুরূপ কাগজের নথির উল্লেখ রয়েছে আনুমানিক ৪৫০ খ্রিস্টাব্দের হিব্রু বাইবেলের নেহমিয়া ২:৭-৯ তে। তবে ইংল্যান্ডের রাজা হেনরির আমলে ১৪১৪ সালে অ্যাক্ট অব পার্লামেন্টের মাধ্যমে আধুনিক পাসপোর্টের ধারণা আসে। তার সময়ই ১৫৪০ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট (প্রাইভেসি কাউন্সিল অব ইংল্যান্ড) আইন পাস করে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের ইস্যু করা শুরু করে।
আর আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৯ নম্বর আইন (বাংলাদেশ পাসপোর্ট আদেশ, ১৯৭৩ নামে পরিচিত), যা ১৯৭৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়। তখন বাংলাদেশ সরকারের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর হতে ঐতিহ্যবাহী হাতে লেখা বা ম্যানুয়াল পাসপোর্ট ইস্যু করত।
কিন্তু আমার সৃষ্টির আগেই আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সংস্থার (আইসিএও) নির্দেশিকা অনুসরণ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এপ্রিল ২০১০ সালে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) প্রদান শুরু করে। তাই আমি বলতে পারি আমি এখন এমআরপি নামে পরিচিত। কিন্তু আমার পরবর্তী তথা সর্বাধুনিক পাসপোর্টও এখন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর তৈরি করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একটি সম্মেলনে আমার পরবর্তী প্রজন্ম তথা, ই-পাসপোর্ট বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। আমি গর্ব করে বলতে পারি, দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের দেশই প্রথম ই-পাসপোর্ট চালু করে।
আমার বাহকের নাম শাফায়াত করিম (কল্পিত নাম)। আমার বাহকের জন্ম তারিখ, তার বাবা-মাসহ তার স্ত্রী সবার নাম আমার পৃষ্ঠায় লেখা আছে। আমি যখন প্রথম আমার বাহকের হাতে পৌঁছেছি, আমায় পেয়ে তার সে কী আনন্দ। আমার বাহক বাসায় গিয়েই আমাকে তার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলে, দেখো আমার পাসপোর্ট হয়েছে। এখন আমি দুবাই যেতে পারব। দেখবে আমাদের কষ্টের দিন আর থাকবে না। বাহকের স্ত্রীর আনন্দের চোখের অশ্রæ আমার পাতায় পড়েছে। আমার শরীরে সেই আনন্দের স্মৃতি এখনো আমি গভীর যতেœ ধারণ করে রেখেছি।
আমার কিন্তু দুঃখের স্মৃতিও আছে। আমার বাহক যেদিন দুবাইয়ের এম্বাসি থেকে আমায় ফেরত নিলেন, তার সে কি কান্না। তিনি নাকি দুবাই যেতে পারবেন না। আমি জানি না, আমার কী দোষ! আমার বাহক কাদের হাতে যেন আমাকে জমা দিয়েছে, তারা আবার আমার বাহককে কিছুদিন পরে ফেরত দিয়েছে। হ্যাঁ, আমার কোন পাতায় তারা কোন স্টিকার লাগায় নাই। কিন্তু আমি তখন জানতাম না, এই স্টিকারকেই ভিসা বলে। আর আমার বাহকের সেই ভিসা পাওয়ার জন্যই এত চেষ্টা।
কিন্তু ছয় মাস পর আমাকে আবার যখন এম্বাসিতে জমা দেয়া হয়, তার দুই দিন পর যখন আমার পাতায় ভিসা লাগানো হয়, তখনই আমি বুঝে যাই আমার বাহকের স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে।
আমার বাহক ভিসা পাওয়ার কয়েক দিন পরই আমাকে নিয়ে দুবাই চলে আসেন। তখন থেকে বুঝতে পারি আমার কী মর্যাদা। বিমানে ওঠার সময় ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট এ আমাকে দেখিয়েই আমার বাহক বিমানে ওঠে। একইভাবে দুবাই এয়ারপোর্টেও আমাকে দেখিয়ে আমার বাহক এই নতুন দেশে প্রবেশ করেন। বাহক আমাকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা শুরু করে।
আমি দেখেছি, আমার বাহক কী পরিমাণ শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করেছে। সপ্তাহে ছুটির দিনে, আমাকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে। তিন বছর পরে আমার বাহক আমায় নিয়ে তার নিজ মাতৃভূমি, তার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে এসেছে। এখন আমার বাহকের নিজের বাড়ি হয়েছে। বাড়ির পাশে ছোট পুকুর আর বাগান আছে। আমার বাহকের এমন উন্নতিতে বুকটা আমার গর্বে ভরে যায়।
কিন্তু তোমরা অনেকেই জানো না, সব পাসপোর্ট আমার মতো সুখি না। কোনো কোনো বাহক বিদেশের ভিসা পাওয়ার জন্য অন্যের নাম, কিংবা বয়স বাড়িয়ে/কমিয়ে পাসপোর্ট করে। তাদের বাহকদের কষ্টের কথা সেই পাসপোর্টগুলো বুকে ধারণ করে রেখেছে। তাদের বাহকরা বাইরে তো যেতেই পারে না বা গেলেও আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে সহায় সম্বল হারিয়ে দেশে ফেরত আসে।
অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এমন ভুল তথ্য সংশোধনের জন্য অনেক বিধি করেছে। সেই বাহকরা একটু সচেতন হলেই ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে এই বিধিগুলো জেনে তাদের পাসপোর্টের ভুল তথ্যগুলো সংশোধন করে নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমার মতো অন্য পাসপোর্টগুলোও তাদের বাহকদের উন্নতি দেখে তাদের গর্বের কথা তোমাদের জানাতে পারবে।
আমি ৩০ জুন, ২০২৩ তারিখে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাব। আমি জানি, নতুন নম্বরে আমি আরো আধুনিক তথা ই-পাসপোর্টরূপে তোমাদের সামনে হাজির হতে পারব। তখন না হয়, আবার নতুন গল্প শোনাব।

আবু নোমান মো. জাকির হোসেন : উপপরিচালক (ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর) এবং সাধারণ সম্পাদক (IPOA).
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়