নাজিরাবাজারে দুই দোকানে আগুন শর্টসার্কিটে

আগের সংবাদ

তিস্তায় জল গড়ানোর আশা! জি-২০ সম্মেলনের সাইডলাইনে হাসিনা-মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবে বাংলাদেশ

পরের সংবাদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগে অভাগা বাঙালিদের প্রাণ সংহার

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের প্রায় সর্বময় ক্ষমতাধিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অভাগা বাঙালিদের জীবন অতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের একটা ব্যাপার! ১৯৭১-এর বাঙালি গণহত্যা তার বলিষ্ঠ উদাহরণ! এছাড়া সম্প্রতি খোদ মার্কিন মুলুকে অভাগা বাঙালিদের প্রাণে মেরে ফেলার ঘটনাও বিষয়টির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে! এর ঠিক বিপরীতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা বা পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করা একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর কাছে নিষিদ্ধ ব্যাপার! ব্যাপারটি প্রাচীনকালে বৈদিক শাস্ত্রাদি সংস্কৃত ভাষা ব্যতীত বাংলা ভাষায় লেখা বা বলা নিষিদ্ধ থাকার সঙ্গে তুলনাযোগ্য! বলা হতো বাংলা ভাষায় এসব শাস্ত্রাদি কেউ লিখলে বা বললে তার স্থান হবে নরকে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেলায়ও সেই ধরনের একটা অদৃশ্য অথচ নিষিদ্ধ ব্যাপার একটু মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। পাশাপাশি আমেরিকার নিজেদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু বললে রাজনৈতিক শক্তি বেশ পুলকিত বোধ করে থাকে! প্রসঙ্গক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়েই বর্তমান লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্বের ১৩০টিরও অধিক দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা আছে। মানবতা রক্ষার নামে তারা সেসব দেশে কী করছে সেটা ভুক্তভোগীরাই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ব্যাপারে ইউরোপের দেশগুলোও কম সোচ্চার নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা মানবতার সেবা কতটুকু করছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর অন্যতম পরাশক্তি হলো চীন। বিগত বছরগুলোতে তারা সামরিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। এই মুহূর্তে কোনো দেশ যদি মার্কিনিদের চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হয় তা হলে সেই দেশ হলো চীন। এই চীনও মানবতা লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে তাদের কর্মের দ্বারা। বিশ্বে যেসব জাতি নির্মম নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার তাদের মধ্যে চীনের উইঘুর মুসলিমরা অন্যতম।
স্বায়ত্তশাসিত জিংজিয়াং প্রদেশের এই মুসলিম সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত হয়ে আসছে। প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে চীন সরকার বিনা কারণে আটকে রেখেছে বন্দিশিবিরে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশিত হলেও চীনা সরকার এটা অস্বীকার করেছে। এমনিতেই চীনে মুসলমানরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে না। গত রমজান মাসে রোজা রাখার ওপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটা নিয়ে সোচ্চার হলেও চীনের তাতে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ- যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে মানবাধিকার রক্ষার উদ্ধার কর্তা হিসেবে দাবি করে সেই যুক্তরাষ্ট্রেই আর্থিক দুর্নীতি, বর্ণবৈষম্য, অস্ত্র এবং পুলিশি সহিংসতাসহ সম্পদ কুক্ষিগত করার ঘটনা অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে অস্ত্র রাখার নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র চরম শৈথিল্য প্রদর্শন করেছে। এর ফলে সেখানে বন্দুক সহিংসতায় হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। বন্দুক নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেকের বেশি স্টেটে শৈথিল্য অবলম্বন করা হয়। বিশ্বে বন্দুকের মালিকানা, বন্দুককেন্দ্রিক হত্যাকাণ্ড এবং এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যার ঘটনার দিক দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০২২ সালে এসব ঘটনায় ৮০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০টির বেশি ‘ম্যাস শুটিং’য়ের ঘটনা ঘটেছে। বন্দুককেন্দ্রিক সহিংসতা ‘যুক্তরাষ্ট্রের মহামারিতে’ পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলঙ্কিত মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড় আয়ু কমে গেছে। হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের সিনিয়র এডিটর রবার্ট এইচ শ্মেরলিং লিখিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার গড় আয়ু ২০২০ সালে ৭৭-এ নেমে আসে এবং ২০২১-এ আরো নেমে ৭৬-এর বেশি হয়। এটি ১৯২০-এর পর থেকে ২ বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় হ্রাস। মাদকের অপব্যবহারের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা সেখানে বেড়েই চলেছে। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশনের অধীনে ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটস্টিকিসের আগস্ট-২০২২-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০১৯-২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গড় আয়ু ২ দশমিক ৭ বছর কমে ৭৬ দশমিক ১ বছরে নেমে এসেছে, যা ১৯৯৬ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এবং রাজনীতিবিদরা অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতা জাহির করে, যা মাদকের অপব্যবহার বৃদ্ধি পেতে সহায়ক হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদকের অপব্যবহারে আমেরিকানদের মৃত্যুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এ কারণে প্রত্যেক বছর আমেরিকাতে ১ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। মাদকের অপব্যবহার আমেরিকার জন্য অন্যতম ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে।
নারীদের গর্ভপাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিক যে সুরক্ষা ছিল সেটা তারা হারিয়েছেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র শিশুদের বসবাসের পরিবেশ বেশ উদ্বেগজনক। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের রায় রো বনাম ওয়েডেক বাতিল করে প্রায় ৫০ বছর ধরে মার্কিন সংবিধানে সুরক্ষিত মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার নিঃশেষ করেছে, যা নারীর মানবাধিকার এবং লিঙ্গ সমতার জন্য একটি বড় আঘাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে, ১৮ বছরের কম বয়সি ৫ হাজার ৮০০টিরও বেশি শিশুকে গুলি করে আহত বা হত্যা করা হয়েছে এবং স্কুলে গুলি চালানোর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০২টিতে। এ সংখ্যা ছিল ১৯৭০ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্রে শিশু দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ১ থেকে বেড়েছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশে, ২০২২ সালের মে মাসে, আরো ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে চলে গেছে। ২০১৮ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শিশুশ্রম লঙ্ঘনের ঘটনা প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২২ অর্থবছরে বিপজ্জনক পেশায় নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মার্কিন শক্তির অপব্যবহার এবং একতরফা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ২১ শতকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে ৮৫টি দেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এর ফলে কমপক্ষে ৯ লাখ ২৯ হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৩৮ মিলিয়ন মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র বেশি একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখনো ২০টিরও বেশি দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। যার ফলে সেসব দেশের জনগণ মৌলিক খাদ্য এবং ওষুধ সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদী দাসত্ব এবং শ্রম, দখল ও বণ্টনের অসমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক বণ্টন প্যাটার্নের মিথস্ক্রিয়ায় সিস্টেমের ব্যর্থতা, শাসনের ঘাটতি, জাতিগত বিভাজনের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকান রাজনীতবিদরা নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন। এর ফলে তারা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রতি সাড়া দেয়া এবং সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার ইচ্ছা এবং বস্তুনিষ্ঠ ক্ষমতা হারিয়েছেন এবং মানবাধিকারের নিজস্ব কাঠামোগত নানা সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তারা মানবাধিকারকে অন্য দেশগুলোতে আক্রমণ করার জন্য একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে সংঘাত, বিভাজন এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং এভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী এবং এর রক্ষায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের যে দেশগুলো সবসময় মুখে মানবতা এবং মানবাধিকারের কথা বলে থাকে কার্যক্ষেত্র দেখা যাচ্ছে তাদের দ্বারাই মানবাধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হচ্ছে। তবে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষেরা সবসময় অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। যে শান্তির আশায় বিশ্ব মানবতা আজ পথ চেয়ে বসে আছে জানি না সে শান্তির দেখা কতদিনে মিলবে। তবে আমরা আশাবাদী। বৃহৎ শক্তিগুলো যত দ্রুত নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে শান্তির পথে অগ্রসর হবে তত দ্রুতই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়