ড. ইউনূসের মামলা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী : বিচারাধীন বিষয়ে দেয়া বিবৃতি বিচার বিভাগকে অপমান

আগের সংবাদ

উড়াল সড়কের যুগে রাজধানী : এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ খুলছে আজ, এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট ১০ মিনিটে

পরের সংবাদ

ভারত টু চাঁদ, ঢাকা টু কক্সবাজার, বাজেট কত

প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার রেললাইন নির্মাণের প্রকল্প বাজেট ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রমের অবতরণের বাজেট ৬১৫ কোটি টাকা। এই দুই খরচের মধ্যকার ব্যবধান আকাশ ও পাতাল। ভাবছিলাম কোনটা সস্তা আর কোনটা দামি। উল্লেখ্য, ভারত ৬১৫ কোটি টাকা ব্যয় করে বিশ্ব ইতিহাসে চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদে পৌঁছানোর গৌরব অর্জন করেছে। আর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবস্থানকারী হিসেবে প্রথম। কিন্তু ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে পৌঁছানোর রেললাইন তৈরির গৌরব অর্জন করা সম্ভব হলো না, ব্যর্থ হলাম। ভারতের চন্দ্রযান-৩ নির্ধারিত সময়ে চাঁদে অবতরণ করতে পারলেও নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশের ঢাকা থেকে কক্সবাজারে রেলগাড়িতে চড়ে পৌঁছানো গেল না, স্বপ্নটা পূরণ হলো না। কারণ রেলগাড়ি যে রেললাইনের ওপর দিয়ে ছুটবে, ছোটার কথা, সেই নির্মিত রেললাইন রেকর্ড বৃষ্টিতে বেঁকে গেল। টিভির পর্দায় সংবাদে দেখা গেল, একজন ব্যক্তি রেললাইনের পাশে নামতেই তার গলা পর্যন্ত পানি। অর্থাৎ রেললাইনের নিচে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। আজব ঠেকেছে। বলা হয়েছে, অতি বৃষ্টিপাতে এমনটা হয়েছে। তাহলে কি ভাবতে হবে আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনের কথা পরিকল্পনা গ্রহণে ও বাস্তবায়নে সম্ভবত মাথায় রাখা হয়নি। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের যৌক্তিকতা ভাবা হয়নি। এ কেমন কথা! যাহোক পরিষ্কার যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি প্রকল্পের নকশায় বিবেচনা করা হয়নি। আর সেই কারণেই ১৮ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারিত সময়ে কক্সবাজার পৌঁছানো গেল না। এবং অর্থের অপচয় হলো। সম্ভবত সংশ্লিষ্টদের একজন ঊর্ধ্বতন সংবাদ মাধ্যমে বলল, এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মাত্র ১ কোটি টাকার মতো লাগতে পারে, যা মোট বাজেটের খুবই সামান্য। অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা দেখি যে, এসব কর্মকর্তার কাছে টাকার মূল্য তখনই, যখন সেই টাকার মালিক ব্যক্তিগতভাবে তারা হয় এবং সেটা যে কোনো উপায়ে। বক্তব্য শুনলে মনে হয়, ১ কোটি টাকার কোনো হিসাব বা মূল্য দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না। সরকারি যত বড় বড় প্রকল্প, সেসবের ভেতর দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা উঠেছে অতীতে এবং আজো ওঠে। প্রকল্প মানেই যেন টাকার বেহিসাবী ব্যবহার, টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ। শোনা যায়, অনেক সরকারি কর্মকর্তা প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। এটা ঠিক যে, প্রকল্প সম্পর্কে যতই নেতিবাচক ও আপত্তিকর কথা উঠুক, এই বিষয়ে পরবর্তী সময়ে তদন্ত ছাড়া আর কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয় বলে মনে হয় না। আর তাই প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়টি লাগাতার একটা বিষয় হিসেবে সংশ্লিষ্টদের কাছে রয়েই যায়। দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা থেকেই যায়। কোনোভাবেই কেউ যেন নড়েচড়ে বসছে না, দায়িত্ব পালনে অর্থ অপচয় রোধ করে দেশের কল্যাণের কথা ভাবছে না। মনে হয়, প্রকল্প মানেই যেন অরক্ষিত অর্থ ভাণ্ডার। যেখান থেকে ব্যক্তি-গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে।
যাহোক, ভারতের এই সাফল্যে বেশকিছু বিস্ময় জেগেছে। প্রথমটা হলো, এত অল্প বাজেটে এত্ত বড় সাফল্য অর্জন কী করে সম্ভব, যেখানে ভারতে অধিকাংশ ছবির বাজেট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ভারত নিয়ে যে যাই বলুক, দেশটি কখনো নিজেদের স্বার্থের বাইরে গেছে বলে মনে হয় না, মনে পড়ে না। মেধা, জ্ঞান, সাফল্য এক জায়গায়, আর ব্যবসা তাদের আরেক জায়গায়। বড় বিষয় হলো, ছোট থেকে বড়, তারা সবাই দেশপ্রেমিক। একজন অতি সাধারণ ব্যক্তি কৌতূহলবশত জানতে চাইল যে, বাংলাদেশে চন্দ্রাভিযান, এমন একটি কাজ করতে কত টাকা বাজেটে রাখা হতো। যেখানে একটা রেললাইন স্থাপনে ১৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট রাখা হয়েছে। চন্দ্রাভিযানে নিশ্চয়ই ১৮ হাজার কোটিকে শত শত গুনে একটা জায়গায় আনা হতো। তাই না? অন্তত আমার কাছে উত্তর নেই। তবে সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবে। আর তাছাড়া চাঁদে যাওয়ার ইচ্ছে তো কখনো জাগতে দেখা যায়নি। জাগলে না হয় এই বিষয় নিয়ে কথা হতো। বিজ্ঞানীদের একটা বড় দল ভারতের চন্দ্রযান-৩ বিক্রম নিয়ে কাজ করেছে। মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ছিলেন একজন নারী এবং পুরো দলে ৬৪ জন নারী কাজ করেছেন। এ যেন আরেক বিজয় ভারতের। নারীর মেধা, জ্ঞানকে চাঁদে পৌঁছে দিয়েছে ভারত, নাকি ভারতকে চাঁদে পৌঁছে দিয়েছে ভারতের বিজ্ঞানীরা, যার মধ্যে ৬৪ জনই নারী? দুটোই সত্য এবং কার্যকর। আজ গোটা বিশ্ব বিস্ময়ভরে দেখছে ও বুঝতে চেষ্টা করছে, ভারতের এই সাফল্যকে। যখন ভারতের নারীদের এমন সাফল্য নিয়ে চারদিকে উচ্ছ¡াস, ঠিক তেমন একটা সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেল যে, বাংলাদেশে বোরকা পরিহিত কয়েকজন নারী জাতীয় পরিচয়পত্রে তাদের কাপড়ে আচ্ছাদিত ছবি সংযুক্ত করার আবেদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে একজন ব্যক্তি তার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই পারে। এটা তার অধিকার। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে মুখের অধিকাংশ ঢাকা ছবি কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, সেই নারীর, নাকি রাষ্ট্রের, একটা বড় প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায়। এমন একটা বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন যেন বাংলাদেশের নারীদের ধর্মীয় অজুহাতে পিছিয়ে রাখার প্রচেষ্টা বলে কেউ কেউ মনে করে। এটা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মেধা ও যোগ্যতায় নারীরা প্রমাণ দিলেও, উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হলেও বিভিন্ন কৌশলে ও কায়দায় নারীদের অবস্থানকে পেছনে রাখা হয়েছে। আজো নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সংশয় দেখা দেয়। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী- সর্বত্রই নারীকে পেছনে রাখা হয়েছে, পেছনে রাখার পাঁয়তারা চলেছে। যদিও বলা হয়, নারী ও পুরুষের সমঅধিকার। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি এর অন্যতম কারণ বলে সমাজে স্বীকৃত। এমন সম্মেলন যদি বাস্তবে হয়েই থাকে তাহলে বুঝতে হবে দেশটা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, একই গতিতে পিছিয়ে আনার অপচেষ্টা চলছে। যতদূর বলা যায় এই অপচেষ্টা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। মেয়েরা অনেক এগিয়েছে সত্য এবং এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকটা মেয়েদের ব্যক্তি সাহসে ও ইচ্ছায়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা সাফ ফুটবল গেমসে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো সাহস সঞ্চয় করেছে, যেখানে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বা ধর্মীয় গোঁড়ামি বাধা দিতে পারেনি। একই কথা ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলায়। এখন নারীদের জন্য নির্ধারিত কোনো খেলা নেই। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সব ধরনের খেলা খেলে, সাফল্য দেখায়। পড়াশোনা, চিকিৎসাশাস্ত্রে, প্রকৌশলে, গবেষণায়, বিজ্ঞানে, ব্যাংকে সবখানেই নারীর সাফল্য। নারী তার মেধা, যোগ্যতা ও সক্ষমতা দেখিয়ে টিকে আছে, সমাজে জায়গা নিয়েছে এবং সেটা শত প্রতিকূলতার মাঝে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের ও দেশের পরিচিতির দুয়ার উন্মুক্ত করেছে আজ নারীরা। একদিনে আসেনি এই সাফল্য। সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতার মাঝে একজন শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছায় এই সাফল্য ক্রমান্বয়ে বাস্তবের মুখ দেখেছে। যুদ্ধ করতে হয়েছে নারীকে এবং অবশ্যই শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনাকে নারীর জন্য পথ প্রশ্বস্ত করতে হয়েছে। সমস্যা হলো, সংশ্লিষ্টদের পুরুষপ্রীতি, অধীনস্থবাদ, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব শেখ হাসিনার ইচ্ছামতো নারীর সাফল্য আসেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর ঘুপটি মেরে থাকা পুরুষতন্ত্র হয়ে থেকেছে বড় বাধা।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চন্দ্রযান-৩ বিক্রমের পুরুষের চাঁদে সফল অবতরণকে অধিকাংশ মানুষ বলছে, এটা নারীর সাফল্য। যদিও কেউ কেউ বলছে চন্দ্রাভিযানে মেয়েদের সংখ্যা বেশি হলেও কেন চন্দ্রযান-৩-এর নাম বিক্রম? তবে কি সেখানেও পুরুষতন্ত্র প্রবল? বাংলাদেশের মতো ধর্মীয় গোঁড়ামি সেই দেশেও রয়েছে কিনা, প্রশ্ন জাগে। তবে সেখানে কোনো ধর্মই নারীকে পেছন থেকে টেনে ধরে না, ধরতে দেখা যায়নি তেমন একটা। যদি ধরে থাকে তাহলে সেখানে প্রবল সামাজিক আন্দোলন হয়। যাহোক, যেখানে ভারতের নারীরা চাঁদে পৌঁছানোর সাফল্য অর্জনের পর সূর্যে অবতরণের কথা ভাবছে, সেখানে বাংলাদেশের কিছু নারী তাদের চেহারা আচ্ছাদিত ছবি জাতীয় পরিচয়পত্রে সংযুক্ত করার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করল। এতে বিভিন্ন ধরনের মিশ্র শঙ্কা জাগায়, প্রশ্নের অবতারণা করে। এরা কারা, দেশ ও দশের নিরাপত্তার বিষয়টি কতটুকুইবা অনুভব করতে পারে।
পরিশেষে বলব, বড় ধরনের সাফল্য ও বিজয়ের জন্য স্বচ্ছতা, সততা ও নৈতিকতার কোনো বিকল্প নেই। উপযুক্ত জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতার পাশাপাশি গবেষণামূলক পরিকল্পনা দরকার, যা করবে যোগ্য ব্যক্তিরা। দরকার প্রকল্পের খরচ সংক্রান্ত সব হিসাব জনসম্মুখে তুলে ধরা। প্রকল্প শেষে সংশ্লিষ্ট সবার সহায়-সম্পত্তির পরিমাণ দেখা দরকার। ঢাকা টু কক্সবাজার নির্মাণাধীন রেললাইনের দুরবস্থা অনেক কথাই বলে, হতাশা ও দুঃখ বাড়ায়। লজ্জিত করে।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়