ড. ইউনূসের মামলা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী : বিচারাধীন বিষয়ে দেয়া বিবৃতি বিচার বিভাগকে অপমান

আগের সংবাদ

উড়াল সড়কের যুগে রাজধানী : এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ খুলছে আজ, এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট ১০ মিনিটে

পরের সংবাদ

জনসার্বভৌমত্ব বিপন্ন হলে পথ হারাবে রাষ্ট্র

প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেশের সংবিধানের ৭(১) ও ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ, যাদের সংবিধানে সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনসার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংবিধানে প্রথমত বৈষম্যহীন এক অর্থনীতি সমাজ রাষ্ট্র গঠন এবং দ্বিতীয়ত অসাম্প্রদায়িক মানস কাঠামো বিনির্মাণে জোর দেয়া হয়েছে। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যার মাধ্যমে সেই সাংবিধানিক প্রত্যাশা পূরণের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সব প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা’। লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হলেও সাংবিধানিক সেই জনপ্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দর্শন ও বঙ্গবন্ধুর শোষিতের পক্ষে অবস্থানের নীতির প্রতি রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারকরা কতটুকু অবিচল রয়েছে, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কেননা বঙ্গবন্ধুর মাত্র ৫৪ বছরের জীবন ও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল এদেশের জনগণ তথা জনসার্বভৌমত্ব গড়ে তোলা। তার এই জনসার্বভৌমত্বের প্রতি আস্থাশীল রাজনীতির কারণে একটি প্রশিক্ষিত সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী ৮ মাস ২০ দিনের যুদ্ধে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জনসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় লড়াই করা। যাতে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। বঙ্গবন্ধুর দর্শনে মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা, সামাজিক সাম্য ও মানবাধিকারের সংরক্ষণ সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করে জনসার্বভৌমত্বের ভিত্তি হিসেবে মানুষের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আর্থিক উন্নয়ন, সুখ-শান্তি এবং সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। জনগণের চরম ক্ষমতার সর্বব্যাপকতা ও সার্বজননীতা। বিষয়টি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। যার মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যেই স্ব-অস্তিত্ব বিলীন করে জনসার্বভৌমত্বের আভিজাত্যতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মা-বোনেরা ইজ্জত রক্ষা না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না, যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে, তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের অধিকার রক্ষায় তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। জনগণের জন্য একটি বৈষম্যহীন, শোষণ বঞ্চনামুক্ত ও অর্থনৈতিক মুক্তির সমাজ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বলেছেন, সরকারের উন্নয়ন দর্শন ও কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু হবে জনগণ বা জনস্বার্থ। এই নীতি দর্শনে অবিচল থেকে তিনি জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সব নীতি ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন। দরিদ্র ভূমিহীনকে স্থায়ী ঠিকানা প্রদানে ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাসে ভূমি সংস্কার, শিল্প জাতীয়করণ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কার। বিভিন্ন মহল থেকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ ও বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তিনি জনস্বার্থে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ ছিলেন এবং আমৃত্যু সেই প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নীতি দর্শনের কারণে তার শাসনামলে তথাকথিত করপোরেট কালচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। তিনি সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার বিষয়টি রাজনীতির নীতিদর্শনের চালিকা শক্তি হয়ে উঠলে, অর্জিত স্বাধীনতার সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে যোজন যোজন দূর চলে যাবে। তাই তিনি জমির মালিকানা নির্দিষ্টকরণ, শিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা জাতীয়করণের পাশাপাশি জনক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সমবায় ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। যার প্রেক্ষিতে তার শাসনামলে ব্যবসায়িক নীতিদর্শন ও মানবিক রাজনৈতিক দর্শনকে সমান তাললয়ে চলতে উৎসাহিত করেনি। রাজনীতিকে বর্ণবাদী তথাকথিত করপোরেট নীতি আদর্শ গ্রাস করলে সেক্ষেত্রে জনসার্বভৌমত্ব প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তার এ ধরনের নীতিদর্শনের কারণে ৭৫ পূর্ববর্তী সময়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোনোভাবেই উচ্চ বর্ণবাদী করপোরেট সংস্কৃতির নিকট জিম্মি হতে পারেনি।
জাতির দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হীনমানসে সরকারগুলো সমাজ ও রাজনীতিতে বর্ণবাদী করপোরেট কালচারকে উচকে দিয়েছে। ফলে রাজনীতি গণমুখিতার পরিবর্তে ব্যবসায়িক ধ্যান-ধারণা সমান্তরাল হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে রাজনীতির নীতি আদর্শ ও দর্শন অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক আবৃত্তে আবৃষ্ট হয়। ঘুণে ধরা এ ধরনের শ্রেণি-বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রমেই সমাজ রাষ্ট্রের পরতে পরতে বিকশিত হতে থাকে। উচ্চ বিত্তবানদের অপপ্রচারের কারণে শোষণমূলক ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি স্থান করে নেয় জাতীয় মনন চেতনায়। ফলে আমাদের চিরাচরিত ন্যায়ানুগ সামাজিক মূল্যবোধ ভেঙে পড়ে। ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির চাপ রাজনৈতিক অঙ্গন ছেড়ে শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা, আবাসন, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রকৌশল, সামাজিক মূল্যবোধ অর্থাৎ প্রতিটি সেক্টরকে গ্রাস করেছে। কার্যত এ ধরনের হীন ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রাষ্ট্রের মানবিক মূল্যবোধ অবনমিত হয়েছে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ব্যবসায়িক ধারণা পতিত হওয়ায় শিক্ষাঙ্গন থেকে এখন সুনাগরিক তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষা বিনিয়োগ এখন লাভ লোকসানের হিসাবে চলে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করে সুদাসলে শিক্ষা বিনিয়োগ তুলে নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। এখানে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দেশপ্রেম অত্যন্ত গৌণ।
বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর রাজনীতি কতটা ধনিক বণিকের করপোরেট সংস্কৃতিতে আবদ্ধ হয়েছিল, তা অনুধাবন করা যায় ’৭৫ পরবর্তী সব জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পেশাবৃত্তান্ত থেকে নির্ণয়ন স্পষ্ট। সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি ধ্বনিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রান্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অপ্রতুলতার কারণে জনসম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে সংসদে যথার্থ আলোচনা হয়নি এবং তা নিয়ে সংসদ তেমন উত্তপ্ত হতে দেখা যায়নি। বরং জনস্বার্থকেন্দ্রিক কার্যক্রমের প্রণয়নের চেয়ে উচ্চবিত্তের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণকেন্দ্রিক কার্যক্রমই বেশি হয়েছে। সংসদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের ওয়ার্ড মেম্বার পর্যন্ত পদগুলো ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের কব্জায় আবদ্ধ। ফলে জনসেবাকেন্দ্রিক এসব পদ পদবিতে নির্বাচনী তরী পার হওয়ার জন্য নিয়মিত অর্থের প্রতিযোগিতা চলে। দুর্ভাগ্য হলেও লক্ষ্য করা যায় ওয়ার্ড পর্যায়ের একজন সদস্য নির্বাচিত হতেও এখন বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র কিংবা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর পদগুলো এখন জনস্বার্থ থেকে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের কব্জায় চলে যাচ্ছে। রাজনীতির ষোলকলা পূর্ণ করে ব্যবসায়িক ধনিক বণিক শ্রেণি এখন প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত ফসল ও পণ্য ব্যবস্থার ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। যান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থা ও কৃষি জিন প্রযুক্তি, পণ্য সংরক্ষণ, বণ্টন, কৃষি, কীটনাশক সবই এখন ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কবলে। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির ফলে দেশে সবজি, মাছ, পোল্ট্রি, ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু তার সুফল প্রান্তিক জনগণ ভোগ করতে কতটা পারছে? সার, বীজ, বাচ্চা উৎপাদন, পোল্ট্রি খাদ্য, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ যন্ত্র ও বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে মুষ্টিমেয় উচ্চ শ্রেণির করপোরেট গ্রুপের দ্বারা। তারা তাদের মনমতো বীজ, পোল্ট্রি বাচ্চা, যন্ত্রপাতির দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। যেমন একজন প্রান্তিক পোল্ট্রি চাষিকে মুরগির বাচ্চা ক্রয় করতে হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। সঙ্গে রয়েছে খাদ্য নিয়ন্ত্রণের কারসাজি। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে স্বল্পমূল্যে মুরগি বা ডিম কোনোটা সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাছের রেণু পোনা উৎপাদন ও মৎস্য খাদ্যও একইভাবে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে।
সাধারণ চাষিদের বিক্রি করা দাম ও শহরের ক্রেতাদের কেনা দামের এমন পার্থক্যের কারণ মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট। এর ফলে যেমন কৃষকের উন্নতি হচ্ছে না, তেমনি ঠকছেন ভোক্তারা। বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার দায়ভার চলে যাচ্ছে সরকারপ্রধানের ওপর। সবজি, পোল্ট্রি মুরগি, ডিম, মাছ, মসলা, ভোজ্যতেল, চিনি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব নিয়েছে মুষ্টিমেয় সিন্ডিকেট। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন সিন্ডিকেটদের জয়জয়কার। এই অসাধু সিন্ডিকেট করপোরেট গোষ্ঠী সাধারণ মানুষকে সরকারের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যে অসাধারণ উন্নয়ন অগ্রগতি বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে নিয়েছে, তা সত্ত্বেও প্রান্তিক জনমনে অসন্তোষ বিস্তারের পেছনে এই সিন্ডিকেট শ্রেণির অসাধু ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড শতভাগ দায়ী। তারা শুধু নিত্যপণ্য নয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, রাজনীতি সবকিছুই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সরকারকে জিম্মি করছে। শ্রমমজুরির ন্যায্য প্রাপ্তি রাষ্ট্রের প্রতিজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদর্শ দর্শনের কথা সমুচ্চরে উচ্চারিত হলেও চাতুর্যপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নিয়োজিত ধনিক শ্রেণির তপ্লিবাহক ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি সরকারের সদিচ্ছাকে অপব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমশোষণের পন্থা অবলম্বন করেছে আউটসোর্সিংয়ের নামে। এ প্রক্রিয়ায় শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্য মজুরিতে কমিশনের ভাগ বসিয়ে কিছু মানুষকে অধিকতর ধনীতে পরিণত করার কৌশল নেয়া হয়েছে। এই আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় ঊর্ধ্বতন পদে কোনো নিয়োগ দেয়া হয়নি। উচ্চ বেতনভোগী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা থেকে কোনো কমিশন দিতে হচ্ছে না। সরকারের দায়বদ্ধতা থেকেই সাধারণ মানুষকে সাময়িক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার সৎ উদ্দেশ্যেই আউটসোর্সিং নিয়োগের নির্দেশনা জারি করেছিলেন। কিন্তু জনস্বার্থবিরোধী কিছু ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি সেই সরকারি নির্দেশের অপব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ করে সাধারণ কর্মজীবীদের শোষণ করছে এবং খেটে-খাওয়া মানুষকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে উসকে দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের স্বনামধন্য একজন বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা এটিকে নব্য দাসপ্রথা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে সরকারি, আধা সরকারি সংস্থা ও কোম্পানিতে উচ্চশ্রেণির লোকদের অধিক সংখ্যায় নিয়োগ দেয়া অসৎ উদ্দেশ্যে জনবল নিয়োগে পিরামিড ফর্মুলা না মেনে উচ্চ পদে পদ সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সৃষ্টি করা হচ্ছে মাথাভারি প্রশাসন কাঠামো। হ্রাস করা হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের অপরিহার্য জনবল। এতে একদিকে মাঠ পর্যায়ে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে বাড়বে প্রশাসনিক ব্যয়। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। জনস্বার্থবিরোধী এহেন কার্যক্রম নিঃসন্দেহে বৈষম্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার অন্তরায় এবং বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনার নীতি দর্শন বিরোধী। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেশ কিছু নির্দেশনা ও আশ্বাসকে সুদীর্ঘ ৮/১০ বছরেও বাস্তবায়ন না করে বিভিন্ন শ্রেণির কর্মজীবী পেশাজীবীদের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনগণের নির্বাচিত জনক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব, তার নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে মূলত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকেই উপেক্ষা করা হচ্ছে। জনসার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করা হলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞান সব সময় প্রকৃতি বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করে। যুগ যুগ ধরে এটি প্রমাণিত। কিন্তু যখনই প্রকৃতি বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রক হয়ে যায়, তখন সভ্যতায় বিপর্যয় নেমে আসে। দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। যে মানুষ সমাজে বাস করে না, সে হয় দেবতা না হয় পশু। আমাদের যে সিন্ডিকেট প্রবণতা বিদ্যমান, সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্তরা সামাজিক জীব হলেও তারা সমাজ থেকে বিচ্যুত। তাই তাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড মানবসভ্যতার বিপক্ষে পরিচালিত হয়- পশুত্বের তাড়না থেকে। এই পশুত্বকে নিয়ন্ত্রণের ভার নিতে হবে সমাজবিজ্ঞানের কর্ণধার হিসেবে জনসম্পৃক্ত রাজনীতিবিদদের এবং সমাজবিজ্ঞানী গণমুখী আমলাতন্ত্রকে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে লাখো কোটি টাকা ব্যয়ে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও বিষয়ভিত্তিক জনসম্পদ তৈরি করা হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবাই ক্ষমতার দাপট দেখাতে তৎপর হওয়ায় সরকারের লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি বিশেষায়িত কারিগরি পেশাজীবীদের মধ্যে পেশা পরিবর্তনের হিড়িক পড়েছে। সবাই এখন পেশা পরিবর্তন করে প্রশাসনিক ক্যাডারে চলে যাচ্ছে। সমাজ রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর এখন প্রকৃত সমাজবিজ্ঞানীদের হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এটা শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থ ও মেধা অপচয়ই নয় বরং জনস্বার্থবিরোধী। অন্যদিকে যারা অত্যন্ত মেধাবী তারা এসব নোংরামিতে অভ্যস্ত না হয়ে স্বাচ্ছন্দ্য জীবনবোধের প্রেরণা থেকে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। জাতি হারাচ্ছে মেধাস্বত্ব। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া, সমাজবিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক কাঠামো এখন ক্রমেই বিশেষায়িত পেশাজীবীদের দখলে। আদর্শচ্যুত রাজনীতি ও কারিগরি পেশাজীবীদের গোষ্ঠীপ্রীতি প্রশাসনিক কর্তৃত্ববাদ ঠেকাতে না পারলে প্রধানমন্ত্রী যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন জাতিকে দেখাচ্ছেন, সেটি বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রকৃত রাজনৈতিক সংগঠকদের হাতেই রাজনীতির হাল ফিরিয়ে আনতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে সমাজজ্ঞান সম্পন্ন গণমুখী আমলাতন্ত্র। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৪ সালে প্রথম সাহিত্য সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতা অবতারণাযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণই সব শিল্প, সাহিত্য ও রাজনীতির উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম হতে পারে না’। বঙ্গবন্ধুর এ অসাধারণ অভিব্যক্তি রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গণমানুষ তথা জনসার্বভৌমত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাজনীতি কখনো জনকল্যাণকর রাজনীতি হতে পারে না। এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সমাজ রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। বেনিয়া ধ্যান জ্ঞান সমাজ কল্যাণকর গণমানুষের রাষ্ট্রকে কলুষিত করে। তাই আমাদের যে কোনো মূল্যে সমাজ রাষ্ট্রের বর্ণবাদী করপোরেট কালচারের দুর্বৃত্ত দুর্গ ভেঙে দেয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালুর জন্য কাজ করতে হবে। জনসার্বভৌত্ব রক্ষায় করপোরেট সংস্কৃতি প্রতিরোধের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা ও দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক অনুশীলনের জন্য রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
আশার কথা হলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে তার কন্যা শেখ হাসিনা জীবনবাজি রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটি স্বার্থান্বেষী মহল অসৎ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করছে। কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, আমলা ও ব্যবসায়ী ধন-সম্পদে স্ফীত হয়ে উঠবে। এছাড়া কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের সৃষ্ট প্রথার মতো সাধারণ মানুষকে প্রজা এবং তাদেরকে রাজা মনে করেন। যা জাতির পিতা ও তার কন্যা শেখ হাসিনার আদর্শের বিপরীত। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো জাতি তার আদর্শের জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে বেশি দূর এগোতে পারে না। শিকড় ছিন্ন জাতি অভীষ্ট লক্ষ্যে কখনো পৌঁছাতে পারে না। শিকড় ছিন্ন বৃক্ষ যেমন স্বল্প প্রতিকূল পরিস্থিতিতে উপড়ে পড়ে, তেমনি আদর্শের ভিত্তি ছিন্ন, দিকভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট জাতি রাষ্ট্র বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে মর্যাদার আসনে টিকে থাকতে পারে না। কাজেই জাতি রাষ্ট্র বিকাশের জন্মদর্শন অনুসৃত হতে হবে সর্বত্র। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, ত্যাগী নেতৃত্ব, রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, চেতনা, আদর্শ, দর্শন থেকে সামান্যতম বিচ্যুতি হলে জাতির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে। সবকিছু মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদীর দখলে চলে যাবে। জাতির পিতার প্রদর্শিত পথে জনগণের ক্ষমতায়ন রাজনীতি পরিচালিত না হলে বিনষ্ট হবে বঙ্গবন্ধুর আরোধ্য জনসার্বভৌমত্ব। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নীতিদর্শনকে অনুসরণ করে এই আরোধ্য পথে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আরো কঠোর হতে হবে জনসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায়। কেননা জনসার্বভৌমত্ব বিপন্ন হলে পথ হারাব রাষ্ট্র। যা মুক্তিযুদ্ধ করা একটা জাতির কাম্য নয়।

এ কে এম এ হামিদ : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়