গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা : ব্রিকসের সদস্য না হলেও অংশ নেয়া বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক

আগের সংবাদ

সাইবার নিরাপত্তা আইন চূড়ান্ত : মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন, ফিরে আসছে অফিসিয়াল সিক্রেসি আইন

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী চেতনা ও স্বাধীন বাংলা : নিউক্লিয়াস গঠনের পটভূমি

প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ, মিছিল-ধর্মঘট, বিবৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে অনেক গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সরকারের বাধাদান, নিপীড়ন-নির্যাতন, জেল-জুলুম, প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন করার বিপ্লবী চিন্তা-প্রচেষ্টাও অনেকের ছিল। এজন্য গোপন সভা-সমাবেশ, স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরির মাধ্যমে স্বাধীনতাপন্থি জনবল সংগ্রহ ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে আন্দোলন ত্বরান্বিত করার বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়ার কথাও চিন্তা করেছিলেন কেউ কেউ। এদের মধ্যে সবাইকে ছাপিয়ে সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তরুণ-যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে সবচেয়ে সক্রিয় ও সমন্বিত বিপ্লবী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সেই বিপ্লবী পরিকল্পনার বড় ফসল ষাটের দশকের শুরুতে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। যার পরিবর্তিত পরিচয় ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’। প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আড়ালে থেকে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সদস্যদের মাধ্যমে সারাদেশের বাছাই করা তরুণ-যুবকদের মাঝে স্বাধীনতার মন্ত্রবীজ ঢুকিয়ে দিয়ে সবাইকে একই পতাকাতলে শামিল করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে নেন তিনি।
ষাটের দশকের স্বাধীনতাপন্থি প্রগতিশীল ছাত্র নেতা হিসেবে খ্যাত ও স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের প্রথম সারির সংগঠকদের অন্যতম ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। ওই সময়ে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজকে নিয়ে পরিচালিত প্রকাশ্য ও গোপন কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুর সাক্ষী তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনেও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তার। স্বাধীনতার পর তিনি জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান, একাধিকবার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিত্বসহ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি, এতে প্রগতিশীল প্রবীণ-নবীন রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, ছাত্রসমাজ ও সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন বাঙালি সদস্যদের ভূমিকার ব্যাপারে তার অনেক কিছু জানা থাকার কথা। তাই ২০০৭ সালের ২২ মার্চ বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের কক্ষে বসে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। এ সময় তিনি তুলে ধরেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ও স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠনের পটভূমি এবং এতে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার কথা।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ছাত্র-যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তার সূচনা ও প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘদিনের। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ অনেক রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবদান এ প্রস্তুতিতে ছিল। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীসহ আরো অনেকে স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ইত্যাদির স্বপ্ন মানুষের মনে জাগিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জনে অটল থেকে পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধুর মতো কেউ এগিয়ে যেতে পারেননি। পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস, ছয় দফা, পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করা সবই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে তার (বঙ্গবন্ধুর) এক একটি পদক্ষেপ। সব কিছুতেই ছিল তার নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা।
বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, তখনকার দিনে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি বিবেচনার মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দল করা কঠিন হবে ভেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান (মুসলিম) ছাত্রলীগ সংগঠন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আবুল হাশেম প্রমুখ নেতা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণের চিত্র দেখে বঙ্গবন্ধু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিন্তা করেন।

বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক করে নিউক্লিয়াস গঠন
স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছাত্রলীগকে সংগঠিত ও স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠনের পটভূমি ব্যাখ্যা করে সাবেক ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক বলেন, তখনকার পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের যথাযথ সুযোগ ও ক্ষেত্র খোঁজেন। ভাষার দাবি, ভাষার জন্য রক্তপাত ইত্যাদির মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর বাঙালিদের নেতৃত্বে সরকার গঠন এবং ’৫৬ সালে একটি সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে বাঙালিদের কিছু দাবি-দাওয়া পূরণের সম্ভাবনা দেখা দিলেও নানা কারণে তা হয়নি। ’৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির ফলে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ বন্ধ হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে গোপনভাবে সংগঠিত করার মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ ব্যাপারে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রনেতার সঙ্গেও পরামর্শ করেন তিনি। শাহ মোয়াজ্জেমকে সভাপতি ও শেখ ফজলুল হক মনিকে সাধারণ সম্পাদক করে ’৬১ সালে গঠিত ছাত্রলীগের কমিটিতে সিরাজুল আলম খান এবং আমিসহ আরো কয়েকজন বিভিন্ন পদে ছিলাম। ’৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হলে তার মুক্তি, সামরিক আইন প্রত্যাহার, হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল ইত্যাদি দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা সংগঠিত হতে থাকি। এ পর্যায়ে সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা বাড়ানোর দাবি ওঠে। আইয়ুব খান বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা যুদ্ধ করতে জানে না। এরা জানে শুধু জুতা সাফ করতে। তাই তাদের আর্মিতে নেয়া যাবে না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ কথা জানতে পেরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মনে আছে আমি এবং সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) আলাপ করছিলাম পেছনের দিকে বসে। সিরাজ ভাইকে বললাম, এভাবে আর থাকা যায় না। আসুন একটা কিছু করি। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমিও চিন্তা করছি, কিছু একটা করতে হবে।’
এর আগে থেকে সিরাজ ভাই, শেখ মনি, ওবায়দুর রহমানরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তিনিই তাদের বলেছিলেন কিছু একটা করা দরকার। সিরাজ ভাই বঙ্গবন্ধুকে সব সময় ‘লিডার’ সম্বোধন করতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয় ’৬৩ সাল থেকে। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে আন্দোলন পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক করে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ গঠন করা হয়। শুরু থেকে এর সদস্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আমি এবং কাজী আরেফ আহমেদ। এই নিউক্লিয়াসই ছিল মূলত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের অন্যরূপ। ’৬৪ সালে আমাদের কার্যক্রমের একটি রূপরেখা তৈরি হয়। আমরা সাইক্লোস্টাইল মেশিনে এ সংক্রান্ত একটি প্রচারপত্র বের করি। পরে একটি ট্রেডল মেশিন (মুদ্রণযন্ত্র) কিনে মোহাম্মদপুরের একটা বাড়ির চিলেকোটায় সেটি বসানো হয়। বাড়িটি ঠিক করেন কাজী আরেফ আহমদ। প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির আবুল কালাম আজাদ ছিলেন। পরে তাকে বাদ দেয়া হয়। প্রেসটিও বিক্রি করে দেয়া হয়।
নিউক্লিয়াসের কাজে তখন তাত্ত্বিক সহযোগিতা দিতেন অ্যাডভোকেট কমরুদ্দিন। তিনি সোহরাওয়ার্দীর আমলে বার্মায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন। ‘হিসট্রি অব বেঙ্গল’ নামে একটা অধ্যায় আমাদের এই লাইনের ক্যাডারদের জন্য তিনি পাঠ্য করেছিলেন। চে গুয়েভারা, মাও সেতুং এবং আলজিরিয়ার ওপর একটি বইসহ আরো বেশ কিছু বই আমাদের পাঠ্য ছিল। এসব কিছুই হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুমতিক্রমে।

স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি এবং ছয় দফা
স্বাধীনতার জন্য ছাত্রলীগের তৎপরতা এবং ছয় দফা প্রসঙ্গে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। ছাত্র ও শ্রমিকদের সংগঠিত করার পাশাপাশি ছয় দফার পক্ষে প্রচারের কাজও আমরা চালিয়ে যাই। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছি, আবার ছয় দফা কেন- জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘ওপারে যাওয়ার সাঁকো তৈরি করে দিলাম।’ অর্থাৎ ছয় দফা হচ্ছে স্বাধীনতার পথে যাওয়ার জন্য সেতুস্বরূপ।
স্বাধীনতার লক্ষ্যে গৃহীত সাংগঠনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর অনুমতি সাপেক্ষ আমরা একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। সে অনুযায়ী প্রতিটি থানায় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে একজনকে প্রধান করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট গ্রুপ তৈরি করা হয়। প্রথম দিকে তারা ছয় দফা, স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি নিয়ে জনগণের সঙ্গে কাজ করতেন। কিছুদিন গ্রুপে থাকার পর রক্ত শপথের মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতার জন্য কাজ করার প্রস্তুতি নেয়ার বিষয়টি জানানো হতো। গ্রুপের সদস্যদের একটি প্রচারপত্র দেয়া হতো, যাতে থাকত আমাদের লক্ষ্য, কর্মসূচি, গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ইত্যাদি। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে পুলিশ তথা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কিত কেউ আছে কিনা যাচাই করা হতো। বঙ্গবন্ধু তার পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটি ছোট ট্রানজিস্টার খুলে রাখতেন, যাতে বাইরের কোনো মহল আমাদের পরিকল্পনার কথা ধরতে না পারে। আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৯ সালে তিনি জেল থেকে বের হওয়ার পর আমাদের কার্যক্রমের অগ্রগতি জানতে চান। ইতোমধ্যে আমাদের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, মানিকগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার ৩০০ সংসদীয় থানার প্রায় ২০০ থানায় কমিটি হয়ে গেছে। এর মধ্যে শক্তিশালী ছিল চট্টগ্রামের গ্রুপটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতেও শক্ত দল ছিল আমাদের। এ মুহূর্তে আমার চট্টগ্রামের এমএ মান্নান, আদমজীর এক শ্রমিক নেতা মান্নান, অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, এসএম ইউসুফ, মোকতার আহমদ প্রমুখের কথা মনে পড়ছে। আরো অনেকে ছিলেন সারাদেশে, যারা স্বাধীনতার জন্য শপথ নিয়ে আমাদের দলভুক্ত হয়েছিল। আমাদের অগ্রগতি জানার পর সবকিছুই বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক অনুমোদন করেন। আমাদের কার্যক্রমে যুক্তদের নিয়েই পরবর্তী সময়ে (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে) মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল।’

স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রচারণা ’৬১-তে
পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার মধ্যে মন্ত্রবীজ ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য ১৯৬১ সালে প্রচারিত একটি গোপন প্রচারপত্র বিলি করার অভিজ্ঞতার কথা জানান আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আমাদের জানার বাইরেও বঙ্গবন্ধু অনেককে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের কথা। একদিন মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) আমাকে ডেকে কাগজে মোড়ানো কতগুলো প্রচারপত্র দিয়ে বললেন, ‘এগুলো রাত ৩টার দিকে ভার্সিটি এলাকার হলে হলে, ঘরে ঘরে খুবই সাবধানে বিলি করতে হবে।’ তিনি চলে যাওয়ার পর সেগুলো খুলে দেখে প্রথমে আমি ঘাবড়ে যাই। কারণ সেখানে যা লেখা, ধরা পড়লে ১৪ বছর জেল নির্ঘাত। শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কায়েম কর।’ নিচে লেখা ছিল ‘সংগ্রামী জনতা’। সেখানে বাঙালিদের ওপর পশ্চিমাদের শাসন-শোষণ এবং সশস্ত্র বাহিনী ও রাজনীতিতে কীভাবে বাঙালিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তার বিবরণ দেয়া ছিল। এসব শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য বাঙালি ছাত্র-জনতাকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানানো হয় ওই প্রচারপত্রে। আমার মনের ভেতর যেহেতু স্বাধীনতার চেতনাটা ছিল, তাই সাহস করে রাতের মধ্যে ফজলুল হক হলের বিভিন্ন রুমে গিয়ে দরজার নিচ দিয়ে প্রচারপত্র ঢুকিয়ে দিয়ে চলে আসি। বাকিটুকু একটি টয়লেটের বেসিনের ওপর রেখে রুমে এসে শুয়ে থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি। সকালে আমার রুমমেট বাইরে গিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘বাইরে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের লিফলেট পাওয়া গেছে।’ আমি কিছু না জানার ভান করে বললাম, ‘এগুলো বিপজ্জনক, বাইরে ফেলে দে, কাউকে কিছু বলিস না।’
এই প্রচারপত্রও আমাদের স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। নিউক্লিয়াস গঠনের সময় বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল। মনি ভাই বলেছিলেন, ‘এটা বঙ্গবন্ধু করিয়েছেন। মানিক মিয়াও (তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) এতে যুক্ত আছেন।’ পরে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেও বিষয়টি জেনেছি। ’৬৭ সালে মানিক মিয়াও এটি স্বীকার করেন। ছয় দফা আন্দোলনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (পিডিএফ) গঠিত হলে সেখানে ছয় দফাবিরোধী নেতারা সব অংশ নেন। মানিক মিয়াও ছিলেন সেখানে। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে জানতে চান, এখন আমরা কী করছি। আমরা আমাদের আন্দোলন কর্মসূচির চিন্তা-ভাবনার কথা বললে তিনি বললেন, ‘এগুলো করে লাভ হবে না। ঐক্য ছাড়া শেখ মুজিব জেল থেকে আসতে পারবে না। সবাই জেলে মারা যাবে। তখন কী হবে?’ আমি স্বাধীনতার জন্য চারদিকে যে আলোচনা হচ্ছে, সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বললেন, ‘কীসের স্বাধীনতা?’ আমি তাকে ১৯৬১ সালে বিলি করা প্রচারপত্রে তিনি এবং বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘দেখ ওসব এখন বাদ দাও। বর্তমানে টোটাল কৌশল পরিবর্তন হয়ে গেছে, গেøাবাল স্ট্র্যাটেজি চেঞ্জ হয়ে গেছে।’ ওই সময় ছয় দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগে বিভক্তি আসে। শেষ পর্যন্ত ছয় দফাপন্থিরা জয়ী হয়। এরপর আগরতলা মামলা প্রত্যাহারসহ সংশ্লিষ্ট সবার মুক্তির দাবি এবং ছয় দফা ও ১১ দফার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সত্তরের নির্বাচন এবং ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের।

বাঙালি সেনা সদস্যদের ভূমিকা প্রসঙ্গে
ছাত্র সংগঠনের বাইরে অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের গোপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের কর্মকাণ্ড ছাড়াও বঙ্গবন্ধু গোপনে নানা কৌশলে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব থাকতেই তার অগোচরে এসব শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দীকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করলেও ১৯৫৬ সালের সংবিধান রচিত হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করলে বঙ্গবন্ধু তা মেনে নিতে পারেননি। তখনই তিনি ভেতরে ভেতরে অন্য পথ ধরেন। সোহরাওয়ার্দীর ছত্রছায়ায় থেকেই তিনি সিএসপি রুহুল কুদ্দুস, আহমদ ফজলুর রহমান, খান শামসুর রহমানদের সঙ্গে গোপনে পরামর্শক্রমে প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের কাজে করাচি গেলে সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর বঞ্চিত ও হতাশ দেশপ্রেমিক বাঙালি সদস্য, যারা পরে আগরতলা মামলার আসামি হন তাদের সংগঠিত করেন। ওই সময় এত গভীরে আমরা যাইনি। তাই তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে ভালো করে জানতাম না। তবে মনি ভাই, সিরাজ ভাই কিছু কিছু জানতেন। আমি জানতে পারি মামলা শুরু হওয়ার পর। এর আগে তাদের কাছে (শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান) জেনেছিলাম ১৯৬২-৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু আগরতলা গিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার জন্য। আমাদের আন্দোলনের প্রস্তুতি প্রক্রিয়া চলার সময় দু-একজন বাঙালি সেনা সদস্য মাঝেমধ্যে যোগাযোগ করে আমাদের আন্দোলন নিয়ে কথা বলছিলেন। কিন্তু তখন তাদের পরিচয় পাইনি। মামলা চলাকালে জেলখানায় গিয়ে তাদের আসল পরিচয় জানতে পারি। আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর পরিষ্কার জানতে পারলাম, বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকের শুরু থেকেই এসব কাজ ভেতরে ভেতরে চালাচ্ছিলেন।’
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা প্রসঙ্গে আবদুর রাজ্জাক বলেন, একাত্তরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কি ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাদের ডেকে বললেন- ‘ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হয়ে যা। যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। আমেরিকা ও চীন সমর্থন দেবে না। তবে রাশিয়ার সমর্থন এক পর্যায়ে আসবে। ভারতে গিয়ে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তাদের তালিকা এবং ঠিকানাও দেন তিনি।’
আবদুর রাজ্জাকের দেয়া এসব ওপরের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ কিংবা নিউক্লিয়াস গঠন, এর মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড-প্রস্তুতি; সব কিছুই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী চিন্তা-চেতনার প্রমাণ বহন করে।

মুহাম্মদ শামসুল হক : সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়