চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল চান মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা

আগের সংবাদ

ডিজিটাল প্রতারণা রুখবে কে

পরের সংবাদ

চন্দ্রযান ৩-এর সাফল্যের পূর্ব ও পশ্চাৎ

প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চাঁদে অবতরণ করেছে চন্দ্রযান-৩। ৪০ দিনের দীর্ঘ সফর। নিখুঁত ল্যান্ডিং অবশেষে। তার আগমনে উপগ্রহের মাটিতে যে ধুলোর ঝড় উঠেছিল, ক্রমে তা থিতিয়ে পড়ে। তার পরে বিক্রমের পেট থেকে বেরিয়ে আসে রোভার প্রজ্ঞান। তার ছয় চাকার ছাপ পড়ে চাঁদের মাটিতে। আগামী দুই সপ্তাহ (পৃথিবীর হিসাবে) চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে প্রজ্ঞান। তাকে সাহায্য করবে বিক্রম। এই সাফল্য অবশ্যই ভারতের একান্ত নিজস্ব উদ্যোগের ফসল।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাস। মঙ্গলে পৌঁছেছে ভারত। তাও আবার প্রথম প্রচেষ্টাতেই। খরচ ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ৪৫০ কোটি টাকা। সিনেমার বাজেটের চেয়েও কম। ভারতের এই সাফল্যকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি পাশ্চাত্য। মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল এই ব্যতিক্রমী ব্যঙ্গচিত্র। অথচ এক দশকের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে এই ছবি। ইসরোর চন্দ্রযান সাফল্যের পর এখন তাদের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলো রীতিমতো কুর্নিশ জানাচ্ছে ইসরোকে। এগিয়ে আসছে তথ্য বিনিময়ে। এই আকস্মিক রদবদলের কারণ কী?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয়েছিল দ্বৈরথ-ঠাণ্ডা যুদ্ধ। পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি মহাকাশও হয়ে ঠাণ্ডা যুদ্ধের অন্যতম ময়দান। মুখ্য হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদ, মতাদর্শের ফারাক, বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ এবং সামরিক স্বার্থ। মহাকাশে মানুষ পাঠিয়ে প্রথম বাজি সোভিয়েত মারলেও চাঁদের বুকে প্রথম মানুষ পাঠিয়ে দ্বিতীয় বাজি মারল আমেরিকা। কিন্তু পর্বতপ্রমাণ খরচের প্রেক্ষিতে এগুলো ছিল পর্বতের মুষিকপ্রসব। ১৯৫৮ সালের পর থেকেই চন্দ্রাভিযানের লড়াই শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যে। এই সময় থেকে শুরু করে ১৯৭০ সালের মধ্যে এই দুই দেশ সব মিলিয়ে ৮০ বার প্রচেষ্টা করেছে চাঁদে পৌঁছানোর জন্য। যার মধ্যে সাফল্য এসেছিল মাত্র ৩৪টিতে। ১৯৭২ সালে শেষবার চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল নাসা। তারপর থেকে প্রায় ৫০ বছর কেটে গেলেও, আর এ ধরনের অভিযানের চেষ্টা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। মহাকাশজয়ের যুদ্ধ থেকে সরে এসেছিল সোভিয়েতও।
এই রীতিতে আবার ছেদ পড়ে চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকে। আবার ঠাণ্ডা লড়াই। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রয়েছে চীন। রাজনৈতিক মতবিভেদ, চীনের আগ্রাসী মনোভাব ও চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হলো। ছাড়িয়ে সেই দ্ব›দ্ব ছড়িয়ে পড়ল মহাকাশেও। চাঁদ তো বটেই, মঙ্গলের উপগ্রহ ফোবসেও মহাকাশযান পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চমক দেয়ার যৌথ প্রচেষ্টা চালায় চীন ও রাশিয়া। যদিও সেই মহাকাশযান বিস্ফোরিত হয়েছিল মাঝ-আকাশেই। এসবের মধ্যে নীরব উত্থান মধ্যবিত্ত ভারতীয় ইসরোর। সাশ্রয়ী উদ্যোগ ও ঝুঁকিহীনতাকে মূলধন করে এগোল ইসরো। প্রথমত সাশ্রয়ী উপায়ে মহাকাশাভিযান, দ্বিতীয়ত সাফল্যের হার- উভয়ের প্রেক্ষিতেই গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
ভারতের এই উত্থানকে ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিতে দেখলেও অভিমত পাল্টায় পশ্চিমি দুনিয়া। তার মুখ্যত দুটি কারণ। এক. চীন এবং রাশিয়ার বিপরীতে লোকতন্ত্রে চালিত হয় ভারত। ফলে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে রাজনৈতিক মতানৈক্যের জায়গা নেই। দ্বিতীয়ত. অর্থনীতির দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে গেলে তিন-চার দশক সময় লাগবে ভারতের। কিন্তু গোলমালটা পাকাল ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির দলের জয় ও তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া। বিদেশের নির্ভরতা কমিয়ে কম খরচে দ্রুত গবেষণায় মন দিল ভারত। অন্যদিকে অর্থনীতিতে গতিবেগ বাড়ল। চাঁদের দক্ষিণ মেরু বড় লোভনীয় জায়গা। কারণ চাঁদের মাটি রেগোলিথে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, ক্যালশিয়াম, প্ল্যাটিনামসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। রয়েছে বিরল মৃত্তিকা মৌল ও হিলিয়ামের আইসোটোপ।
আগামী দিনে যা হয়ে উঠতে পারে খনিজ এবং শক্তির অন্যতম উৎস। তবে এই সম্পদ কীভাবে মানব সভ্যতার স্বার্থে ব্যবহার করা যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণার বিস্তর অবকাশ আছে। তাই তাকেই পাখির চোখ করল ভারত। চীনের মতো গোপনীয়তা নয়, বরং তথ্যের আদানপ্রদান শুরু হলো অন্যান্য দেশের সঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে চন্দ্রাভিযানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল বা জাপানের মতো দেশ। ভারত সেই তুলনায় অবশ্যই সফল। একাধিক চন্দ্রাভিযানের জন্য চাই প্রচুর অর্থ। কাজেই চন্দ্রাভিযানের তথ্যভাণ্ডার ভারত যখন খুলে দিল, তখন অন্যান্য দেশ ভারতের বিপক্ষে কথা বলা অসমীচীন হবে বুঝে সেই প্রচেষ্টা থেকে সরে এলো।
চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এই প্রথম সফল হলো কোনো চন্দ্রাভিযান। সেখানেই নাকি লুকিয়ে আছে বরফ, এর সম্ভাবনা প্রবল। আগামীতে চাঁদে বসতি তৈরি করা কিংবা মহাকাশযানের জ্বালানির জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন সরবরাহের অন্যতম উৎস হয়ে উঠতে পারে এই অঞ্চল। এই একই ধরনের অভিযানে শামিল হয়েছিল রাশিয়াও। তবে গত ২০ তারিখে চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে রাশিয়ার লুনা-২৫ ল্যান্ডার। তা নিয়ে বিগত কয়েক দিন ধরেই বিদ্রুপ-তামাশায় মেতে রয়েছে পশ্চিমি দুনিয়া। কেননা রাশিয়া ঘোষণা করেছিল, এই গবেষণা এবং অভিযানের তথ্য পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে ভাগ করবে না তারা। ফলে স্বার্থসিদ্ধির সুযোগের অভাবেই লুনা ২৫-এর থেকে মুখ ফিরিয়েছিল পাশ্চাত্য। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই জটিলতার মাঝে দাঁড়িয়ে চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্য সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। আগামী দিনে মহাকাশ বাণিজ্যে নিজের জায়গা আরো পাকা করে ফেলেছে ইসরো। ইসরোকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠতে চলেছে ছোট-বড় শিল্প, বদলাবে অর্থনীতি।
ভারত অনেক বড় দেশ এবং অর্থনীতিতে বিশ্বের পঞ্চম রাষ্ট্র। বাংলাদেশেও অনেকে সে দেশের রাস্তা তৈরিতে চুরি বা অন্যান্য দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। এই দুইয়ে তুলনা হয় না। একই ধরনের দুর্নীতি কি ভারতে হয় না? হয়। তবে হয়তো কম। কারণ প্রশাসনিক কঠোরতা। বর্তমানে ভারতনিবাসী বাংলাদেশের একজন লেখিকা সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছেন, ‘ভারতের এককালের অংশ বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের কি আগামী ১০০ বছরে চাঁদে পা রাখা সম্ভব? না। তারা ধর্মে ডুবে আছে, বিজ্ঞানকে দূরে সরিয়ে। কুরআনই নাকি তাদের বিজ্ঞান।’ ধর্ম ভারতেও আছে। ভারতের বিজ্ঞানীরাও ধর্ম মানেন। কিন্তু ধর্ম তাদের বিজ্ঞান গবেষণায় বাধা সৃষ্টি করে না। এ কথা সত্যিই যে ধর্মীয় জমায়েত বাংলাদেশে ভারতের তুলনায় অনেক বেশি হয়। তবে তিনি আরেকটি কথা বলেছেন। ‘ভারতের যত্রতত্র বিজ্ঞান ক্লাব বা বিজ্ঞান গবেষণাগার খুলতে কোনো সমস্যা হয় না। বাংলাদেশে সমস্যা হয়। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিকরা পাড়ায় পাড়ায় বিজ্ঞান ক্লাবের বদলে মসজিদ মাদ্রাসা গড়তে আগ্রহী।’ এটা যদি সত্যি হয় তাহলে এটাই হা-হুতাশ ও প্রতিবাদের কারণ হতে পারে।
কলকাতা থেকে

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়